
কোকোমেলন। ছবি: সংগৃহীত
যুক্তরাষ্ট্রের ক্যালিফোর্নিয়ায় ২০০৫ সালে জে জিওনের হাত ধরে কোকোমেলনের পথচলা শুরু হয়। তিনি ও তার স্ত্রী মিলে একটি ইউটিউব চ্যানেল তৈরি করেন। তখন চ্যানেলটির নামকরণ করা হয় এবিসি কিড টিভি। তারপর চ্যানেলটির ফলোয়ার বাড়তে থাকে দ্রুতগতিতে। তারপর এটি সিরিজ হিসেবে দেখানো শুরু হয় এবং জেজেকে প্রধান চরিত্র করা হয়।
বর্তমানে বিশ্বব্যাপী কোকোমেলনের গ্রাহকসংখ্যা ১৮ কোটি ৪০ লাখ। গ্রাহক সংখ্যার বিচারে ইউটিউবে বর্তমানে তৃতীয় অবস্থানে আছে এই শিশুতোষ ইউটিউব চ্যানেলটি। মূলত শিশুদের উপযোগী বিভিন্ন শিক্ষামূলক কনটেন্ট আপলোড করা হয় চ্যানেলটিতে। বাংলাদেশেও দারুণ জনপ্রিয় এই সিরিজটি। তবে এর জনপ্রিয়তা নিয়ে বিতর্ক বা সমালোচনা আছে। কারণ কিছু বিশেষজ্ঞ মনে করেন, এই সিরিজটি দেখাতে সময় সীমাবদ্ধ করা উচিত। গবেষণা প্রতিষ্ঠান নিয়েলসেনের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, এখন নেটফ্লিক্সে স্ট্রিমিং করা কোকোমেলন ২০২৩ সালে যুক্তরাষ্ট্রে ৩৩ দশমিক ৩ বিলিয়ন মিনিট দেখা হয়েছিল।
রাজধানী ঢাকার বাসিন্দা জয়া বর্মণ বলেন, ‘আমার মেয়ে কোকোমেলনের খুবই ভক্ত। শুরুতে ব্যাপারটা ভালোই লাগত। কারণ এখান থেকে সে অনেক কিছু শিখেছে। কিন্তু একসময় দেখলাম এই শোতে আসক্ত হয়ে পড়েছে। সব সময় দেখার জন্য কান্না করে। খাবার খেতেও চায় না। এখন এটি বিড়ম্বনা হয়ে দাঁড়িয়েছে। তাই আমার মনে হয়, শিশুদের বিনোদনের দরকার আছে, কিন্তু তা অতিমাত্রায় দরকার নেই।’
কোকোমেলন কেন এত জনপ্রিয়
এই শোটি শিশুদের কাছে বেশি জনপ্রিয়। এর অন্যতম কারণ নকশা বা চরিত্রগুলোর ভঙ্গিমা শিশুদের সহজে আকর্ষণ করতে পারে। আবার কোকোমেলন অ্যানিমেশনে উজ্জ্বল রং ব্যবহার করা হয়েছে। পাশাপাশি ভিজ্যুয়াল ও চরিত্রগুলোর বিভিন্ন কার্যকলাপ শিশুদের মস্তিষ্ককে তীব্রভাবে উদ্দীপিত করতে পারে। মনোবিজ্ঞানী তানজিনা হাসান বলেন, শিশুরা যখন এ ধরনের অ্যানিমেশন দেখে তখন তাদের মস্তিষ্ক বিশেষভাবে সক্রিয় হয়ে ওঠে। সাধারণত ভিজ্যুয়ালগুলো যত বেশি প্রাণবন্ত হয় অক্সিপিটাল লোব ও টেম্পোরাল লোবের সক্রিয়তা তত তীব্র হয়। আর কোকোমেলনে ঠিক এই কাজটিই করা হয়েছে। ফলে সহজেই শিশুদের মনোযোগ আকর্ষণ করতে পেরেছে। তাই বিশ্বব্যাপী এর জনপ্রিয়তা বেড়েছে। শিশুরা কোকোমেলনের প্রতি আসক্ত হয়ে পড়েছে। অনেক মা-বাবা হয়তো এ বিষয়টি নিয়ে উদ্বিগ্ন। কারণ তারা চাইলেই এই শোটি দেখানো বন্ধ করতে পারছেন না।
এ ছাড়া সিরিজটির জনপ্রিয়তা ধরে রাখার জন্য কোকোমেলনের একটি বিশাল বিশেষজ্ঞ দল কাজ করে। টাইম ম্যাগাজিনের তথ্য অনুযায়ী, নতুন পর্ব আনার আগে এই বিশেষজ্ঞ দল নানা ধরনের জরিপ চালায়। সেই জরিপের ফলাফলের ভিত্তিতে নতুন নতুন পর্ব নির্মাণ করা হয়। নিয়েলসেনের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, কোকোমেলনের দর্শকের ৫৬ শতাংশের বেশি আফ্রিকান-আমেরিকান, এশিয়ান-আমেরিকান ও স্প্যানিশ ভাষাভাষী দেশ ও পরিবারের। তাই নির্মাতারা তাদের সংস্কৃতিকে মাথায় রেখে একেকটি পর্ব নির্মাণ করেন। এতে ওই সব এলাকার শিশুদের পাশাপাশি অভিভাবকদের কাছে এর জনপ্রিয়তা আছে।
ঢাকার মোহাম্মদপুরের বাসিন্দা রেহানা আক্তার। কোকোমেলনের জনপ্রিয়তা নিয়ে তাকে প্রশ্ন করা হলে তিনি জবাব দেন, ‘আমার ছেলে কোকোমেলনের ভক্ত। সে এই শো ছাড়া অন্যকিছু দেখে না। তাকে দেখে বাড়ির অন্য শিশুরাও এখন কোকোমেলন দেখে। এখান থেকে কিছু ইতিবাচক পরিবর্তন এসেছে আমার ছেলের মধ্যে। যেমন ও আগে সবজি খেতে চাইত না, কিন্তু এই শো দেখে ও জেনেছে সবজি খাওয়া ভালো। তাই এখন তাকে সবজি খাওয়াতে সমস্যা হয় না। এ ছাড়া কোকোমেলনের গানগুলোও অসাধারণ।’
কোকোমেলন নিয়ে বিতর্ক
এই শো নিয়ে অনলাইনে প্রচুর আতঙ্ক ছড়িয়েছে। অনেকে মনে করেন, কোকোমেলন শিশুদের আসক্ত করে তোলে। ফলে শিশু আচরণে ব্যাপক পরিবর্তন আসে। যেমনÑমা-বাবারা শোটি বন্ধ করে দিলে শিশুরা ভয়ানক মেল্টডাউন হয়। তারা দেখার জন্য বারবার আবদার করতে থাকে, খাওয়া বন্ধ করে দিতে পারে। তাই এই শো নিয়ে শুরু থেকে সোচ্চার ছিলেন যুক্তরাষ্ট্রে শিশু বিশেষজ্ঞ জেরিকা সানেস। তিনি প্রায়ই সামাজিক মাধ্যমে এর বিরুদ্ধে লিখতেন।
একবার সানেস লিখেছিলেন, ‘কোকোমেলন এতটাই আবেগপ্রবণ যে, এটা শিশুদের মধ্যে ড্রাগের মতো উত্তেজক হিসেবে কাজ করে। এর স্ক্রিনটাইম থেকে শিশুর ডোপামিনের সরবরাহ বেড়ে যায়, তাই তারা শোটির প্রতি আবেগপ্রবণ হয়ে ওঠে। ফলে শিশুদের মধ্যে কোনো নিয়ন্ত্রণ থাকে না, তারা দীর্ঘ সময় এটি দেখতে চায়। এতে শিশুর সৃজনশীলতা কমতে শুরু করে। এমনকি তারা খেলাধুলার আগ্রহও হারিয়ে ফেলে।’
কোকোমেলন কি দেখতে দেওয়া উচিত
এই প্রশ্নের উত্তর দেওয়া মুশকিল। কারণ এটা নির্ভর করে মা-বাবার ওপর। তারা যদি সন্তানকে সময় দিতে পারেন, তাহলে অন্য বিনোদনের মাধ্যম খুব বেশি দরকার হয় না। কিন্তু মা-বাবা যদি সন্তানকে সময় না দিতে পারেন, তাহলে তার জন্য বিনোদনের একটি মাধ্যম দরকার। আর তখন সেই শিশু দীর্ঘ সময় কোকোমেলন বা অন্য কোনো অ্যানিমেশন দেখবে। এতে স্বাভাবিকভাবে তার মধ্যে আসক্তি তৈরি হয়ে যাবে। তাই বিশেষজ্ঞরা পরামর্শ দিয়েছেন, যদি কোকোমেলন বা অন্য কোনো অ্যানিমেশন দেখাতে হয়, তাহলে তা যেন পরিমিতভাবে দেখানো হয়। আবার কয়েক দিন দেখানোর পর শিশুর প্রতিক্রিয়া পর্যবেক্ষণ করতে হবে। যদি মনে হয় সে আসক্ত হয়ে পড়ছে, তাহলে আগে থেকেই সাবধানতা অবলম্বন করাই শ্রেয়।