Logo
×

Follow Us

লাইফস্টাইল

কোয়ারেন্টিনে মানসিক সুস্থতা

Icon

চয়ন কুমার দাস

প্রকাশ: ১১ মে ২০২০, ০৯:৩১

কোয়ারেন্টিনে মানসিক সুস্থতা

প্রতীকী ছবি

করোনাভাইরাসে সংক্রমিত না হতে বা শারীরিক সুস্থতা নিশ্চিত করার জন্য পুরো বিশ্ব এখন স্থবির। লকডাউন চলছে দেশে দেশে। আর ঘরে ঘরে মানুষকে আলাদা করে রাখাকে বলা হয় কোয়ারেন্টিন। 

প্রয়োজনীয় এই সাময়িক স্থবিরতা শারীরিক সুস্থতা নিশ্চিত করলেও মানসিক স্বাস্থ্যের ওপর ফেলছে বিরূপ প্রভাব। এই প্রভাব স্বল্পকালীন মানসিক চাপ, যেমন- একঘেয়েমি, মন খারাপ, অস্থিরতা, ভয় ইত্যাদির পাশাপাশি তৈরি করতে পারে ডিপ্রেশন, অসুস্থতাভীতি, প্যানিক ডিজঅর্ডার, পোস্ট ট্রমাটিক স্ট্রেস ডিজঅর্ডার, অবসেসিভ কম্পালসিভ ডিজঅর্ডার, বিভিন্ন ধরনের আসক্তির মতো দীর্ঘমেয়াদি মানসিক সমস্যা। 

গবেষণায় দেখা যায় যে, মানসিক সুস্থতা ও রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতার রয়েছে সরাসরি সম্পর্ক। ইতোমধ্যে আমরা সবাই জানি, করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হলে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতার ওপর একজন মানুষের সুস্থতা নির্ভর করে। আবার করোনাভাইরাস-পরবর্তী বিশ্ব নিয়ে যে অনিশ্চয়তা রয়েছে, মানসিকভাবে সুস্থ থাকলেই শুধু তার সম্মুখীন হওয়াটা সহজ হবে। 

দুর্যোগময় এই সময়ে নিজের ও পরিবারের কল্যাণে গ্রহণ করতে হতে পারে বিভিন্ন কার্যকর সিদ্ধান্ত। সঠিক সময়ে সঠিক সিদ্ধান্ত নেয়ার জন্যও প্রয়োজন মানসিক সুস্থতা। 

কোয়ারেন্টিনে মানসিক সুস্থতা নিশ্চিতের কিছু উপায়

মানিয়ে নেওয়া: বৈশ্বিক এই মহামারিতে যে দুটি বিষয়কে মানিয়ে নেয়া গুরুত্বপূর্ণ। ১. বাইরে ঘটতে থাকা এক অদৃশ্য শক্তির সাথে যুদ্ধ ও ২. নিজের ভেতরে চলমান অস্থিরতা। পরিবেশের নিয়ন্ত্রণ যখন আমাদের হাতে থাকে না, তখন মানসিকভাবে স্থিতিশীল থাকার জন্য পরিবেশের সাথে নিজেকে মানিয়ে নেয়া গুরুত্বপূর্ণ। এই পরিস্থিতিতে নেতিবাচক অনুভূতি হওয়াটাই স্বাভাবিক। তাই আমাদের অভ্যন্তরে সৃষ্টি হওয়া অল্প মাত্রার অস্থিরতা, ভীতি বা চিন্তার সাথে খাপ খাইয়ে নেয়াটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ।

ইতিবাচক থাকা: দুর্যোগকালীন মুহূর্তে ইতিবাচক থাকতে বলাটা যতটা সহজ, প্রকৃতপক্ষে তা বাস্তবে করতে পারাটা ততটাই কঠিন। মনোবিজ্ঞানীদের মতে, নেতিবাচকতার চক্রে পড়ে যাওয়ার পদ্ধতিটা বোঝা সম্ভব হলেই নেতিবাচকতাকে মোকাবেলা করা সম্ভব। একটা পরিস্থিতি ইতিবাচক নাকি নেতিবাচক হবে, তা নির্ভর করে পরিস্থিতির পরে মাথায় আসা চিন্তাটি থেকে। 

উদাহরণস্বরূপ, করোনাভাইরাস পরিস্থিতিতে মাথায় যদি সবসময় এই চিন্তা আসে যে, আমি করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুবরণ করবো তখন স্বাভাবিকভাবেই তা ভীতিকর আবেগ তৈরি করবে। এর ফলে করোনাভাইরাসের লক্ষণগুলোতে মাত্রারিক্ত গুরুত্ব দেয়া, করোনাভাইরাসের ভয়ে মন খারাপ করে নিজেকে সব কিছু থেকে দূরে রাখার মতো ঘটনাও দেখা যেতে পারে। কেউ এ নেতিবাচকতার চক্রে পড়ে গেলে শারীরিক বিভিন্ন লক্ষণ যেমন- ক্লান্তি, দুর্বলতা ইত্যাদি অনুভব করতে পারেন। করোনাভাইরাস না হলেও জ্বর জ্বর অনুভব করা, গলায় অস্বস্তি, শ্বাসকষ্ট হচ্ছে মনে হওয়া ইত্যাদি অনুভব করতে দেখা যায়। অর্থাৎ মানসিক কারণে শারীরিক লক্ষণ অনুভব হতে পারে। 

স্বয়ংক্রিয়ভাবে আসা এমন নেতিবাচক চিন্তার পরিবর্তে ইতিবাচক চিন্তার জন্য যা যা করা যেতে পারে:

১. নেতিবাচক চিন্তার সত্যতা যাচাই করে অসত্য নেতিবাচক চিন্তা পরিহার করা। যেসব নেতিবাচক বিষয় ঘটতে পারে, সেজন্য পরিকল্পনা করা। যেমন- নিজে অসুস্থ হলে কোথায়, কীভাবে কার সাথে যোগাযোগ করবেন, হটলাইনের নম্বরগুলো সংরক্ষণে রাখা, বাসায় আইসোলেশনের জন্য সুযোগ সুবিধাগুলো আছে কিনা ইত্যাদি।

২. করোনাভাইরাস সম্পর্কিত সংবাদে নিজেকে আটকে না ফেলে সংবাদ দেখা, গান শোনা, বই পড়ার জন্য দিনের নির্দিষ্ট সময় বেছে নেয়া। 

৩. করোনাভাইরাস সম্পর্কিত বিভিন্ন ধরনের গুজব ও ভ্রান্ত ধারণা এড়িয়ে চলে বিশ্বাসযোগ্য মাধ্যম থেকে সঠিক সংবাদ গ্রহণ করা। 

কার্যকর রুটিন অনুসরণ করা: কোয়ারেন্টিনে একঘেয়েমি, মন খারাপ থাকা, সময়ের সঠিক ব্যবহার না করতে পারাসহ বেশ কিছু সমস্যা দূর করে মানসিক সুস্থতা নিশ্চিত করার জন্য একটি কার্যকর রুটিন তৈরির বিকল্প নেই। রুটিন তৈরি করার ক্ষেত্রে যে বিষয়গুলো মাথায় রাখা গুরুত্বপূর্ণ :

- পূর্ববর্তী রুটিনের খুব বেশি পরিবর্তন না করা। যেমন- কাজ নেই বলে অনেক রাত পর্যন্ত জেগে না থেকে, আগের শিডিউল ঠিক রেখেই রুটিন তৈরি করা।

- পর্যাপ্ত ঘুমের সময় রাখা।

- রুটিনে অল্প সময়ের জন্য হলেও প্রতিদিন ব্যায়ামের বিষয়টি রাখা। 

- ঘরে বসে করা সম্ভব এমন ন্যূনতম একটি পছন্দের কাজ প্রতিদিন রাখা।

- একঘেয়েমি দূর করার জন্য রুটিনে কাজের বৈচিত্র্য আনা।

- পূর্বে ফেলে আসা বা জমে থাকা কাজগুলোর তালিকা তৈরি করে রুটিনে অন্তর্ভুক্ত করা। 

- নিজের জন্য ও পরিবারের জন্য সময় রাখা।

- নতুন দক্ষতা অর্জনের জন্য সময় রাখা।

যোগাযোগের ভিন্ন উপায় ব্যবহার করা: শারীরিক দূরত্ব মানেই মানসিক দূরত্ব নয়। কোয়ারেন্টিনে থেকেও মোবাইল ও ইন্টারনেট ব্যবহার করে নিকটবর্তী মানুষের সাথে যোগাযোগ রাখা যায়। তবে এটিও পরিমিতভাবে করতে হবে, যেন তা আসক্তিতে পরিণত না হয়।

নিজেকে ও পরিবারকে সময় দেয়া: নিজেকে ও পরিবারকে সময় দেয়ার জন্য এর চেয়ে ভালো সময় হয়তো আমরা কখনো পাইনি। এ সময়ে নিজস্ব চিন্তা ভাবনাগুলো ডায়েরিতে লিখে ফেলা যেতে পারে। পাশাপাশি ত্বকের যত্ন, শরীরচর্চা, ইয়োগা বা মেডিটেশনের জন্যও সময়টা ব্যবহার করা যেতে পারে। আবার পরিবারের সবার সাথে অর্থপূর্ণ সময় কাটানোর জন্যও এটি ভালো সময়। একে অপরের কথাগুলো শুনুন, গুরুত্ব দিন, সম্ভব হলে একোথে ইনডোর গেমস যেমন- দাবা, ক্যারাম, লুডু ইত্যাদি খেলতে পারেন। 

স্বাস্থ্যকর জীবনযাপন নিশ্চিত করা: সুষম খাবার খাওয়া, তেল চর্বিযুক্ত খাবার পরিহার করা, নিয়মিত ব্যায়াম করা, করোনাভাইরাস প্রতিরোধে স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলার মধ্য দিয়ে স্বাস্থ্যকর জীবনযাপন নিশ্চিত হতে পারে। 

প্রোডাক্টিভ থাকা: কোয়ারেন্টিনে অনেকেরই এই ধরনের চিন্তা কাজ করতে পারে যে, ঘরে বসে আমি কোনো কিছুই করছি না। প্রথমত, এই দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন প্রয়োজন। আপনি ঘরে থেকে আপনার জীবনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কাজ করছেন নিজেকে রক্ষা করার মাধ্যমে, আপনার পরিবারকে রক্ষা করার মাধ্যমে, বৃহৎ অর্থে আপনার সমাজ ও দেশকে রক্ষা করার মাধ্যমে। পরিবারের বিভিন্ন কাজে অন্যদের সাহায্য করা, অনলাইনে বিভিন্ন অরগানাইজেশনের সাথে যুক্ত হয়ে কাজ করা, নিজের ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা করা যেতে পারে। যারা এই মুহূর্তে ‘ওয়ার্ক ফ্রম হোম’ করছেন, তারা যেখানে সেখানে বসে অফিসের কাজ না করে অফিসের জন্য আলাদা জায়গা নির্ধারণ করে ন্যূনতম অফিসিয়াল পোশাক পরিধান করে অফিসের কাজগুলো করলে উপকৃত হতে পারেন। 

মনোবৈজ্ঞানিক কৌশল ব্যবহার করা: অনিয়ন্ত্রিত আবেগ যেমন- রাগ, দুঃখ, ভীতির ক্ষেত্রে বিভিন্ন মনোবৈজ্ঞানিক কৌশল যেমন- রিলাক্সেশন, মাইন্ডফুলনেস, মেডিটেশনের ব্যবহারের উপযোগিতা গবেষণায় প্রমাণিত। অনেকেই মনে করেন মেডিটেশন বা রিলাক্সেশন মানেই লম্বা সময় ধ্যানে থাকা, যে কারণে অনেকে উৎসাহ হারান। আপনার জন্য উপযোগী করে পাঁচ মিনিট অনুশীলনের মাধ্যমেই শুরু করতে পারেন।

প্রত্যেক মানুষ ভিন্ন, তাই তাদের মানিয়ে নেওয়ার ক্ষমতাও ভিন্ন। সুতরাং নিজ থেকে মানসিক সুস্থতা নিশ্চিত করতে সামর্থ্য না হলে, একজন মানসিক সেবা প্রদানকারীর (সাইকিয়াট্রিস্ট, মনোবিজ্ঞানী ইত্যাদি) সহায়তা গ্রহণ করা প্রয়োজন। বর্তমানে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান ও ব্যক্তি বিনামূল্যে মোবাইলে বা অনলাইনে সেবা প্রদান করে এই ক্রান্তিকালে মানসিক সেবা অব্যাহত রেখেছেন।

লেখক: এমফিল গবেষক

ক্লিনিক্যাল সাইকোলজি, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

Logo

সম্পাদক ও প্রকাশক: ইলিয়াস উদ্দিন পলাশ

বার্তা ও বাণিজ্যিক কার্যালয়: ফেয়ার দিয়া ১১/৮/ই, ফ্রি স্কুল স্ট্রিট (লেভেল-৮), বক্স কালভার্ট রোড, পান্থপথ, ঢাকা ১২০৫