Logo
×

Follow Us

লাইফস্টাইল

নকার আপার্স: জীবন্ত এলার্ম ঘড়ি

Icon

এহতেশাম শোভন

প্রকাশ: ০৩ ডিসেম্বর ২০২৪, ১৪:৪৭

নকার আপার্স: জীবন্ত এলার্ম ঘড়ি

নকার আপার্স। ছবি: সংগৃহীত

জীবিকা নির্বাহের জন্য মানুষকে যুক্ত হতে হয় নানা পেশায়। কেউ করেন চাকরি, কেউবা ব্যবসা। তবে এর বাইরেও এমন কিছু পেশা রয়েছে, যা প্রথমে শুনতে অদ্ভুত লাগলেও অনেকের জন্য তা জীবিকার অবলম্বন। উদাহরণ হিসেবে ধরা যাক লাইনে দাঁড়িয়ে থাকা। আপনার কাছে যা বিরক্তিকর মনে হতে পারে, সেটি অনেকের কাছে লাভজনক। বিশেষত ব্যস্ত শহরে সিনেমার টিকিট, কনসার্টের পাস অথবা কোনো ডকুমেন্ট পেতে লাইনে দাঁড়িয়ে কাজটি করার জন্য মানুষ ভাড়া করে। এভাবেই আয় হয় হাজার হাজার টাকা। তেমনই এক মজার এবং এখন প্রায় বিলুপ্ত একটি পেশা নকার আপার্স।

যখন এলার্ম ঘড়ি আবিষ্কার হয়নি কিংবা সাধারণ মানুষের কেনার সাধ্য ছিল না, তখন মানুষকে ঘুম থেকে জাগিয়ে তোলার দায়িত্ব ছিল ‘নকার আপার্স’ নামক পেশাজীবীদের। তারা ছিলেন ভাড়া করা জীবন্ত এলার্ম ঘড়ি। জানালা বা দরজায় ঠক ঠক শব্দ করে অথবা লম্বা লাঠি দিয়ে জানালায় টোকা মেরে, মৃদু স্বরে ডেকে বলত, ‘উঠুন সাহেব, ভোর হয়ে গেছে।’

ঊনবিংশ ও বিংশ শতকের প্রথম দিকে ইংল্যান্ড ও আয়ারল্যান্ডে এই পেশার প্রচলন দেখা যায়। শিল্পবিপ্লবের পর কলকারখানাগুলোর দ্রুত বিকাশ ঘটে, যেখানে শ্রমিকদের সকাল সকাল কাজে পৌঁছানো ছিল বাধ্যতামূলক। ঠান্ডা আবহাওয়ায় সারা দিনের হাড়ভাঙা খাটুনির পর খুব ভোরে ঘুম থেকে ওঠা অনেকের জন্য অসম্ভব ছিল। সময়মতো না পৌঁছালে বেতন কাটা যেত বা চাকরি হারানোর ঝুঁকি ছিল। এই প্রয়োজনেই জন্ম নেয় ‘নকার আপার্স’ পেশার।  

নকার আপার্সরা সাধারণত ভোর ৫টা থেকে ৬টা পর্যন্ত কাজ করতেন। এদের হাতে থাকত লগির মতো লম্বা লাঠি, ফাঁপা পাইপ বা নরম হাতুড়ি। যারা দোতলায় ঘুমাতেন, তাদের জানালায় টোকা দেওয়া হতো। কেউ কেউ বাঁশির মতো পাইপে মটরদানার মতো ছোট কিছু রেখে জানালায় ছুড়ে মারতেন। দরজায় নরম শব্দ করে ধাক্কা দেওয়াও ছিল তাদের পদ্ধতির অংশ। আশপাশের অন্য লোকজনের ঘুম যেন না ভাঙে, সে বিষয়েও তাদের সচেতন থাকতে হতো।  

নকার আপার্সদের বেশির ভাগই ছিলেন বয়স্ক মানুষ, যারা ভারী কাজ করতে পারতেন না। কেউ কেউ পুরো রাত জেগে থেকে ভোরে অন্যদের ঘুম ভাঙাতেন এবং দিনের বেলা ঘুমাতেন। তাদের কাজের পারিশ্রমিক ছিল জনপ্রতি ছয় পেনি থেকে শুরু করে নির্দিষ্টসংখ্যক গ্রাহকের ভিত্তিতে।  

অনেকে মজার ছলে বলতেন, নকার আপার্স অন্যের ঘুম ভাঙায়, কিন্তু তাদের ঘুম কে ভাঙায়? এরা রাতে তেমন একটা ঘুমাতই না! কর্মীদের জাগানোর জন্য একজন নকার-আপার্সকে তাড়াতাড়ি ঘুম থেকে উঠতে হতো। বেশির ভাগ সময় সারা রাত জেগে ভোরে খদ্দেরদের জাগিয়ে তারপর নিজে শুতে যেতেন অনেকটা আমাদের দেশের বাজার, বাসাবাড়ি এলাকার নাইট গার্ডদের মতো। দিনভর ঘুমিয়ে বিকেলে আড়মোড়া ভাঙত।

উনিশ শতকের শেষ দিকে এবং বিশ শতকের মাঝামাঝি সময়ে সস্তা এলার্ম ঘড়ির সহজলভ্যতা এই পেশার চাহিদা কমিয়ে দেয়। ধীরে ধীরে নকার আপার্সরা কাজ হারিয়ে অন্য পেশায় চলে যান। ১৯৭০-এর দশক পর্যন্ত ইংল্যান্ডের কিছু অঞ্চলে এই পেশার অস্তিত্ব ছিল। মেরি স্মিথ নামের একজন নকার আপার্স ১৮৭০ সালে সপ্তাহে জনপ্রতি ছয় পেনি উপার্জন করতেন। এমনকি কিছু পুলিশ সদস্যও অতিরিক্ত আয়ের জন্য এ কাজ করতেন। তবে আধুনিক প্রযুক্তি এবং জীবনের সহজলভ্যতাই এই ঐতিহাসিক পেশাটিকে বিলুপ্ত করে দিয়েছে।  

নকার-আপার্স শুধু একটি পেশা নয়, এটি একটি ঐতিহাসিক নিদর্শন। এটি আমাদের স্মরণ করিয়ে দেয় মানুষ কীভাবে প্রয়োজন অনুযায়ী পেশা তৈরি করে এবং প্রযুক্তির সঙ্গে তাল মিলিয়ে পুরোনো পেশাগুলো ধীরে ধীরে হারিয়ে যায়। আজকের যুগে এটি একটি বিস্মৃত ইতিহাস হলেও শিল্পবিপ্লবের সময় এটি ছিল অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। নকার-আপার্সের কাজ শ্রমিকদের সময়মতো কাজে যাওয়ার নিশ্চয়তা দিত এবং অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড সচল রাখতে ভূমিকা রাখত।

Logo

সম্পাদক ও প্রকাশক: ইলিয়াস উদ্দিন পলাশ

বার্তা ও বাণিজ্যিক কার্যালয়: ফেয়ার দিয়া ১১/৮/ই, ফ্রি স্কুল স্ট্রিট (লেভেল-৮), বক্স কালভার্ট রোড, পান্থপথ, ঢাকা ১২০৫