
পর্বতারোহী। ছবি: সাম্প্রতিক দেশকাল
তুমি কেন পর্বতারোহণ কর? পর্বত চূড়ায় দাঁড়ানোর জন্য কেন বারবার এত ঝুঁকি নাও? গত এক দশক ধরে প্রতিনিয়ত এমন প্রশ্নের মুখোমুখি হতে হয়েছে আমাকে। প্রথম প্রথম কিংবদন্তি পর্বতারোহী জর্জ ম্যালরির ১৯২৩ সালে মাউন্ট এভারেস্ট অভিযানের আগে দেওয়া বিখ্যাত উক্তি ‘বিকজ ইট ইজ দেয়ার’ এর মতো করে উত্তর দেওয়ার চেষ্টা করতাম। একসময় উপলব্ধি করলাম, আমার উত্তর কাউকে সন্তুষ্ট করতে পারছে না। সত্যি বলতে হাড় কাঁপানো ঠান্ডায়, অক্সিজেনের অভাবে খাবি খেতে খেতে আমারও মনে হয়েছে কেন এলাম এখানে মরতে? ১৯ সেপ্টেম্বর ২০২২, তেমনই একটা দিন ছিল।
আমরা ছিলাম পশ্চিম হিমালয়ের মারখা উপত্যকায়, যা লাদাখের হেমিস জাতীয় উদ্যানে অবস্থিত। হিমালয় ও কারাকোরামের মাঝে হিমশীতল এক মরুভূমি। উঁচু উঁচু চূড়ার পাশাপাশি মনোমুগ্ধকর ভূদৃশ্য ছিল অভিযানের জন্য হিমালয়ের এই অংশটি বেছে নেওয়ার কারণ। এই অঞ্চলের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে থাকা তিব্বতীয় সংস্কৃতি ছিল আমাদের জন্য বাড়তি পাওয়া।
‘গোযায়ান এক্সপিডিশন লাদাখ’ শিরোনামে মাত্র ১০ দিনে হিমালয়ের চারটি পর্বত চূড়ায় আরোহণের কঠিন এক পরিকল্পনা নেই আমি ও আমার সঙ্গী ইমরান। চূড়াগুলো হলো কাং ইয়াতসে-২ (ছয় হাজার ২৫৪ মিটার), জো জঙ্গো ইস্ট (ছয় হাজার ২১৪ মিটার), রিগিওনি মাল্লাই রি-১ (ছয় হাজার ১২০ মিটার) ও কঙ্গা রি (পাঁচ হাজার ৭৫৫ মিটার)।
৪ সেপ্টেম্বর হিমালয়ের উদ্দেশে আমরা ঢাকা ছাড়ি। পরদিন লাদাখের রাজধানী লেহতে পৌঁছাই। প্রয়োজনীয় অনুমতিপত্র ও সাজ-সরঞ্জাম সংগ্রহ করে ৮ সেপ্টেম্বর ট্রেক শুরু করি। দুই দিন পর ১০ সেপ্টেম্বর কাং ইয়াতসে-২ পর্বতের বেস ক্যাম্পে পৌঁছাই।
এরপর ১২ সেপ্টেম্বর মধ্যরাতে প্রথম চূড়ার উদ্দেশে যাত্রা শুরু করি। দুপুর ১২টায় সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে ছয় হাজার ২৫৪ মিটার উঁচুতে কাং ইয়াতসে-২-এর চূড়ায় পৌঁছানোর মধ্য দিয়ে অভিযানের শুভ সূচনা হয়। বেস ক্যাম্প রিগিওনি মাল্লাই রিতে সরিয়ে ১৫ সেপ্টেম্বর মধ্যরাতে দ্বিতীয় চূড়ায় আরোহণ শুরু করি। ১২ ঘণ্টা পর পর্বতের চূড়ায় পৌঁছাই।
প্রথম দুটি লক্ষ্য অনায়াসে অর্জিত হওয়ায় আমাদের আত্মবিশ্বাস তখন তুঙ্গে। পরবর্তী লক্ষ্য ছয় হাজার ২১৪ মিটার উচ্চতার অসম্ভব সুন্দর চূড়া জো-জঙ্গো। এতে আরোহণের জন্য ১৮ সেপ্টেম্বর আমরা
তৃতীয় বেসক্যাম্প স্থাপন করি। উত্তেজনায় ঘুমাতে পারছিলাম না। এই চূড়াতেও যদি আরোহণ করতে পারি তাহলে এক সপ্তাহের মধ্যে হিমালয়ের তিনটি ছয় হাজার মিটার চূড়ায় আরোহণের বিরল নজির স্থাপন করতে পারব। অস্থিরচিত্তেই মাঝ রাতে হিম ঠান্ডায় আমরা সামিট পুশের জন্য বেরিয়ে পড়ি। একবারও বিশ্রাম না নিয়ে মাত্র তিন ঘণ্টায় পাঁচ হাজার ৫০০ মিটার পর্যন্ত পৌঁছে গেলাম।
নিমালিং চু নদীর পারে যখন এসে পৌঁছাই তখন সূর্য উঠে গেছে। কালো হিম রাতের পর সোনালি রোদের মিষ্টি উষ্ণতা আমাদের মনকে সান্ত¦না দিতে পারল না। নদীর পারে বসে জিড়িয়ে নেওয়ার ফাঁকে ব্যাকপ্যাক থেকে ফ্ল্যাক্স বের করে চায়ে চুমুক দিলাম। চা শেষ করে উঠতেই ইমরান প্রস্তাব দিল, ‘জো-জঙ্গ হয়নি যখন চল কঙ্গা রি (পাঁচ হাজার ৭৫৫ মিটার) যাই। এটা কাছেই আছে, বিকেলের মধ্যেই আবার ক্যাম্পে চলে আসব।’
নতুন উদ্যমে আমরা পথ চলা শুরু করলাম। দেখতে না দেখতেই আমরা নদী পেরিয়ে গিরি শিরা ধরে আরোহণ শুরু করলাম। ইমরান দুপুরে কঙ্গা রি সামিট করল। আমি এর আগেই চূড়ায় পৌঁছে গিয়েছিলাম। যখন আমরা বেস ক্যাম্পে ফিরে এলাম, তখন ঘড়িতে বিকেল ৩টাও বাজেনি। ঘন ডাল ভাত দিয়ে খাবার খেয়ে ক্লান্ত শরীরকে স্লিপিং ব্যাগের উষ্ণতায় সঁপে দিলাম।
সূর্যাস্তের পর অন্ধকার নেমে আসতে অস্থির লাগা শুরু হলো। সেই একই প্রশ্ন ঘুরে-ফিরে মনে জাগতে লাগল, আমাদের কি আবার জো জঙ্গো আরোহণের চেষ্টা করা উচিত? ইমরানের পায়ের আঙুল ঠিক হয়ে গেছে। কিন্তু যদি চেষ্টা করি, তাহলে বাড়ি ফেরার ফ্লাইট ধরার জন্য আমরা কি সময়মতো লেহতে ফিরতে পারব? সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ, আমাদের মধ্যে কি একবারও ছয় হাজারি চূড়া আরোহণের জন্য যথেষ্ট শক্তি অবশিষ্ট আছে? এদিকে বিকেলের পর থেকে আবার তুষারপাত শুরু হয়েছে। রাতে থাকবে কি না কে বলতে পারে?
তখন একটা পাগলাটে ধারণা এলো : যদি আমরা সূর্যোদয়ের পর পর চূড়া আরোহণের চেষ্টা শুরু করি, তাহলে আমরা রাতের ঠান্ডা এড়িয়ে চলতে পারব এবং দিনের আলোতে দ্রুত চলতে পারব। কিন্তু কেউ এত দেরিতে হিমালয়ের চূড়া আরোহণের চেষ্টা শুরু করে না। সূর্যের আলোতে, গলে যাওয়া হিমবাহ এবং আলগা পাথর রাস্তাকে আরো কঠিন এবং ঝুঁকিপূর্ণ করে তুলবে। অনেক প্রশ্ন জাগছিল মনে, কিন্তু কোনো উত্তর আমাদের কাছে ছিল না।
আমাদের অভিযানের ভাগ্য একটা সুতোয় ঝুলছিল এবং আমি কঠিন সিদ্ধান্তটি নিয়ে নিলাম। রাত ১০টার দিকে ইমরানকে জানালাম জো জঙ্গো আরেকবার চেষ্টা করতে চাই। কিন্তু এবার সামিট পুশ মাঝ রাতের জায়গায় সূর্যোদয়ের পর শুরু করব। নিমিষে মন হালকা হয়ে গেল। বিশ্বাস করুন, ওই রাতে অভিযানের সেরা ঘুমটি ঘুমিয়েছিলাম।
ভোর ৬টায় কড়া কালো কফির তিতকুটে স্বাদ নিয়ে আবারও যাত্রা শুরু করলাম। তিন ঘণ্টায় কোনো রকম ক্লান্ত না হয়েই আমরা হিমবাহের মুখে পৌঁছে গেলাম। কিন্তু তারপরই চরম বিস্ময়ে তাকিয়ে দেখলাম আমরা ভুল হিমবাহে চলে এসেছি।
খুব কষ্ট হচ্ছিল। আরেকটা প্রচেষ্টা ব্যর্থ! উত্তেজিত স্নায়ু শান্ত করার জন্য সেখানে প্রায় আধঘণ্টা বসেছিলাম। এরপর আবারও সেই একই প্রশ্ন, আমাদের কি এখন ফিরে যাওয়া উচিত? তারপরই দমকা বাতাসে আকাশের মেঘগুলো সরে গেল, উঁকি দিল জো- জঙ্গো। পাঁচ বছর ধরে এই চূড়াটির স্বপ্ন আমাকে তাড়িয়ে বেড়াচ্ছে। চূড়াটি দেখার পর সিদ্ধান্ত নেওয়াটা সহজ হয়ে গেল। ইমরানকে বললাম, ‘যদি দ্রুত চলি, তাহলে আমরা সূর্যাস্তের আগে চূড়ায় পৌঁছতে পারব। ইমরানও নিশ্চয়ই এমন কিছুই ভাবছিল। ওর কোনো প্ররোচনার প্রয়োজন ছিল না। আমরা আবার চূড়ার দিকে যাত্রা শুরু করলাম।
কাজটি মোটেও সহজ ছিল না। দুটি হিমবাহ পার হতে হবে আমাদের। প্রথম হিমবাহটি ছোট এবং ঢাল তুলনামূলকভাবে সহজ ছিল। আমরা ক্র্যাম্পন (বরফ-জুতা) পরে পূর্ব ঢালে পৌঁছানোর জন্য হিমবাহটি অতিক্রম করলাম। তারপর দ্বিতীয় হিমবাহে নেমে গেলাম। এটা বিশাল এবং অদৃশ্য ফাটলে পরিপূর্ণ।
ইমরান আমাকে অনুসরণ করছিল। একটা কঠিন আরোহণের পর আমি শৈলশিরায় পৌঁছতে সক্ষম হলাম এবং সামিট রিজ ধরে আরোহণ শুরু করলাম।
প্রবল বাতাসকে উপেক্ষা করে পুরো শৈলশিরাজুড়ে পাথরের বিশাল বিশাল খণ্ড একটির ওপর আরেকটি স্তূপ হয়েছিল, যা চূড়াকে আরো চ্যালেঞ্জিং করে তুলেছিল।
অবশেষে বিকেল সাড়ে ৪টার দিকে, আমরা জো-জঙ্গো আরোহণ করতে সক্ষম হলাম। অন্যান্য হিমালয়ের চূড়ার মতো ওপর থেকে দৃশ্যটা ছিল মোহনীয়। আকাশকে সিঁদুর রঙে রাঙিয়ে দিয়ে সূর্য তখন অস্তাচলে পাড়ি দিচ্ছিল। কিন্তু এমন মন্ত্রমুগ্ধকর দৃশ্য বেশি সময় উপভোগের সুযোগ হলো না। আমাদের দ্রুত নেমে যেতে হবে, কারণ আবহাওয়া খারাপের ইঙ্গিত দিচ্ছিল।
কিন্তু আবহাওয়া প্রত্যাশার চেয়ে তাড়াতাড়ি খারাপ হয়ে গেল। প্রবল তুষারপাত শুরু হলো এবং কয়েক মিনিটের মধ্যে দৃষ্টিসীমা মাত্র ১০ ফুটে নেমে গেল। ঝোড়ো বাতাস আর তুষারপাতের মধ্যে হেডল্যাম্প জ্বালিয়ে একজন আরেকজনকে অনুসরণ করে নামতে লাগলাম। শরীরের শেষ শক্তিটুকু নিংড়ে দিয়ে মধ্যরাতে যখন তাঁবুর আশ্রয়ে ফিরলাম, নিজেদের ভাগ্যবান মনে হচ্ছিল। স্লিপিং ব্যাগের উষ্ণতায় শুয়ে ভাবছিলাম, মনে এখন যে তৃপ্তি আর প্রশান্তির অনুভূতি জেগে উঠেছে- এর জন্যই তো পর্বতের সান্নিধ্যে আসি বারবার।