
পাহাড়ের মাঝামাঝি একটুখানি ঢালু জায়গা।
একে তো রোজা, তার ওপর রোজ সকালে ঢাকার ধুলাবালি শরীরে মেখে খানিকটা ফুসফুসে ভরে, লোকাল বাসে ঝুলে অফিসে যেতে যেতে হাঁপিয়ে উঠেছিলাম। তাই ঠিক করে রেখেছিলাম, ঈদের ছুটিতে বাড়ি গেলে পাহাড়ে একটা বিকেল কাটাতে হবে। এর মধ্যে ঠিক হলো ঈদের পরদিন মিরসরাইতে আমার সঙ্গে যুক্ত হবেন জাহাঙ্গীর ভাই। তিনি বায়না ধরলেন, বিকেল তো কাটাবোই, সেই সঙ্গে দুপুরে খাওয়াদাওয়া করা চাই পাহাড়ে! এ তো লঙ্কাকাণ্ড। বহর তো বেশ বড়! এখন উপায়? বরাবরের মতোই এমন পরিস্থিতিতে ত্রাতার ভূমিকায় অবতীর্ণ হলেন আমাদের ব্রিগেড কমান্ডার জাবেদ ভাই। ইকবাল ভাইও অভয় দিলেন।
কথামতো ঈদের পরদিন ঢাকা থেকে চলে এলেন জাহাঙ্গীর ভাই। ঠিক হলো ঈদের তৃতীয় দিন আমরা পাহাড়ে যাচ্ছি। আর জাবেদ ভাইয়ের বাড়িতে রান্না করা হবে। নির্দিষ্ট দিনে সকাল থেকে জাবেদ ভাইয়ের বাড়ির আঙিনায় শুরু হলো রান্নার তোড়জোড়। জাবেদ ভাই নিজেই নেমে পড়লেন মিশনে, আর বাকিটা আনু আপা এসে বাঁচিয়ে দিলেন। ইকবাল ভাই আর জাহাঙ্গীর ভাই চলে গেলেন চরে, তরমুজ ক্ষেতের দিকে। ফিরলেন এক বিশাল তরমুজ নিয়ে। রান্না শেষে খাবার, পানিসহ আনু আপা ও তার ছেলে এবং জিয়া ভাইকে একটি সিএনজিতে তুলে দিয়ে ইকবাল ভাই, জাবেদ ভাই, বাহার ভাই, জাহাঙ্গীর ভাই এবং আমি তিনটি মোটরসাইকেলে চেপে ছুটে চললাম পাহাড়ের দিকে।
মিরসরাই থেকে যে রাস্তাটি পাহাড়ের মাঝ দিয়ে ফটিকছড়ির দিকে চলে গেছে, অপরূপ সে রাস্তাধরে আমরা চলতে থাকলাম। বেশ খানিকটা সময় পথ চলার পর একটা পাহাড়ের ধারে এসে থামলাম। জিয়া ভাই পাহাড়টি ভালোভাবে চেনেন। একটু ভেতরের দিকে যেতেই দুই পাহাড়ের মাঝামাঝি একটুখানি ঢালু জায়গা পাওয়া গেল। সেখানে মাদুর বিছিয়ে বসে পড়লাম। জাবেদ ভাই, বাহার ভাই আর আনু আপা খাড়া পাহাড় বেয়ে নিচে গেলেন লেবু আনতে। লেবু বাগানটি আমাদের ভ্রমণসঙ্গী রানা ভাইয়ের। আমি আবার রাস্তার দিকে ফিরে গেলাম মেহেদী ভাই ও তার বন্ধুদের পথ চিনিয়ে আনতে। তারা এসে গেলে, দুপুর দেড়টার দিকে খেতে বসলাম। ঝামেলা কমাতে বিরিয়ানি রান্না করেছিলেন আনু আপা। একে তো গরম, তার ওপর বিরিয়ানির মতো ভারী খাবার! সবার হাসফাস অবস্থা।
খাওয়া শেষে ইকবাল ভাই, জাবেদ ভাই, আনু আপারা মাদুরে বসে খোশগল্পে মেতে উঠলেন। আমি আর জিয়া ভাই ঠিক করলাম দূরের ঝিরিতে যাব। জাবেদ ভাই বললেন, পারবে না, অনেক দূরের পথ এবং খাড়া পাহাড়। একটা পানির বোতল হাতে নিয়ে বললাম, পানি নিয়ে ফিরব। পথঘাট কিছু চিনি না, কতদূর তাও জানি না। জিয়া ভাই সবটা চেনেন। চলতে শুরু করলাম। খাড়া পাহাড় বেয়ে নামতে-উঠতে হচ্ছিল। আশপাশে বেশ মোটা লতাগাছ, আমি খুব সাবধানে ধীরে ধীরে নামছিলাম। অবাক হয়ে দেখি, মোটা লতাগুলো ধরে জিয়া ভাই লাফিয়ে লাফিয়ে নামছিলেন- যেন সিনেমার কোনো দৃশ্য।
দুটি পাহাড় পেরোনোর পর হলুদ রঙের মিষ্টি কুমড়োর আকৃতির একটা ফল দেখালেন জিয়া ভাই, কেন জানি সেটা ছিঁড়ে সঙ্গে নিলাম। আরেকটু দূরে গাছভর্তি বেশ বড় বড় ডুমুর ফল দেখতে পেলাম। তিনটি ডুমুর সঙ্গে নিলাম সবাইকে দেখাব বলে। তারপর আবার ছুটতে শুরু করলাম। তিনটি পাহাড় পেরিয়ে অবশেষে ঝিরির দেখা পেলাম। মুখে ঠান্ডা পানির ঝাপটা মেরে দ্রুত বোতলে পানি ভরে ফিরতি পথ ধরলাম। সূর্যের আলো কমে যাচ্ছে দ্রুত। ফল আর পানি হাতে নিয়ে চলতে বেশ সমস্যা হচ্ছিল। ফিরতে ফিরতে দেখি, সব গুছিয়ে বাড়ি ফিরে যেতে প্রস্তুত বাকিরা!
ইকবাল ভাই বললেন, ‘বলতে ভুলে গিয়েছিলাম, যেখানে আপনারা গেলেন সেখানে অজগরের বেশ আনাগোনার খবর পাওয়া যায়। তাই দুশ্চিন্তায় ছিলাম।’ নাম না জানা ফলটার নাম উদ্ধারে আলোচনার এক পর্যায়ে ইকবাল ভাই বললেন, ‘যেহেতু নাম পাওয়া যাচ্ছে না, তাহলে এটা চির-যৌবনা ফল।’ জাবেদ ভাইয়ের হাতে ফলটা তুলে দিয়ে বললাম, ‘এই নিন, আপনার বয়সটা যেন পঞ্চাশ থেকে একটুও না বাড়ে এবং একটুও না কমে!’