
বহুজাতিক এক প্রতিষ্ঠানে কাজ করতেন সুমি আক্তার (ছদ্মনাম)। শুরুতে সহকর্মীরা তাকে সহযোগিতা করলেও ধীরে ধীরে পরিস্থিতি বদলাতে থাকে। তার কাজ নিয়ে ব্যঙ্গ, ছোটখাটো ভুলকে বড় করে দেখানো, মিটিংয়ে সবার সামনে অবমূল্যায়ন-সবকিছু যেন তার দৈনন্দিন জীবনের অংশ হয়ে গিয়েছিল। ‘প্রতিদিন সকালে অফিসে যাওয়ার সময় মনে হতো আমি যুদ্ধক্ষেত্রে যাচ্ছি’, বলেন তিনি। শেষ পর্যন্ত মানসিক চাপে চাকরি ছেড়ে দিতে বাধ্য হন সুমি। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, কর্মক্ষেত্রে বুলিং হলো এক ধরনের অদৃশ্য সহিংসতা। এ ধরনের মানসিক সহিংসতা কর্মীদের আত্মবিশ্বাস ভেঙে দেয়, কর্মপরিবেশকে বিষাক্ত করে তোলে।
কেন ঘটে বুলিং : বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই বুলিংয়ের অন্যতম কারণ ক্ষমতার ভারসাম্যহীনতা। কোনো ব্যক্তি বা গ্রুপ যদি মনে করে তারা অন্যদের চেয়ে শক্তিশালী, তখনই তারা প্রভাব খাটাতে শুরু করে। প্রাতিষ্ঠানিক ব্যবস্থাপনা যদি দুর্বল হয়, নেতৃত্ব শিথিল থাকে, তখনই বুলিংয়ের পরিবেশ সৃষ্টি হয়। কখনো কখনো প্রতিযোগিতা, ব্যক্তিগত হিংসা কিংবা পক্ষপাতিত্বও এর পেছনে কারণ হয়ে দাঁড়ায়।
কেমন হয় কর্মক্ষেত্রের বুলিং : সহকর্মী বা ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের অবিরাম সমালোচনা বা অপমান, কাজের স্বীকৃতি না দেওয়া, ইচ্ছাকৃতভাবে অবমূল্যায়ন করা, অযথা বাড়তি চাপ সৃষ্টি করা, কাজে অযথা বাধা দেওয়া, অপ্রয়োজনীয় সমালোচনা, মিটিংয়ে ইচ্ছা করে কাউকে এড়িয়ে যাওয়া বা টিমের সবার সামনে ছোট করা। এই ছোট ছোট আচরণ মিলেই তৈরি করে এক ভয়ংকর পরিবেশ। কারো আইডিয়া বারবার প্রত্যাখ্যান করা, অনেক সময় সিনিয়রদের অতিরিক্ত নিয়ন্ত্রণমূলক আচরণ বা সহকর্মীর হিংসা এই বুলিংয়ের পেছনে কাজ করে। আবার কখনো মজা বা ঠাট্টার ছলে বলা কথাও গভীর মানসিক ক্ষত তৈরি করে। এই আচরণগুলো প্রথমে ছোট মনে হলেও দীর্ঘ মেয়াদে ভুক্তভোগীর জীবনে ভয়াবহ প্রভাব ফেলে। শুধু ভুক্তভোগীর ওপরই নয়, পুরো প্রতিষ্ঠানের কর্মদক্ষতা নষ্ট করে। যারা বুলিংয়ের শিকার হন তারা কাজে মনোযোগ হারান, সৃজনশীলতা কমে যায়।
নীরবতা কেন : অধিকাংশ ভুক্তভোগী চুপ থাকেন। এর পেছনে থাকে চাকরি হারানোর ভয়, প্রমাণের অভাব বা ‘সমস্যাটা ছোট’ ভেবে এড়িয়ে যাওয়ার প্রবণতা। তবে নীরবতা সমস্যাকে আরো জটিল করে তোলে। অফিসে বুলিংয়ের শিকার ব্যক্তিরা প্রথমেই যে সমস্যায় পড়েন, তা হলোÑকথা বলার সাহস হারিয়ে ফেলা। তারা ভাবেন, অভিযোগ করলে হয়তো চাকরি চলে যাবে, বা সহকর্মীরা নেতিবাচকভাবে নেবে। ফলে তারা ভেতরে ভেতরে একা হয়ে পড়েন। ধীরে ধীরে কমে যায় আত্মবিশ্বাস, তৈরি হয় হতাশা, উদ্বিগ্নতা এমনকি বিষণ্নতা। অনেক ক্ষেত্রে ঘুমের সমস্যা, শারীরিক অসুস্থতাও দেখা দেয়।
প্রতিরোধের উপায় : অফিসে বুলিং বন্ধ করতে হলে প্রথমেই দরকার সচেতনতা। প্রতিষ্ঠানকে বুঝতে হবে, এটি কোনো ব্যক্তিগত বিষয় নয়, বরং কর্মস্থলের নিরাপত্তা ও উৎপাদনশীলতার সঙ্গে যুক্ত। এ জন্য প্রতিটি প্রতিষ্ঠানের উচিত বুলিংবিরোধী নীতি প্রণয়ন করা, যেখানে শাস্তির বিধানও থাকবে; ভুক্তভোগীরা যেন নিরাপদে অভিযোগ জানাতে পারেন, সে ব্যবস্থা করতে হবে; ম্যানেজার ও কর্মীদের নিয়মিত প্রশিক্ষণ দিতে হবে, যাতে তারা বুলিং চিহ্নিত করতে ও প্রতিরোধ করতে পারেন; কাউন্সেলিং বা সাপোর্ট সিস্টেমের ব্যবস্থা করতে হবে।
কর্মস্থল চাই মানবিক : অফিস শুধু কাজের জায়গা না, এটি প্রতিদিনের জীবনের বড় একটি অংশ। এখানে যদি কেউ বারবার হেয় হতে থাকে, তবে সে ভেতরে ভেতরে ভেঙে পড়ে, যা জীবনের অন্য ক্ষেত্রেও প্রভাব ফেলে। তাই বুলিং প্রতিরোধ মানে শুধু একটি ব্যক্তিকে বাঁচানো নয়, বরং পুরো কর্মক্ষেত্রকে সুস্থ ও মানবিক রাখা।