
প্রতীকী ছবি
করোনাভাইরাস সংক্রমণ ছড়িয়ে পড়ার প্রথম দিকে বলা হয়েছিল, কোভিড সংক্রমণের ফলে শতকরা ৯০ জনের ক্ষেত্রেই জ্বর, কাশি, স্বাদ-গন্ধ না পাওয়ার মতো মৃদু অসুস্থতা দেখা দেয়- যা সপ্তাহ দুয়েকের মধ্যেই সেরে যায়।
শুধুমাত্র যাদের ওজন বেশি, বা যাদের ডায়াবেটিস, অ্যাজমা, হৃদরোগ ইত্যাদির মতো কোনো স্বাস্থ্য সমস্যা আগে থেকেই আছে- তাদের জন্যই এটি বিপদ বা মৃত্যুঝুঁকির কারণ।
কিন্তু কিছুদিন পরেই দেখা যায়, করোনা সংক্রমিতদের অনেকের জ্বর-কাশির মতো উপসর্গগুলো সেরে গেলেও তারা পুরোপুরি সুস্থ হতে পারছেন না। তাদের ফুসফুসের গুরুতর ক্ষতি হয়ে গেছে, অবসন্নতা ও বুক ধড়ফড়ানি দেখা দিচ্ছে, স্মৃতিশক্তি কমে গেছে, অনেকে এতটাই দুর্বল হয়ে পড়েছেন যে হাঁটাচলা পর্যন্ত করতে পারছেন না। স্বাভাবিক অবস্থায় ফেরত আসতে তাদের মাসের পর মাস সময় লাগছে, কাউকে কাউকে ফিজিওথেরাপি নিতে হচ্ছে।
ধীরে ধীরে বিজ্ঞানীদের কাছে এটা স্পষ্ট হলো যে, এগুলো আসলে করোনা সংক্রমণেরই দীর্ঘমেয়াদি প্রতিক্রিয়া। আর তখন থেকেই এই লং কোভিড কথাটা চালু হয়ে গেল। যতই দিন যাচ্ছে ততই এটা আরো স্পষ্ট হচ্ছে যে যারা করোনা আক্রান্ত হচ্ছেন তাদের অনেকের মধ্যেই লং কোভিড সমস্যা দেখা যাচ্ছে।
যারা প্রথম দফা ভাইরাস সংক্রমণে খুব একটা অসুস্থ হননি, তাদের মধ্যেও লং কোভিড হতে দেখা যাচ্ছে। অনেকে আশংকা করছেন, যারা টিকা নেননি বা মাত্র এক ডোজ টিকা নিয়েছেন- তাদের মধ্যে বড় মাত্রায় লং কোভিড দেখা দিতে পারে।
লং কোভিডের লক্ষণ
যুক্তরাজ্যের স্বাস্থ্য নির্দেশিকা অনুযায়ী, কেউ যদি করোনাভাইরাস সংক্রমণের পর- তা গুরুতর বা মৃদু যাই হোক না কেন - ১২ সপ্তাহ পার হয়ে গেলেও যদি রোগীর দেহে এমন অসুস্থতার লক্ষণ রয়ে যায়, যার কারণ হিসেবে অন্য কোন ব্যাখ্যা পাওয়া যাচ্ছে না, তাহলে ধরে নিতে হবে তার ‘লং কোভিড’ হয়েছে।
ব্রিটেনের জাতীয় স্বাস্থ্য সেবার তথ্য অনুযায়ী লক্ষণগুলো হচ্ছে:
১. চরম ক্লান্তি বা অবসন্নতা।
২. শ্বাস নিতে কষ্ট বা হাঁপিয়ে ওঠা, হৃৎপিণ্ডের ঘন ঘন স্পন্দন বা বুক ধড়ফড় করা, বুকে ব্যথা বা টানটান ভাব।
৩. স্মৃতি শক্তি বা মনঃসংযোগের সমস্যা - যাকে বলা হয় 'ব্রেন ফগ' বা বোধশক্তি ঝাপসা হয়ে যাওয়া।
৪. স্বাদ ও গন্ধের অনুভূতিতে পরিবর্তন।
৫. হাড়ের জোড়ায় ব্যথা।
বিভিন্ন জরিপে রোগীদের কাছ থেকে পাওয়া তথ্য অনুযায়ী এই লং কোভিডের এ রকম শত শত লক্ষণ ও নানা অসুস্থতার অভিযোগ তালিকাভুক্ত হয়েছে। তবে এ ব্যাপারে এখন পর্যন্ত বৃহত্তম জরিপটি চালিয়েছে ইউনিভার্সিটি কলেজ লন্ডন (ইউসিএল) এবং তারা লং কোভিডে আক্রান্ত লোকদের ১০টি প্রত্যঙ্গে আঘাত হানে এরকম ২০০টি লক্ষণ চিহ্নিত করেছেন।
দেখা গেছে, যারা করোনা সংক্রমণের পর পুরোপুরি সেরে উঠেছেন তাদের চাইতে লং কোভিডে আক্রান্ত রোগীদের মধ্যেই এসব লক্ষণ বেশি দেখা গেছে।
এসব লক্ষণের মধ্যে আছে হ্যালুসিনেশন বা দৃষ্টিবিভ্রম, নিদ্রাহীনতা বা ইনসমনিয়া, শ্রবণ ও দৃষ্টিশক্তির পরিবর্তন, স্বল্প মেয়াদী স্মৃতি লোপ, কথা বলা ও ভাষার ক্ষেত্রে নানা সমস্যা দেখা দেয়া। অনেকের ক্ষেত্রে পরিপাকতন্ত্র ও মূত্রাশয়ের সমস্যা দেখা দিয়েছে। নারীদের ক্ষেত্রে ঋতুস্রাব ও ত্বকের অবস্থায় পরিবর্তন দেখা গেছে।
এসব লক্ষণ কতটা গুরুতর হবে তা একেক রোগীর ক্ষেত্রে একেক রকম। তবে অনেকের ক্ষেত্রে দেখা গেছে যে লং কোভিডের কারণে তারা গোছল করা, দোকানে গিয়ে জিনিসপত্র কেনা বা কথা মনে রাখার মতো কাজকর্ম করতে অক্ষম হয়ে পড়েছেন।
আইসিইউতে থাকা রোগীরাই লং কোভিডে ভুগেন তা নয়। যারা করোনাভাইরাস সংক্রমণের পর সামান্য অসুস্থ হয়েছেন তাদেরও এটা হয়ে থাকে এবং বর্তমানে ব্রিটেনে তরুণদের মধ্যে লং কোভিড আক্রান্তের হার নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করছেন বিশেষজ্ঞরা।
লং কোভিডের কারণ কী?
এ ব্যাপারে এখনো সবকিছু নিশ্চিতভাবে জানেন না বিজ্ঞানীরা। একটা সম্ভাব্য কারণের কথা বলা হচ্ছে। তাহলো- করোনাভাইরাস সংক্রমণ হলে তা ঠেকানোর জন্য কিছু লোকের ক্ষেত্রে তাদের রোগ-প্রতিরোধ ব্যবস্থা বা ইমিউন সিস্টেম অতিমাত্রায় সক্রিয় হয়ে ওঠে। তা তখন শুধু ভাইরাসকে নয়, দেহের নিজস্ব টিস্যুকেও আক্রমণ করে।
ব্রেন ফগ বা পরিষ্কারভাবে চিন্তার ক্ষমতা হ্রাস পাওয়া বা স্বাদ-গন্ধ হারানোর মতো কিছু লক্ষণের ব্যাখ্যা হিসেবে বলা হচ্ছে, করোনা যখন মানব দেহকোষের ভেতরে ঢুকে পড়ে তার ক্ষতি করতে থাকে - তখন এটা ঘটতে পারে।
অন্যদিকে ভাইরাস সংক্রমণে দেহের রক্তবাহী নালীগুলো ক্ষতিগ্রস্ত হলে হৃৎপিণ্ড, ফুসফুস ও মস্তিষ্কের সমস্যা ঘটতে পারে।
অন্য আরেকটি তত্ত্বে বলা হচ্ছে, আক্রান্ত ব্যক্তির শরীরে ভাইরাসটির কিছু ক্ষুদ্র অংশ রয়ে যেতে পারে, হয়তো তা সুপ্ত অবস্থায় থাকে এবং পরে সক্রিয় হয়ে ওঠে। হার্পিস ও এপস্টাইন বার ভাইরাসের ক্ষেত্রে এমনটা হয়ে থাকে যাতে বিভিন্ন গ্রন্থির জ্বর দেখা দেয়। তবে করোনার ক্ষেত্রে এমনটা হচ্ছে বলে খুব বেশি প্রমাণ এখনো পাওয়া যায়নি।
এমনও হতে পারে বিভিন্ন লোকের ক্ষেত্রে বিভিন্ন কারণে লং কোভিড হচ্ছে - যে কারণে এর এত বিচিত্র রকম উপসর্গ দেখা যাচ্ছে।
কারা ঝুঁকিতে
এটাও এখনো সুনির্দিষ্টভাবে চিহ্নিত করা কঠিন। কারণ ডাক্তাররা সবেমাত্র লং কোভিডকে একটি রোগলক্ষণ হিসেবে আনুষ্ঠানিকভাবে চিহ্নিত করেছেন। তবে এ পর্যন্ত যতটুকু গবেষণা হয়েছে তাতে জোরালো আভাস পাওয়া যায় যে - রোগীর বয়স বেশি হলে লং কোভিডের সম্ভাবনা বাড়ে এবং পুরুষদের তুলনায় নারীদের মধ্যে লং কোভিড হচ্ছে দ্বিগুণ বেশি পরিমাণে।
যারা করোনায় গুরুতর অসুস্থ হয়েছিলেন বা যাদের হাসপাতালে যেতে হয়েছিল- তাদের মধ্যে লং কোভিডের কিছু লক্ষণ বেশি দেখা গেছে, তবে সব ক্ষেত্রে নয়।
বেশ কিছু জরিপ ও স্বাস্থ্যসম্পর্কিত উপাত্ত বিশ্লেষণ করেছে লন্ডনের কিংস কলেজ। এতে দেখা যাচ্ছে, যাদের বয়স বিশের কোঠায় এবং করোনাভাইরাস সংক্রমণ হয়েছে - তাদের ১ থেকে ২ শতাংশের লং কোভিড হতে পারে। অন্যদিকে যাদের বয়স ৬০-এর কোঠায় তাদের ক্ষেত্রে এ সম্ভাবনা ৫ শতাংশ।
তবে ইউনিভার্সিটি অব এক্সেটার মেডিকেল স্কুলের ড. ডেভিড স্ট্রেইন বলছেন, তার ক্লিনিকে যারা লং কোভিড নিয়ে এসেছে তাদের বেশিরভাগের বয়স ২০, ৩০ বা ৪০এর কোঠায়। হয়তো এর কারণ হলো- লং কোভিড তাদের জীবনের ওপর প্রভাব ফেলছে বয়স্কদের তুলনায় বেশি।
লং কোভিড হলে কিভাবে জানা যাবে
লং কোভিড ধরার কোন ডাক্তারি পরীক্ষা এখনো নেই। কারো লং কোভিড হয়েছে কিনা - তা ডাক্তাররা এখনো নিরূপণ করছেন এভাবে - যখন অন্য আর কোনো কারণ খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না, তখনই ধরে নেয়া হচ্ছে যে তার লং কোভিড হয়েছে। এ সিদ্ধান্তে পৌঁছানোর আগে ডাক্তাররা রোগীর ডায়াবেটিস, থাইরয়েডের কার্যকারিতা, আয়রনের অভাব ইত্যাদি সমস্যা আছে কিনা - তা টেস্টের মাধ্যমে নিশ্চিত হয়ে নেবেন।
গবেষকরা বলছেন, ভবিষ্যতে হয়তো লং কোভিড শনাক্ত করার জন্য কোনো এক ধরণের রক্ত পরীক্ষা চালু হতে পারে। দেহের কোনো প্রত্যঙ্গের ক্ষতি হয়েছে কিনা তা চিহ্নিত করার কিছু অত্যাধুনিক যন্ত্রপাতি এখনো শুধু গবেষকদের ল্যাবরেটরিতেই ব্যবহৃত হয় - তা হাসপাতালে থাকে না।
টিকা নিলে কি কোনো কাজ হবে
লং কোভিডে আক্রান্ত হবার পর যারা টিকা নিয়েছেন - তাদের প্রায় অর্ধেকের ক্ষেত্রে দেখা গেছে যে তাদের অবস্থার উন্নতি হয়েছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সম্ভবত টিকা নেবার পর তাদের দেহের রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থা বা ইমিউন সিস্টেম আগের অবস্থায় ফিরে এসেছে এবং তার ফলে শরীরে করোনার কোনো ক্ষুদ্র টুকরো রয়ে গিয়ে থাকলে তাকে নির্মূল করা সম্ভব হচ্ছে।
সবচেয়ে বড় কথা হলো, টিকা নেয়ার ফলে লোকে ভাইরাসের সংক্রমণ থেকেই নিজেকে রক্ষা করতে পারছে এবং ফলে লং কোভিডের হাত থেকেও রেহাই পাচ্ছে।
লং কোভিডের চিকিৎসা
ব্রিটেনে এখন ৮৯টি বিশেষ স্বাস্থ্য কেন্দ্রে লং কোভিড আক্রান্তদের অবস্থা যাচাইয়ের সুযোগ তৈরি করা হয়েছে। তবে লং কোভিডের চিকিৎসার জন্য এখনো কোন প্রমাণিত ওষুধ নেই। ডাক্তাররা যা করছেন তা হলো রোগীর উপসর্গগুলোর সুশ্রুষা এবং পর্যায়ক্রমে রোগীর শারীরিক সক্রিয়তা বাড়ানো।
বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকরা বলছেন, যাদের কোভিড থেকে সেরে উঠতে দীর্ঘদিন লাগে, তাদের দরকার প্রচুর বিশ্রাম, স্বাস্থ্যকর খাদ্য গ্রহণ ও প্রচুর পানি পান করা। কোনো কোনো রোগীর হাঁটার ক্ষমতা ফিরে পেতে ফিজিওথেরাপি দরকার হয়।
সাধারণভাবে বলা যায়, ধূমপান না করা, মদ্যপান কমানো, শরীরচর্চা, স্বাস্থ্যকর খাবার খাওয়া, এবং ওজন নিয়ন্ত্রণে রাখা - এগুলো মেনে চলতে পারলে কোভিড-১৯ সংক্রমণ থেকে অল্পদিনেই সেরে ওঠা সম্ভব। তাছাড়া ব্রিটেনে লং কোভিড চিকিৎসার কিছু ওষুধের ক্লিনিক্যাল পরীক্ষা শিগগিরই চালু হচ্ছে।
সম্প্রতি বাংলাদেশের যশোর বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় এবং যুক্তরাজ্য ও যুক্তরাষ্ট্রের একাধিক বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রায় ১৭ জন গবেষকদের একটি দল লং কোভিড নিয়ে গবেষণা করেছেন।
যশোর বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের ফিজিওথেরাপি ও পুনর্বাসন বিভাগের চেয়ারম্যান ডা. মো. ফিরোজ কবির বিবিসি বাংলাকে বলেছেন, ২০২০ সালের মে মাস থেকে শুরু করে এ বছরের মে মাস পর্যন্ত এক বছর দুই হাজারের বেশি কোভিড রোগীর উপর চালানো গবেষণাটিতে দেখা গেছে, বাংলাদেশের প্রায় ১৫ শতাংশ কোভিড রোগী লং কোভিডে ভুগছে।
তিনি এই গবেষণায় অংশ নিয়েছেন।
বাংলাদেশের চিকিৎসকরা বলেছেন, এখন কোভিড-১৯ এর চিকিৎসার নির্ধারিত ঢাকায় সরকারি কয়েকটি হাসপাতালে সুস্থ হওয়াদের ছাড়পত্র দেয়ার সময় ফলোআপ চিকিৎসার পরামর্শ দেয়া হচ্ছে।
কিন্তু সারা দেশের সরকারি-বেসরকারি সব হাসপাতালের জন্য কোভিডের দীর্ঘ মেয়াদী প্রভাব কাটানোর চিকিৎসার কোনো পরিকল্পনা বা কোনো প্রটোকল এখনো নেই।