
৬০ বৎসর বয়সের ঊর্ধ্বে ১৫ শতাংশ মানুষ কোনো না কোনো মানসিক রোগে আক্রান্ত হয়ে থাকেন
৫৮ বছর বয়সের মুনীর সাহেব খ্যাতনামা ব্যবসায়ী। বিভিন্ন ধরনের কাজের চাপ আর সংসারের চাপে থাকেন সারাক্ষণ। ৪৩ বছর বয়সে উচ্চ রক্তচাপ এবং ৪৬ বছর বয়সে ডায়াবেটিস ধরা পরে। মুনীর সাহেবের বাবারও এ দুটি রোগ ছিল। তাই তিনি মানসিকভাবে প্রস্তুত ছিলেন, তারও এ রোগ হতে পারে। নিয়মিত চিকিৎসায় তার রোগগুলো নিয়ন্ত্রণে থাকায় তিনি ভালোই ছিলেন। দু’বছর আগে তিন সন্তানের মাঝে সবার ছোট মেয়ে আলিয়াকে অনেক শখ করে নিজের পছন্দের বনেদী পরিবারে বিয়ে দিয়েছিলেন।
কিন্তু আলিয়ার স্বামী মদে আসক্ত ছিলেন। প্রতিদিন বিভিন্ন ধরনের শারীরিক ও মানসিক নির্যাতনের শিকার আলিয়া শেষ পর্যন্ত সহ্য করতে না পেরে স্বামীকে ডিভোর্স দিয়ে বাবার ঘরে চলে আসে। মুনীর সাহেবের প্রতিনিয়ত মনে হতে থাকে, ‘আমি হেরে গেছি, পারলাম না মেয়েটাকে সুখী করতে’, তার নিজেকে অপরাধী মনে হতে থাকে, ভাবতে থাকেন- ‘আর একটু খোঁজ-খবর নিয়ে কেন বিয়ে দিলাম না, আমিই আমার মেয়ের সর্বনাশের জন্য দায়ী’ ইত্যাদি। প্রচণ্ড হতাশা তাকে আঁকড়ে ধরে। নিজের কাজ, নিজের শরীর কোনো কিছুর প্রতি তার যত্ন নিতে ইচ্ছা করে না। ওষুধও নিয়মিত খান না। ডায়াবেটিস, উচ্চরক্তচাপ দুটোই নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে আসে। এতে তিনি আরও ভেঙে পড়েন। দুর্দান্ত, প্রতাপশালী মুনীর সাহেবের ক্রমাগত মনে হতে থাকে- ‘বেঁচে থেকে কী লাভ?’
নীরা রহমান ৬২ বছর বয়সের কাজপাগল নারী। পেশাগত জীবন থেকে অবসরে গিয়েছেন দু’বছর আগে। দশ বছর আগে তার স্বামী হার্ট অ্যাটাকে মারা গেছেন। শুরুতে খুব অসহায় বোধ করলেও পরে মানিয়ে নিতে পেরেছেন। বড় ছেলে সপরিবারে কানাডায় সেটেল্ড। ছোট ছেলে দেশেই থাকেন মায়ের সঙ্গে। আয়ান তার ছোট ছেলের ঘরের নাতি। সংসারের টুকিটাকি কাজ, ধর্ম-কর্ম, আয়ানের দেখাশোনা আর তার সঙ্গে গালগল্প করে ভালোই কাটছিল তার। আয়ানের বাবার খুব ইচ্ছা ছিল, আয়ানকে ক্যাডেট কলেজে পড়াবে। বাবার ইচ্ছা পূরণ করতে পেরেছে আয়ান, সে ক্যাডেট কলেজের ভর্তি পরীক্ষায় চান্স পেয়েছে; বাবা-মা ও দাদি সবাই খুব খুশি; কিন্তু হঠাৎ নীরা লক্ষ করলেন, তার নিজেকে খুব একা লাগছে; অসহায় লাগছে; কেমন একটা অস্থিরতা বিরাজ করছে তার মনে; রাতে ঘুমাতে পারছেন না; দিনে কোনো কাজে মন দিতে পারছেন না- মাথাটা কেমন ঝিম ধরে থাকছে। নীরা তার মনের ও শরীরের পরিবর্তনগুলো টের পাচ্ছিলেন; কিন্তু তিনি বুঝে উঠতে পারছিলেন না, কেন এমন হচ্ছে। আয়ান পড়াশোনা করে জীবনে ভালোভাবে প্রতিষ্ঠিত হবে, আদর্শ মানুষ হবে এ স্বপ্ন তিনিও দেখেন; কিন্তু আয়ানের বাড়ি ছেড়ে যাওয়ার বিষয়টা তাকে কেন এত অস্থির করে তুলছে, বুঝতে পারছিলেন না নীরা।
৬০ বৎসর বয়সের ঊর্ধ্বে ১৫ শতাংশ মানুষ কোনো না কোনো মানসিক রোগে আক্রান্ত হয়ে থাকেন। বার্ধক্যজনিত অক্ষমতার কারণগুলোর মাঝে ৬.৬ শতাংশ মানসিক এবং স্নায়বিক কারণে হয়ে থাকে।
বার্ধক্যে মানসিক রোগের কারণ
বয়সের সঙ্গে সঙ্গে মানুষের সার্বিক কর্মক্ষমতা লোপ পেতে থাকে; চুলে পাক ধরে, দাঁত পড়ে, ত্বকে ভাঁজ পড়ে, হাড়ক্ষয় হতে থাকে, প্রজনন ক্ষমতা থাকে না বা কমতে থাকে। কর্মজীবন থেকে অবসরে যায়। সন্তানরা বড় হয়, তাদের নিজস্ব জগৎ তৈরি হয়, অনেক সময় জীবিকা অর্জনের জন্য দূরে চলে যায় বা কর্মব্যস্ত হয়ে পড়ে ইত্যাদি নানাবিধ কারণে বৃদ্ধ হলে আত্মবিশ্বাস কমে যায়, একাকিত্বের অনুভূতি শ্বাসরুদ্ধকর অবস্থা তৈরি করে। মধ্যবয়স থেকেই মানুষ জীবনের হিসাব-নিকাশের খাতা খুলে বসে; কী পেলাম, কী পেলাম না- এসব ভেবে ভেবে অস্থির থাকে, মানসিক চাপ তৈরি হয়।
বয়স হলে মানুষের রোগপ্রতিরোধ ক্ষমতা কমে যায়, বিভিন্ন প্রকার দীর্ঘমেয়াদি শারীরিক রোগ যেমন- ডায়াবেটিস, উচ্চ রক্তচাপ, হৃদরোগ ও হাড় ক্ষয়রোগ ইত্যাদি দেখা দেয়। যেহেতু মন আর শরীর অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িত, তাই একটি খারাপ থাকলে অন্যটিও খারাপ থাকে। যেমন- হৃদরোগে আক্রান্ত ব্যক্তিদের মাঝে বিষণ্ণতার হার শারীরিকভাবে সুস্থ ব্যক্তিদের চেয়ে বেশি। আবার যাদের হৃদরোগ ও বিষণ্ণতা রোগ আছে, তারা যদি এসব রোগের চিকিৎসা না নেন, তাহলে তা হৃদরোগের পরিণতিকে খারাপের দিকে নিয়ে যাবে।
দ্রুত নগরায়ন, ভৌগোলিক পরিবর্তন, শিল্পায়ন, সংস্কৃতিতে পাশ্চাত্যের প্রভাব, যৌথ পরিবার ভেঙে একক পরিবার গঠন ইত্যাদি বৃদ্ধি জনগোষ্ঠীর মানসিক স্বাস্থ্যের জন্য হুমকিস্বরূপ। বার্ধক্যজনিত মানসিক রোগের মাঝে বিষণ্ণতা, উদ্বেগজনিত রোগ, ডিমেনশিয়া বা স্মৃতিভ্রংশ, দেরিতে শুরু হওয়া সিজোফ্রেনিয়া, বাইপোলার মুড ডিসঅর্ডার বা আবেগীয় রোগ, ঘুমের সমস্যা ইত্যাদি উল্লেখযোগ্য।
বার্ধক্যে মানসিক রোগের সতর্কতামূলক লক্ষণ-
- একটানা হতাশা, বিষণ্ণতায় ভোগা।
- ইতিবাচক আবেগ অনুভব না করা।
- অতিরিক্ত ঘুমানোর অথবা ঘুম না হওয়ার সমস্যা থাক।
মানসিক স্বাস্থ্য নিশ্চিত করতে করণীয়-
- বৃদ্ধদের সেবা-শুশ্রুষা জন্য স্বাস্থ্যকর্মী, চিকিৎসকদের মানসম্মত প্রশিক্ষণ প্রদান।
- বয়সজনিত দীর্ঘমেয়াদি মানসিক ও শারীরিক রোগ, মাদকাসক্তি ইত্যাদির সুব্যবস্থাপনা ও প্রতিরোধে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ।
- বয়সবান্ধব সেবা এবং সেবা প্রদানকারী প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলা।
- বয়স্কদের স্বাধীনতা এবং নিরাপত্তা নিশ্চিতকরণ।
মনোসামাজিক সহায়তা, কাউন্সেলিং এবং ওষুধ এর সমন্বয়ে চিকিৎসা প্রদান করতে হবে। যেহেতু ডিমেনশিয়া সম্পূর্ণ ভালো করার কোনো ওষুধ আবিষ্কার হয়নি, সেহেতু ডিমেনশিয়া রোগী এবং তাদের পরিচর্যাকারীদের জীবনমান উন্নয়নের জন্য প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ।
- বৃদ্ধদের নির্যাতন বন্ধে বিভিন্ন কর্মসূচি গ্রহণ করা।