Logo
×

Follow Us

লাইফস্টাইল

প্যানক্রিয়াস : ডায়াবেটিসের মূল কারণ

Icon

ডা. অপূর্ব চৌধুরী

প্রকাশ: ০৮ মে ২০২২, ১৫:৫৫

প্যানক্রিয়াস : ডায়াবেটিসের মূল কারণ

প্রতীকী ছবি

প্যানক্রিয়াস শরীরের একটি গ্লান্ড। প্যানক্রিয়াসের কথা এলেই ডায়াবেটিসের কথা আসে। কারণ, প্যানক্রিয়াস নামক শরীরের এই গুরুত্বপূর্ণ অংশটি ডায়াবেটিসের মূল কারণ। মানুষের শরীরে পাকস্থলির পেছনে এটি থাকে। প্যানক্রিয়াসের অনেক কাজ। তবে মূল কাজ খাদ্য পরিপাকে অন্ত্রকে সাহায্য করা। দৈর্ঘ্যে আধা ফুট লম্বা এবং দেখতে চ্যাপ্টা একটি পেয়ারার মতো। এটির চারপাশে পাকস্থলি, অন্ত্র, লিভার, স্প্লিন, গল ব্লাডার অনেক গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গ থাকে।

কেন প্যানক্রিয়াস শরীরের জন্য গুরুত্বপূর্ণ! কারণ, এই প্যানক্রিয়াসের কারণে ডায়াবেটিস হয়। সঙ্গে প্যানক্রিয়াস না থাকলে খাদ্যের পরিপাকে ব্যাঘাত ঘটবে। তবে কোনোভাবে পুরোপুরি প্যানক্রিয়াস নষ্ট হয়ে গেলে অথবা প্যানক্রিয়াস কেটে ফেলতে হলে প্যানক্রিয়াস ছাড়াই একজন মানুষ বেঁচে থাকতে পারে। তখন ডায়াবেটিস দেখা দেবে। কারণ, প্যানক্রিয়াস দ্বারা তৈরি ইনসুলিন শরীরে গ্লুকোজ নিয়ন্ত্রণ করে। ইনসুলিনের অভাবে রক্তে গ্লুকোজ বেড়ে যায়। প্যানক্রিয়াস না থাকলে কিছু ডাইজেস্টিভ এনজাইম পিল, ইনসুলিন ইনজেকশন এবং রেস্ট্রিক্টেড ডায়েট করে ভালো থাকতে পারবে।

১৭ শতাব্দীর আগ পর্যন্ত প্যানক্রিয়াস সম্পর্কে চিকিৎসকরা তেমন কিছু জানতো না। এমনকি অঙ্গটির অস্তিত্ব সম্পর্কে জানলেও তার কাজ সম্পর্কে তখনো জানতো না। তবে খ্রিস্টপূর্ব ৩০০ সালে হেরোপিলাস নামের এক গ্রিক সার্জন সর্বপ্রথম মানুষের শরীরে প্যানক্রিয়াসের অস্তিত্ব আবিষ্কার করেন। তার চারশ’ বছর পরে আরেক গ্রিক এনাটোমিস্ট রুফা এর গ্রিক নাম দেন- প্যানক্রিস, যার অর্থ শুধুই মাংস। কারণ প্যানক্রিয়াসে কোনো হাড় নেই অথবা কোনো হাড়ের সঙ্গেও এটি যুক্ত নয়। ১৬৪২ সালে জার্মান এনাটোমিস্ট জন উর্ষাং প্যানক্রিয়াসের ভেতর একটি নালি আবিষ্কার করেন, যে নালির মধ্যে দিয়ে ইন্টেস্টাইনে খাদ্য পরিপাকের এনজাইম বের হয়। চিকিৎসকরা তখন এই ডাক্ট বা নালিটিকে ডাক্ট অব উর্ষাং বলতো। এই আবিষ্কার নিয়ে আরেকজন এনাটোমিস্টের সঙ্গে বিবাদ এতদূর গড়িয়েছিল যে, কার নামে এই নালির নাম হবে! শেষ পর্যন্ত উর্ষাং কে হত্যা করা হয়েছিল। ক্লাউড বার্নার্ড নামের একজন চিকিৎসক আঠারো শতকে এটির কাজ সম্পর্কে প্রথম ধারণা দেন। পরবর্তীতে ১৯২২ সালে বান্টিং প্যানক্রিয়াসের সঙ্গে ডায়াবেটিসের সম্পর্ক উদ্ধার করেন প্রথম। 

প্যানক্রিয়াস সরাসরি খাদ্য পরিপাক কিংবা অন্য কোনো কাজ করে না। এটি অন্য অঙ্গের কাজে সাহায্য করে। প্যানক্রিয়াসের কাজকে দু-ভাগে ভাগ করা হয়। এক্সকরাইন এবং এন্ডোক্রাইন। এক্সকরাইন কাজটি হলো- প্যানক্রিয়াটিক ফ্লুয়িড নামের জুস তৈরি করা, যা মূলত এক ধরনের এনজাইম। এটি প্যানক্রিয়াস থেকে বেরিয়ে ইন্টেস্টাইনের প্রথম পার্ট ডিওডেনামে ঢুকে। পাকস্থলি থেকে খাদ্য চূর্ণ হয়ে এই ডিওডেনামে যায়। ‘তখন প্যানক্রিয়েটিক এনজাইমটি কার্বোহাইড্রেট, ফ্যাট, প্রোটিন তিনটিকেই পরিপাক করে। এন্ডোক্রাইন কাজ হলো- প্যানক্রিয়াস দুটি হরমোন নিঃসরণ করে। ইনসুলিন এবং গ্লুকাগন। শরীরে কার্বোহাইড্রেট বা সুগার বেড়ে গেলে এই ইনসুলিন তা কমিয়ে দেয়, আবার কোনো কারণে শরীরে প্রয়োজনীয় পরিমাণের চেয়ে কম সুগার থাকলে বা কমে গেলে, তখন প্যানক্রিয়াস গ্লুকাগন সিক্রেট করে। এই গ্লুকাগন লিভারে গিয়ে লিভারে সঞ্চিত থাকা গ্লাইকোজেনকে ভেঙে গ্লুকোজ বা সুগার তৈরি করে শরীরের দরকারি ঘাটতি মেটায়। 

প্যানক্রিয়াসে সমস্যা দেখা দিলে শরীরে অনেক সমস্যা দেখা দেয়। অযথা দুর্বল লাগে, ক্ষুধা কমে যায়, হঠাৎ পেটে ব্যথা হয়, কোনো কারণ ছাড়াই ডায়রিয়া এবং কনস্টিপেশন লেগে থাকে। প্রস্রাবের রং গাঢ় হলুদ হয়ে ওঠে, চোখে জন্ডিস দেখা দিতে পারে। খাদ্য পরিপাকে সমস্যা লেগেই থাকে, মাঝে মাঝে হাই টেম্পারেচার জ্বর আসে। 

এমন সব সমস্যা দীর্ঘসময় চলতে থাকলে চিকিৎসকের পরামর্শ নিন। 

প্যানক্রিয়াসের কারণে ডায়াবেটিস কিংবা গলস্টোনের মতো অথবা সিস্টিক ফাইব্রোসিস সমস্যা দেখা দিলেও সরাসরি প্যানক্রিয়াসের কারণে একিউট এবং ক্রনিক প্যানক্রিয়াটাইটিস এবং প্যানক্রিয়াটিক ক্যানসার সবচেয়ে বেশি হয়। 

প্যানক্রিয়াটিক ক্যানসার সংখ্যার দিক থেকে বিশ্বে ১২তম কমন ক্যানসার। বছরে পাঁচ লক্ষ লোক বিশ্বব্যাপী প্যানক্রিয়াটিক ক্যানসারে আক্রান্ত হয়। শুধু ইংল্যান্ডে বছরে আট হাজার প্যানক্রিয়াটিক ক্যানসার রোগী মারা যায়। এই ক্যানসারের অন্যতম একটি কারণ অতিরিক্ত এলকোহল পান। 

আপনার শরীরে প্যানক্রিয়াস কতটুকু ভালো আছে, কেমন আছে জানতে চিকিৎসকরা মূলত দুটো টেস্ট করেন। স্টুল টেস্ট এবং প্যানক্রিয়াটিক টেস্ট। মল পরীক্ষা করে দেখা হয় স্বাভাবিকের চেয়ে মলের সঙ্গে বেশি পরিমাণে ফ্যাট যাচ্ছে কিনা। মলের সঙ্গে এমন বেশি ফ্যাট বের হলে বুঝতে হবে প্যানক্রিয়াসের এনজাইম সেগুলো প্রসেস করতে পারছে না এবং আপনার প্যানক্রিয়াস ভালো নেই। প্যানক্রিয়াসের সমস্যায় খুব দুর্গন্ধ যুক্ত মল, পেটে ব্যথা করা এবং খাবার খেলে সে ব্যথা বেড়ে যাওয়া, ক্রমশ সে ব্যথা পেট থেকে শরীরের পেছনের অংশেও করতে পারে। প্যানক্রিয়াটিক টেস্ট দ্বারা প্যানক্রিয়াসের এনজাইমগুলো সম্পর্কে জানা হয়। 

রোজার একমাসে খাওয়া পেঁয়াজুর ডাল প্যানক্রিয়াসের জন্য ভালো। তবে যদি বেশি ফ্যাটযুক্ত খাবার খান, ডাল খেয়ে যেটুকু লাভ পাওয়ার কথা, উল্টো প্যানক্রিয়াটের ওপর চাপ বেড়ে যাবে তাতে। তবে রোজার সময় একটি এমন দীর্ঘ সময় খাবার থেকে বিরত থাকা প্যানক্রিয়াসকে হেলদি করে, পূর্বে প্যানক্রিয়াসের কোনো সমস্যা থাকলে রোজার উপবাস প্যানক্রিয়াসের ক্ষতগুলোকে রিপেয়ার করে অনেক সময়। রোজা এক অর্থে প্যানক্রিয়াসের জন্য উপকারী।

শরীরে প্যানক্রিয়াস অঙ্গটিকে সুস্থ রাখতে যা যা করবেন-

১. ধূমপান ছেড়ে দিন। 

২. এলকোহল সেবীরা পরিমিত এলকোহল পান করুন। 

৩. হাই ফ্যাট খাবার পরিহার করুন। 

৪. বেশি পরিমাণ আঁশযুক্ত খাবার, ভেজিটেবল, সবজি, ফলমূল খাবেন। 

৫. শরীরের বিএমআই রেঞ্জের মধ্যে রাখুন। 

৬. খাবারে প্রোটিন যুক্ত বেশি খাবার রাখবেন। 

৭. এন্টিঅক্সিডেন্ট যুক্ত খাবার বেশি খাবেন। 

৮. নিয়মিত দৈনিক বরাদ্দের চেয়ে একটু বেশি পানি পান করবেন। বিশেষ করে ফ্যাট খাবার খেলে। 

৯. ভিটামিন ডি প্যানক্রিয়াস সুস্থ রাখতে সাহায্য করে। 


লেখক : চিকিৎসক, কথাসাহিত্যিক ও বিজ্ঞান লেখক

লন্ডন, ইংল্যান্ড 

Logo

সম্পাদক ও প্রকাশক: ইলিয়াস উদ্দিন পলাশ

বার্তা ও বাণিজ্যিক কার্যালয়: ফেয়ার দিয়া ১১/৮/ই, ফ্রি স্কুল স্ট্রিট (লেভেল-৮), বক্স কালভার্ট রোড, পান্থপথ, ঢাকা ১২০৫