ছবি : সাম্প্রতিক দেশকাল
বাংলাদেশ এবং শ্রীলঙ্কার জাতীয় ফল কাঁঠাল। ফলটি দক্ষিণ ও দক্ষিণপূর্ব এশিয়ায় পাওয়া যায়। আমাদের দেশেও এর জনপ্রিয়তা ব্যাপক। কিন্তু, তা স্বত্বেও অনেকেই বলে থাকেন, সবচেয়ে সুস্বাদু ফল আম। ধারণাটির যথেষ্ট যুক্তিভিত্তিক কারণও রয়েছে।
বিশ্বব্যাপী আম একটি অত্যন্ত জনপ্রিয় সুস্বাদু ফল। এর মতো এতো পছন্দনীয় ফল পৃথিবীতে দ্বিতীয়টি নেই। এমন কোনো জাতি নেই যারা আম পছন্দ করেনা। তাই একে সন্মান দিয়ে ʼফলের রাজাʼ বলা হয়। ভারত ও পাকিস্তানে এটি জাতীয় ফল। বাংলাদেশে আমগাছ জাতীয় গাছ।
বাংলায় আম শব্দটি সংস্কৃত আম্র শব্দ থেকে উৎপত্তি হয়েছে। ফলটির আদি জন্মস্থান নিয়ে বিতর্ক রয়েছে। এর বৈজ্ঞানিক নাম ম্যাঙ্গিফেরা ইন্ডিকা নামটি উপমহাদেশ ইঙ্গিত করলেও ভারতবর্ষে কোথায় প্রথম আম দেখা গেছে তা নিয়ে মতভেদ রয়েছে। তবে, উপমাহাদেশেই যে আমের আদিবাস সে বিষয়ে আম বিজ্ঞানীরা একমত।
প্রায় সব মহাদেশেই আম উৎপাদন হয়। সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী ২০২০ সালে সারা বিশ্বে আমের মোট উৎপাদন ছিল সাড়ে পাঁচ কোটি মেট্রিক টন। তার মধ্যে ভারত একাই করেছে ৪৫%, অন্য উৎপাদক দেশগুলোর মাথাপিছু উৎপাদন তুলনামূলকভাবে অনেক কম।
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) হিসাবে, ২০১৯-২০ অর্থবছরে দেশে আম উৎপাদিত হয়েছে ১২ লাখ ২২ হাজার টন। দেশে ২ লাখ ৩৫ হাজার একর জমিতে আমবাগান রয়েছে। প্রতিটি গাছে গড়ে ৭৭ কেজি করে আম উৎপাদিত হয়।
হয়তো শুধুমাত্র আমের জন্যই জ্যৈষ্ঠ মাসের নাম হয়েছে মধুমাস। এমাসে আরো অনেক ফল বাজারে আসে। তবে, ভেবে দেখলে বোঝা যায় আমের অনুপস্থিতিতে সম্ভবত এই নামকরণ হতো না!
অনেক প্রজাতির আম বাংলাদেশের বাজারে পাওয়া যায়। যেমন- হিমসাগর, ল্যাংড়া, গোপালভোগ, আম্রপালি, ফজলি ইত্যাদি। দেশের সব স্থানে আম ভালো জন্মায় না। মূলত বৃহত্তর রাজশাহী, কুষ্টিয়া, সাতক্ষীরা, রাঙ্গামাটি এবং রংপুরেই আম সর্বাধিক জন্মে। এর মধ্যে রংপুরের আমটির নাম হাড়িভাঙ্গা। অদ্ভুত এই নামটি পিছনের গল্প হলো-
হাড়িভাঙ্গা আমের উৎপত্তি রংপুর জেলার মিঠাপুকুর উপজেলার খোড়াগাছ ইউনিয়নে। আবিস্কারক নফল উদ্দিন পাইকার। তিনি একটি হাড়িকে ফিল্টার বানিয়ে মালদিয়া আমগাছে পানি দেওয়ার ব্যবস্থা করেছিলেন। একদিন সে হাড়িটি কে বা কারা ভেঙে ফেলে। সেই গাছের আম তিনি বাজারে বিক্রি করতে গেলে ক্রেতারা নাম জানতে চাইতো। তিনি উত্তর দিতেন “যে গাছের নীচে হাড়ি ভেঙেছে, এটি সেই গাছের আম।“ এভাবে মালদিয়া আম হয়ে যায় হাড়িভাঙ্গা আম। এই আম অত্যন্ত মিষ্টি এবং সুস্বাদু। বর্তমানে মাতৃগাছটির বয়স ৬৪ বছর।
সব স্থানের আম একই সময়ে সংগ্রহ করার মতো পোক্ত হয় না। এ পর্বটি পূর্ব দিক থেকে শুরু হয়। তাই, আমরা জ্যৈষ্ঠ মাস শুরু হওয়ার আগেই দেখি কিছু আম বাজারে চলে এসেছে। এগুলো রাঙ্গামাটির আম। এরপর আসে সাতক্ষীরা, কুষ্টিয়া, রাজশাহী, নওগাঁ, চাঁপাইনবাবগঞ্জ এবং রংপুরের আম।
সাধারণভাবে বৃহত্তর রাজশাহীকে আম উৎপাদনের কেন্দ্র হিসেবে বিবেচনা করা হয়। সেই নগরীতে ‘আম চত্বর’ একটি দর্শনীয় স্থান। সারা দেশের মানুষ আম বলতেই জানে রাজশাহী। খুচরা বিক্রেতারা যখন বলেন “এগুলো রাজশাহীর আম”; আমরা আস্থার সাথে কিনে নেই। রাজশাহী নগরীতে রয়েছে বেশ কয়েকটি আমের আড়ত বা পাইকারি বাজার। বিভিন্ন উৎস থেকে সেসব স্থানে আম চলে আসে। পাইকারদের চাহিদা অনুযায়ী বাগান মালিকরা গাছ থেকে আম পেড়ে তাদেরকে পাঠান। আবার পাইকারদের কাছ থেকে স্থানীয় এবং দেশের অন্যান্য স্থানের খুচরা বিক্রেতারা আম নিয়ে আসেন সাধারণ ক্রেতাদের জন্য।
বৃহত্তর রাজশাহীর মধ্যে চাঁপাইনবাবগঞ্জ আম উৎপাদনের প্রধান কেন্দ্র হিসেবে বিবেচিত। সেখানকার বাগানগুলি শত বছরের পুরনো এবং সব প্রজাতির আমই সেখানে উৎপাদিত হয়। তবে, সে বাগানগুলো কিছুটা শৃঙ্খলাবিহীন। গত বেশ কয়েক বছর ধরে নওগাঁয় সুসংগঠিতভাবে আমের উৎপাদন চলছে। অর্থাৎ একটি বাগানে একই প্রজাতির আমের চাষ করা হচ্ছে। এর ফলে রক্ষণাবেক্ষণ এবং নিরাপত্তার কাজ সহজতর হয়েছে। রাজশাহীর পাইকারি ব্যবসায়ীরা এখন নওগাঁকেই আম উৎপাদনের প্রধান কেন্দ্র হিসেবে বিবেচনা করেন।
সরকারের কড়াকড়ি নিয়ন্ত্রণের ফলে সম্প্রতি ফর্মালিন উপদ্রব কিছুটা কমেছে। সে কারণে রাজধানীতে মানসম্মত আম পাওয়া যাচ্ছে। বর্তমানে উন্নত পরিবহন সার্ভিসের কারণে যে কেউ ঢাকা থেকেই রাজশাহীর পাইকারকে অর্ডার দিয়ে আম আনিয়ে নিতে পারেন। সেক্ষেত্রে মূল্য স্থানীয় বাজার থেকে উল্লেখযোগ্যভাবে কম পড়ে।
সমস্যা ও সম্ভাবনা:
ব্যাপক জনপ্রিয়তার কারণে আমের উৎপাদন ও ফলন পূর্বের তুলনায় অনেক বেড়েছে। আজকাল দেখা যায় অনেক ভোগ্যপণ্য উৎপাদক প্রতিষ্ঠান বোতলজাত ম্যাংগো জুস বাজারজাত করছে যেগুলোর বড় ভোক্তা শ্রেণি রয়েছে। জুস তৈরি করতে খুব ভালো জাতের আমের প্রয়োজন নেই। বিশেষজ্ঞদের মতে গুটি আমে জুস সবচেয়ে ভালো হয়। এই আমের ফলনও অনেক বেশি হয়ে থাকে। এ ছাড়াও ঝড়ে এবং বিভিন্ন কারণে ঝরে পড়া আম আচার শিল্পে ব্যবহৃত হতে পারে। এটি এমনই শিল্প যা গৃহকেন্দ্রিকও হতে পারে।
আমকে শিল্প হিসেবে গড়ে তোলা অসম্ভব নয়। এতে খুব বেশি মূলধনের প্রয়োজন নেই। জনশক্তিও রয়েছে। কিন্তু সুষ্ঠু পরিকল্পনার অভাবে এর বিকাশ কিছুটা এলোমেলোভাবেই হচ্ছে।
আমের একটি বিশেষ বৈশিষ্ট হচ্ছে, এর মেয়াদকাল দুই থেকে তিন মাস। অর্থাৎ সারা বছর নিয়োজিত থাকার মতো শ্রমশক্তি নিষ্প্রয়োজন। সংরক্ষণ আরেকটি বড় চ্যালেঞ্জ। এর অভাবে ফলটি খুব অল্প সময়ের মধ্যে পচে যেতে পারে। আবার, বাড়তি লাভের উদ্দেশে অনেক চাষি প্রধান ফসল বাদ দিয়ে আম চাষে আগ্রহী হচ্ছেন যা আমাদের খাদ্য নিরাপত্তার প্রতি হুমকি সৃষ্টি করার আশঙ্কা রয়েছে।
সুষ্ঠু পরিকল্পনা ও সমন্বয়ের মাধ্যমে এগুলো দূর করা যেতে পারে। ডেডিকেটেড কোল্ড স্টোরেজের সাহায্যে সারা বছর না হলেও, তিন মাসের মেয়াদকালকে অনেকটাই দীর্ঘায়িত করা সম্ভব। প্রধান ফসলের বিঘ্ন না ঘটিয়ে নির্দিষ্ট জমিতে বৈজ্ঞানিক উপায়ে আমের চাষ করা যেতে পারে। গাছের পরিচর্যা ও নিরাপত্তার জন্য বাগান মালিকদের প্রশিক্ষণ দেওয়া যেতে পারে। এর কোনোটিই অসাধ্য নয়।