
প্রতীকী ছবি
এক সময় মানুষের অপুষ্টি দূর করতে ট্রান্সফ্যাটের আবিষ্কার হলেও, এখন এটাই ঘাতক ব্যাধি হৃদরোগের জন্য দায়ী। বিষয়টি সম্পর্কে না জানার কারণে মানুষ ট্রান্সফ্যাট (ট্রান্স ফ্যাটি অ্যাসিড) জাতীয় খাবার খাচ্ছে দেদার। শিল্পজাত প্রায় সব ধরনের খাবারে রয়েছে অতিরিক্ত মাত্রার ট্রান্সফ্যাট। শিল্পজাত খাবার খুবই সুস্বাদু বলে খাবারের তালিকার শীর্ষে এটি। বাংলাদেশে ১৯৯০ দশকের চেয়ে বর্তমানে কয়েকগুণ বেশি বেড়েছে হৃদরোগের রোগী।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ট্রান্সফ্যাটের কারণেই হৃদরোগের মাত্রা আগের চেয়ে বেশি বেড়েছে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (ডব্লিউএইচও) তথ্য মতে, বিশ্বের ১৫টি দেশে ট্রান্সফ্যাট গ্রহণের কারণে হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যু মোট মৃত্যুর দুই-তৃতীয়াংশ। এই তালিকায় বাংলাদেশ অন্যতম। বিশ্বে প্রতিবছর প্রায় পাঁচ লাখ মানুষ ট্রান্সফ্যাটজনিত হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুবরণ করছেন। প্রতিবছর হৃদরোগে যত মানুষ মারা যায়, তার ৪ দশমিক ৪১ শতাংশের জন্য দায়ী খাদ্যে মাত্রাতিরিক্ত ট্রান্সফ্যাটের উপস্থিতি।
বাংলাদেশে হৃদরোগে মারা যায় বছরে ২ দশমিক ৭৭ লাখ : হৃদরোগজনিত কারণে বাংলাদেশে প্রতিবছর মারা যায় দুই লাখ ৭৭ হাজারের বেশি মানুষ। এটা মোট মৃত্যুর এক-তৃতীয়াংশ। গত ৭ আগস্ট পর্যন্ত দুই বছর ১৯ দিনে করোনায় বাংলাদেশে মারা গেছে ২৯ হাজার ৩০২ জন। কিন্তু হৃদরোগজনিত কারণেই বাংলাদেশে বছরে মৃত্যু হচ্ছে দুই লাখ ৭৭ হাজার। করোনা নিয়ে আতঙ্কিত থাকলেও, হৃদরোগ নিয়ে সে রকম আতঙ্কে নেই বাংলাদেশের মানুষ। হৃদরোগে অপেক্ষাকৃত বয়স্ক মানুষগুলোর মৃত্যু হয় বলে এত আতঙ্ক নেই। রোগটি মহামারির মতো ছড়িয়ে পড়ার পেছনের অন্যতম কারণ হিসেবে হৃদরোগ বিশেষজ্ঞরা দায়ী করছেন, ‘ট্রান্সফ্যাট’ নামক খাবারের একটি উপাদানকে। মুখরোচক হিসেবে আমরা প্রতিনিয়ত ক্ষতিকর এই খাবারটি খাচ্ছি। নীতিনির্ধারকেরা এই খাবারটির বিপদ সম্বন্ধে জানেন; কিন্তু ক্ষতিকর এই খাবারটি প্রতিরোধে কার্যকর ব্যবস্থার যথেষ্ট ঘাটতি রয়েছে।
বিশিষ্ট হৃদরোগ বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ডা. আফজালুর রহমান বলেছেন, ট্রান্সফ্যাট রক্তের ‘ভালো’ কোলেস্টেরলের মাত্রা কমিয়ে দেয় এবং ‘খারাপ’ কোলেস্টেরলের মাত্রা বাড়িয়ে দেয়। রক্তে অতিরিক্ত মাত্রার খারাপ কোলেস্টেরল হৃদরোগের ঝুঁকি বাড়ায়। বেশি ট্রান্সফ্যাটযুক্ত খাবার হার্ট ও রক্তনালির রোগ বাড়ায়। আমেরিকার খাদ্য ও ওষুধ প্রশাসন (ইউএসএফডি)- সম্প্রতি খাদ্য প্রস্তুতকারীদের খাবারে কৃত্রিম ট্রান্সফ্যাট যোগ করা নিষিদ্ধ করেছে। বাংলাদেশে এ ব্যাপারে সামান্য কিছু নির্দেশনা রয়েছে, তবে তা কার্যকর নয়।
ট্রান্সফ্যাটে ৪ দশমিক ৪১ শতাংশ মৃত্যু হচ্ছে : বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মতে, বাংলাদেশে প্রতিবছর যত মানুষ মারা যায়, তার ৪ দশমিক ৪১ শতাংশের জন্য সরাসরি দায়ী এই ট্রান্সফ্যাট। সংস্থাটি বাংলাদেশসহ ১১টি দেশকে দ্রুততম সময়ের মধ্যে খাবার থেকে ট্রান্সফ্যাট কমানোর পদক্ষেপ নেওয়ার আহ্বান জানিয়েছে। ২০২৩ সালের মধ্যে সব ধরনের চর্বি বা ফ্যাট, তেল এবং খাবারে মিশ্রিত প্রতি একশ গ্রাম ট্রান্সফ্যাটের পরিমাণ সর্বোচ্চ দুই গ্রামে সীমিত করার পরামর্শ দিয়েছে। নীতিমালা না থাকায় বিশ্বের একশটির বেশি দেশ ট্রান্সফ্যাটের ঝুঁকিতে আছে এবং ওই সব দেশের মানুষ হৃদরোগে আক্রান্ত হচ্ছেন বেশি হারে।
ঢাকার শীর্ষস্থানীয় পিএইচও ব্র্যান্ডসমূহের নমুনার ৯২ শতাংশে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার সুপারিশকৃত দুই শতাংশ মাত্রার চেয়ে বেশি ট্রান্সফ্যাট পাওয়া গেছে ন্যাশনাল হার্ট ফাউন্ডেশন হসপিটাল অ্যান্ড রিসার্চ ইনস্টিটিউটের গবেষণায়। সংস্থাটির গবেষণায়, প্রতি ১০০ গ্রাম পিএইচওর নমুনায় সর্বোচ্চ ২০ দশমিক ৯ গ্রাম পর্যন্ত ট্রান্সফ্যাটের উপস্থিতি পাওয়া গেছে। পরিমাণটি বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার সুপারিশকৃত মাত্রার তুলনায় ১০ গুণেরও বেশি।
ট্রান্সফ্যাট যুক্ত খাবার খুবই সুস্বাদু। ফলে মানুষ খাচ্ছে দেদার। দেশে উৎপাদিত কোন খাদ্যে কী পরিমাণ ট্রান্সফ্যাট রয়েছে, সে ব্যাপারে সুনির্দিষ্ট কোনো তথ্য নেই। ফলে না জেনে, না বুঝেই মানুষ বিভিন্ন খাদ্যদ্রব্যের সঙ্গে ঝুঁকিপূর্ণ মাত্রার ট্রান্সফ্যাট গ্রহণ করছে। একজন ব্যক্তি সারা দিনে যে পরিমাণ চর্বি গ্রহণ করবে এর মধ্যে সর্বোচ্চ এক শতাংশ ট্রান্সফ্যাট গ্রহণ করতে পারবে। তার মানে দুই হাজার ক্যালোরির ডায়েটে ট্রান্সফ্যাট থাকবে ২ দশমিক ২ গ্রামের চেয়ে কম। বাংলাদেশে দুই শতাংশ পর্যন্ত ট্রান্সফ্যাট থাকা অনুমোদিত। জনস্বাস্থ্যবিদরা বলেছেন, দেশে শিশু-কিশোর থেকে শুরু করে সাধারণ মানুষ, বিশেষ করে নিম্ন ও মধ্যবিত্ত পরিবারের সদস্যরা প্রচুর পরিমাণে শিঙাড়া, সমুচা, পুরি, জিলাপির মতো কড়া ভাজা খাবার গ্রহণ করে। খাবারে ট্রান্সফ্যাট বেশি হয় তেলকে উপর্যুপরি গরম করার কারণে। খাবারের দোকানে দেখা যায়, যে তেল দিয়ে কোনো কিছু ভাজা হয় তা শেষ না হওয়া পর্যন্ত সারা দিনই খাবার ভাজতে থাকে। তেলকে যখন বার বার গরম করা হয়, তখন সে তেল ট্রান্সফ্যাটে রূপান্তর হয়ে থাকে এবং এটা হার্ট ও রক্তনালিতে চর্বি জমিয়ে দিয়ে কার্ডিওভাস্কোলার রোগ তৈরি করে থাকে। হৃদরোগের চিকিৎসকরা জানিয়েছেন, ২০১৫ সালে একটি গবেষণার জন্য ঢাকার বিভিন্ন স্থান থেকে সংগৃহীত ১০ ধরনের বিস্কুট পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে তাতে ৫-৩১ শতাংশ পর্যন্ত ট্রান্সফ্যাট পাওয়া গেছে। এটা বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা নির্ধারিত পরিমাণের চেয়ে বেশি।
ট্রান্সফ্যাট ২ বাড়লে হৃদরোগ বাড়ে ২৩ শতাংশ : হৃদরোগ বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ট্রান্সফ্যাট গ্রহণের হার ২ শতাংশ বাড়লে হৃদরোগের ঝুঁকি ২৩ শতাংশ পর্যন্ত বাড়ে এবং হৃদরোগজনিত মৃত্যুর হার ৩৪ শতাংশ বাড়ে। ট্রান্সফ্যাট কী তা সাধারণ মানুষের মধ্যে কোনো ধারণাই নেই। এমনকি উচ্চ শিক্ষিত মানুষও এ ব্যাপারে কিছুই জানেন না। মানুষ ডালডা, বনস্পতি ঘি ইত্যাদি চর্বিযুক্ত খাবার নির্বিঘ্নে খেয়ে যাচ্ছে, এসব দিয়ে তৈরি খাবার খুবই সুস্বাদু। বিপরীতে এসব দিয়ে তৈরি খাবার যে স্বাস্থ্যের জন্য খুবই ঝুঁকিপূর্ণ তারা এ ব্যাপারে একেবারে অসচেতন। তেল বার বার পোড়ালে তা থেকে অক্সিজেন চলে যায় ও তাতে ট্রান্সফ্যাট তৈরি হয়। এ ধরনের তেল দিয়ে কোনো কিছু ভাজলে সেটি মচমচে ও সুস্বাদু হয়ে থাকে। জিলাপি, শিঙাড়া, সমুচা, পুরি, পিঁয়াজু, বেগুনি, আলুচপ, নানা পদের বিস্কুট, চানাচুর, চিপসের মতো বেকারি পণ্যে বা ফাস্ট ফুড তৈরিতে এ ধরনের তেল বেশি ব্যবহৃত হয়। এই খাবারগুলো যত বেশি পরিহার করা যাবে, তত বেশি করে মানুষ হৃদরোগের ঝুঁকিমুক্ত থাকতে পারবে। রেস্টুরেন্টে প্রক্রিয়াজাত (প্রসেসড ফুড) বা একাধিকবার জারিত তেলে প্রস্তুত করা খাদ্য ও অনেক স্ট্রিট ফুড কড়া করে ভাজা হয় স্বাদ বাড়ানোর জন্য। আবার আংশিকভাবে হাইড্রোজেনেটেড তেল ছাড়াও রান্নার কাজে একই তেল বার বার ব্যবহার করলে তাতেও ট্রান্সফ্যাট উৎপাদিত হয়।
ন্যাশনাল হার্ট ফাউন্ডেশন হাসপাতাল অ্যান্ড রিসার্চ ইনস্টিটিউটের রোগতত্ত্ব ও গবেষণা বিভাগের প্রধান অধ্যাপক সোহেল রেজা চৌধুরী বলেন, দেশে হৃদরোগ মহামারি আকারে ছড়িয়ে পড়েছে। এই ঝুঁকি মোকাবিলায় সরকারকেই উদ্যোগী হতে হবে। অনেক দেশ তাদের জনগণকে ট্রান্সফ্যাটের ঝুঁকি থেকে রক্ষা করার জন্য অনেক কিছু করছে; কিন্তু বাংলাদেশ এ ক্ষেত্রে অনেক পিছিয়ে। সরকারের উচিত, যত দ্রুত সম্ভব প্রক্রিয়াজাত ও শিল্প খাতে উৎপাদিত খাবারে ট্রান্সফ্যাটের মাত্রা নির্দিষ্ট করে দেওয়া। পাশাপাশি টিএফএর স্বাস্থ্য ঝুঁকি সম্পর্কে জনগণকে সচেতন করা। হাইড্রোজেনেটেড অয়েল ট্রান্সফ্যাট স্বাভাবিক অবস্থায় তরল থাকলেও ২০ ডিগ্রি সেলসিয়াসের নিচের তাপমাত্রায় যে চর্বি বা তেলজাতীয় পদার্থ জমাটবদ্ধ হয় তাও ট্রান্সফ্যাট। এ ছাড়া উচ্চ তাপমাত্রায় দাহ্য তেল বা চর্বিও ট্রান্সফ্যাটে রূপান্তর হয় এবং হার্টের যে কোনো রোগের জন্য দায়ী।