
প্রতীকী ছবি
মাঝে মাঝে রেনুর কিছুই ভালো লাগে না। ঘরভরতি লোকের মাঝেও তার ভীষণ একা লাগতে লাগে। বিয়ের মাত্র ছয় মাসের মাথায় স্বামীকে হারিয়ে একা রেনু। পাঁচ বছর পরও রেনুর সেই একাকিত্ব দূর হয়নি। যত দিন যাচ্ছে এই একাকিত্ব তাকে যেন কুরে কুরে খাচ্ছে।
তোতন-টুসীর বাবা যখন মারা যায় তখন তারা অনেক ছোট। মা শিউলী বেগম এক হাতে আগলে বড় করেছেন তাদের। মেয়েকে বিয়ে দিয়েছেন, এখন সে কানাডা থাকে। আর ছেলে নিজ যোগ্যতায় স্কলারশিপ নিয়ে পড়ছে জার্মানির একটি বিশ্ববিদ্যালয়ে। পড়া শেষে বিদেশেই সেটল হতে চায় ছেলে। আজ পেছন ফিরে তাকালে মনে হয় এক জীবন কেমন করে কাটিয়ে দিলেন তিনি। আজকাল প্রায়ই একাকিত্বে ভোগেন তিনি। মনে হয় আর কত দিন এই নিঃসঙ্গতার লড়াইটা চালিয়ে যেতে হবে।
উপরের ঘটনাগুলেতে একেকজনের জীবনের গল্প একেক রকম। কিন্তু রেনু, শিউলী বেগম- এই দুজনই একাকিত্বে ভুগছেন। হয়তো তাদের জীবনের রঙ এক না কিন্তু তাদের সমস্যা একই আর সেটা হলো তাদের একাকিত্ব। অনেক সময় মন না চাইলেও জীবন বাস্তবতায় মেনে নিতে হয় এই একা জীবনের দহনটুকু।
তবে কোনো কি উপায় নেই এই একাকিত্ব থেকে মুক্তির? আসলে একাকিত্ব কেন খারাপ বোধ করায় আমাদের? এর একটি বড় কারণ হলো আমরা নিজেদের আনন্দ, নিজেদের খুশির জন্য জাগতিক ও বস্তুগত বিষয় দ্বারা নিজেকে আবদ্ধ করে ফেলি। সুখ বা আনন্দের জন্য আমরা নিজের চেয়ে গুরুত্ব দেই অন্য বিষয়গুলোর প্রতি। অতীত আর ভবিষ্যতের চিন্তায় বর্তমানের গুরুত্বকে ভুলে যাই। তবে এটাও ঠিক সম্পর্কের শূন্যতা মানুষকে অনেক বেশি অসহায় করে দেয়। মানুষ তখন কোনোকিছুর বিনিময়েও সে শূন্যতা ভুলে যেতে পারে না। যতটা কথা অন্যের সঙ্গে আমরা বলি তত কথা কি আমরা কখনো নিজের ভেতরে কষ্ট পাওয়া, দুমড়েমুচড়ে ক্ষতবিক্ষত হয়ে যাওয়া আহত মানুষটার সঙ্গে বলি? উত্তর হলো, না।
আমরা ঘুরে ফিরে নিজের হাত ধরে সেই জায়গা বা সেই স্মৃতিগুলোর কাছে নিয়ে যাই, যেখানে গিয়ে বার বার ক্ষতবিক্ষত হই। আমরা ঘুরে ফিরেই এক যন্ত্রণাদায়ক ভবিষ্যতের চিন্তায় নিজেকে অস্থির করে ফেলি। কে জানে আপনার অচেনা পথে হয়তো এমন কিছু অপেক্ষা করে আছে যা কিনা আপনাকে বিগত দিনের সব কষ্টের উপর একধরনের মলমের প্রলেপ বুলিয়ে দেবে। সাময়িক এই শূন্যতার হাত ধরে এমন এক জীবনে পৌঁছে যেতে পারেন যে জীবনটা আপনার আরাধ্য ছিল, চাওয়া ছিল। এই একা জীবনে সেই শখটা আবার শুরু করতে পারেন। কখনো কাঁধে একটি ব্যাগ ঝুলিয়ে চলে যেতে পারেন দূর কোনো অচেনা গাঁয়ে! অথবা শৈশবের বন্ধুদের সঙ্গে আবার যোগাযোগ শুরু করতে পারেন। পরিচিত যারা খারাপ সময়ে আপনার পাশে ছিল, সাহস জুগিয়েছে তাদের সঙ্গে যোগাযোগ রাখুন, সামাজিক বিভিন্ন অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ করুন। সবসময়ই মনটা ইতিবাচক রাখুন, প্রফুল্ল রাখুন।
এড়িয়ে চলুন সেই সব মানুষ, সেই স্থান যা আপনার মনকে বিষণ্ণ করে, একা করে দেয়। তার চেয়ে বরং নিজের প্রিয় কোনো বই পড়ুন অথবা আপনার ভালো লাগে সেরকম কোনো বিষয়ের চর্চা করুন। সিনেমা দেখুন, শপিং করুন, বা ঘুরে বেড়ান, বারান্দার ছোট্ট বাগানের ফুলের হাসি উপভোগ করুন। আমরা আমাদের একাকিত্ব দূর করতে পারি যদি ইচ্ছা থাকে এবং নিজের জীবনটাকে যদি কিছু হলেও ভালোবেসে থাকি। মনস্তত্ত্ববিদ ডোনাল্ড উইনিকট মনে করেন একাকিত্ব হচ্ছে নিজের কাছে প্রত্যাবর্তন। তার মতে, একাকিত্বের অভিজ্ঞতা আপনাকে আপনার নিজের কাছে পৌঁছে দেবে এবং ক্রমেই এই একাকিত্ব আপনার কাছে ভালো লাগতে শুরু করবে। কেননা এই পৃথিবীতে আপনার সঙ্গে আপনার সম্পর্কটাই একমাত্র বিষয় যেটা পরিবর্তিত হবে না। বাকি সব কিছুই পরিবর্তনশীল।
তাই বাস্তবতাকে ইতিবাচকভাবে গ্রহণ করুন। আপনার একা জীবনের অনেক সুবিধার মধ্যে একটি হলো এখানে আপনি পূর্ণ স্বাধীন, এই স্বাধীনতাকে উপভোগ করুন। নিজের সঙ্গে নিজের এক দারুণ সম্পর্ক গড়ে তুলুন। আনন্দময়তা আপনার ভেতরে অন্য কেউ তৈরি করে না, আপনিই এটা তৈরি করেন। জীবন কখনো সম্পূর্ণ হয় না, জীবনের কোথাও না কোথাও একটু অপূর্ণতা, একটু ক্ষত রেখে দেয়। আর এই অসম্পূর্ণতাই হলো জীবনের সৌন্দর্য। স্বামী বিবেকানন্দ বলতেন, ‘একাকিত্ব তোমায় যা শেখাবে পৃথিবীর ভালো কোনো বই তোমায় সেটা শেখাতে পারবে না।’
তাই একা হতে ভয় পাবেন না। বরং একা থাকার কিছু ভালো বিষয়ও আছে। যেমন- সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে সাহায্য করে, সৃজনশীল গুণাবলি বৃদ্ধিতে সহায়তা করে, শক্তিশালী ও আত্মবিশ্বাসী মানুষ হিসেবে তৈরি করে। তাই একা থাকা উপভোগ করার পাশাপাশি আপনার নতুন নতুন মানুষ, স্থান ও সম্পর্কগুলোকে স্বাগত জানান।