Logo
×

Follow Us

লাইফস্টাইল

গালি দিয়ে এত সুখ কেন?

Icon

বিশেষ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ৩১ জুলাই ২০২১, ০৭:৫৮

গালি দিয়ে এত সুখ কেন?

বিব্রতকর মুহূর্ত

রাস্তায় গাড়িকে আচমকা বিপজ্জনকভাবে ওভারটেক করে চলে গেল আরেকটা গাড়ি, অথবা কাপ থেকে হঠাৎ পড়ে গেল কফি কিংবা পথ চলতে গিয়ে হঠাৎ বেখেয়ালে পা আটকে হোঁচট খেলে তীব্র যন্ত্রণাবোধের সাথে সাথেই সবচেয়ে নম্র-ভদ্র লোকটির মুখ থেকেও বেরিয়ে আসে গালি। এ পরিস্থিতিতে প্রায় সহজাত প্রবৃত্তির মতই বেছে নেয়া হয় অশ্লীল শব্দ, আর সেগুলো মুখ দিয়ে উগরে দেবার সাথে সাথেই, প্রায় জাদুমন্ত্রের মত আমরা আরাম বোধ করি। প্রশ্ন হচ্ছে বিব্রতকর মুহূর্তগুলোতে মুখে শুধু গালি-ই আসে কেন?  মানুষ কী ইচ্ছে করেই গালি দেয়? নাকি এর পেছনে কোনো সুনির্দিষ্ট যুক্তি আছে?

মনোবিজ্ঞানীরা বলছেন, বিব্রতকর মুহূর্তে মানুষ যা করে তার সবগুলোই নিয়ন্ত্রণ করে মস্তিষ্ক। আনন্দ, চরম বিস্ময়, বা গভীর দুঃখ, বেদনা, বা ক্রোধ- যে কোন রকম পরিস্থিতিতেই মানুষ গালি দেয়। গালি দেয়াটা মানুষের আবেগের সাথে এত গভীরভাবে সম্পর্কিত যে ওই শব্দগুলো উচ্চারণের জন্য যে মাংসপেশির নড়াচড়ার দরকার হয়, তা একাধিক জায়গায় ধারণ করা থাকে। যাতে দরকার মতো ব্যবহারের জন্য ‘ব্যাকআপ’ থাকে।

মনোবিজ্ঞানীরা জানান, কোন কষ্ট বোধ হলে অনেকে গালি দিয়ে থাকে যা কষ্ট ও যন্ত্রণা সহায়ক। অনেক সময় ভদ্র শব্দে গালির মত আবেগ প্রকাশ করা যায় না। সাধারণ শব্দ ব্যবহারের তুলনায় গালি দেবার সময় মানুষের হৃৎপিণ্ডের গতি বেড়ে যায় বলে গবেষকরা দেখেছেন। এর ফলে সবার মধ্যেই একধরনের আবেগগত প্রতিক্রিয়া হয়।

মানুষ গালি দিয়ে আরাম পায়, কিন্তু কেন? এটা কি আমরা জেনে বুঝেই করি, নাকি আমরা যখন অশিষ্ট ভাষা ব্যবহার করি তখন আমাদের মস্তিষ্কে এবং দেহে সত্যি কিছু একটা পরিবর্তন হয়? হ্যা হয়। এ নিয়ে বেশকিছু গবেষণাও হয়েছে উন্নত বিশ্বে।  

যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক অ্যাসোসিয়েশন অব সাইকোলজিক্যাল সায়েন্সে বেশ কয়েক বছর আগে একটি গবেষণামূলক নিবন্ধ প্রকাশিত হয়েছিল। লেখক ছিলেন মনোবিদ টিমোথি জে। নিবন্ধের শিরোনাম ছিলো, ‘দ্য ইউটিলিটি অ্যান্ড ইউবিকুইটি অব ট্যাবু ওয়ার্ডস’। তাতে লেখক বলেছেন, গালি দেয়াটা অনেকটা গাড়ির হর্ন বাজানোর মতো। রাগ, হতাশা, আনন্দ বা বিস্ময়-এমন আবেগের তীব্রতা বোঝানোর জন্য মানুষ এ ধরনের শব্দ ব্যবহার করে থাকে। আবার অন্যের প্রতিক্রিয়া দেখার জন্যও অনেক সময় অশ্রাব্য শব্দ ব্যবহার করা হয়। এ ক্ষেত্রে মূলত অন্যের চরিত্রের ভিন্নরূপ বের করে আনার চেষ্টা থাকে।

এ গবেষণাপত্রে আরো বলা হয়েছে, গালিগালাজ বা কটু শব্দ কিছু ক্ষেত্রে মানুষের জন্য ইতিবাচকও হয়। এতে মানুষ নিজের রাগ, ক্ষোভ, হতাশা ইত্যাদি নিখুঁত মাত্রায় প্রকাশ করতে পারে। সেই সাথে শারীরিকভাবে আগ্রাসী হওয়ার প্রতিস্থাপকও হতে পারে গালিগালাজ।

গালি বিষয়ে একজন বিশেষজ্ঞ ড. এমা বার্ন। তিনি একটি বই লিখেছেন যার শিরোনাম ‘সোয়ারিং ইজ গুড ফর ইউ‘’ - অর্থাৎ ‘গালি দেয়া আপনার জন্য ভালো!’  সেখানে তিনি বলছেন, গালি হচ্ছে এমন এক ধরনের ভাষা যা আমরা চমকিত বা স্তম্ভিত বা উৎফুল্ল হলে ব্যবহার করি, অথবা ব্যবহার করি মজা করার জন্য বা কারো প্রতি আক্রমণাত্মক হবার জন্য। তবে এটা এমন একটা সাংস্কৃতিক ব্যাপার যা শুধু একটা জনগোষ্ঠী, ভাষা, সমাজ, দেশ বা ধর্মের মধ্যেই অর্থপূর্ণ হতে পারে। তিনি বলছেন, প্রকৃতপক্ষে কোন শব্দটা একটা গালি হয়ে উঠবে তা আমরা সবাই মিলেই ঠিক করি।

ড. বার্ন বলছেন, তার গবেষণার সময় যে বিষয়গুলো সবচেয়ে আগ্রহ-উদ্দীপক বলে মনে হয়েছে তার একটা হলো - যে মানুষদের হেমিস্ফিয়ারেকটমি বলে এক ধরণের মস্তিষ্কের অপারেশন হয়েছে - তারা কথা বলার ক্ষমতা অনেকটা হারিয়ে ফেললেও গালি দেবার ক্ষমতা রয়ে যায়। 

গালি সব সমাজেই আছে। ঔপনিবেশিক কারণে পশ্চিমাদের প্রতি আমাদের ভক্তিভাব প্রবল। বিদেশি বলতে আমরা সাদা চামড়াই বুঝতে চাই। তাদের ‘ভদ্র’ ও ‘সভ্য’ বলে মনে করা হয়। পশ্চিমা সেসব সমাজেও কিন্তু গালি আছে প্রবলভাবে। তাদের ভাষা ও দৈনন্দিন কথাবার্তাতে গালির দেখা হরহামেশা মেলে। এটি বোঝার জন্য ইউরোপ-আমেরিকায় শিক্ষাসফরের প্রয়োজন নেই। বিভিন্ন স্ট্রিমিং সাইটে ইংরেজি ভাষাভাষী চলচ্চিত্র দেখলেই কিছুটা বোঝা যাওয়ার কথা।

আমাদের দেশে গালি সংস্কৃতির ভিন্নতা আছে। এখানে গালির মধ্য দিয়ে একজন মানুষকে সামাজিক ও ব্যক্তিগতভাবে হেয় করার যে সংস্কৃতি কিছুদিন হলো চালু হয়েছে, সেটি মৌলিক। সবচেয়ে বড় বিষয়, সেই গালিগালাজে যুক্তির ব্যবহার খুব একটা থাকে না। কারও প্রতি রাগ বা ক্ষোভ প্রকাশের জন্যই সব সময় গালি ব্যবহার হচ্ছে না। অবস্থা হয়েছে এমন, ‘রাস্তা দিয়ে হাঁটছিলাম, একজনকে দেখলাম, একটা গালি দিয়ে দিলাম।’ 

এমন পরিস্থিতি আরো সহজে সৃষ্টি হয়েছে সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যম, অর্থাৎ ফেসবুক, টুইটার, ইনস্টাগ্রামের সৌজন্যে। এসব প্ল্যাটফর্মে কথা বলতে যেহেতু  পয়সা খরচ হয় না এবং যে কাউকে হাতের আঙুলের নাগালে পাওয়া যায়, তাই কোনো কারণ ছাড়াই যে কাউকে গালি দেয়ার একটা প্রবণতা গড়ে উঠেছে। সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমে জনপ্রিয় যেকোনো ব্যক্তিকে জিজ্ঞাসা করলেই এর সত্যতা পাওয়া যাবে। আর সবচেয়ে কুৎসিত রূপটি দেখার জন্য যেকোনো জনপ্রিয় বা ‘সেলিব্রেটি’ ব্যক্তির ফেসবুক বা ইনস্টাগ্রাম পেজ ঘুরে আসা যায়। ঘুরে আসা যায় কোনো সংবাদমাধ্যমের ফেসবুক পেজের ফিড থেকেও। একটু লক্ষ করলেই দেখা যাবে, কী অবলীলায় চলছে গালির মহোৎসব! গালি দেয়া সেখানে ওয়ান-টুর ব্যাপার। 

কোনো দেশের মানুষের মধ্যে যদি জাতীয় পরিসরে রাগ, ক্ষোভ, হতাশা পুঞ্জীভূত হতে থাকে, তবে? অনেকেই  বলছেন, দেশের মানুষের মধ্যে এ ধরনের হতাশা বা ক্ষোভ আছে। কারণ, জাতীয় পর্যায়ে এমন ক্ষোভ প্রকাশ করার সুযোগ পান না নাগরিকেরা। সরকারের বা রাষ্ট্রীয় নীতির সমালোচনা করা এখানে কঠিন। এর একটি প্রতিক্রিয়া যে নাগরিক জীবনে ও আচরণে প্রতিফলিত হচ্ছে, তা কি অস্বীকার করা যাবে? 

Logo

সম্পাদক ও প্রকাশক: ইলিয়াস উদ্দিন পলাশ

বার্তা ও বাণিজ্যিক কার্যালয়: ফেয়ার দিয়া ১১/৮/ই, ফ্রি স্কুল স্ট্রিট (লেভেল-৮), বক্স কালভার্ট রোড, পান্থপথ, ঢাকা ১২০৫