
প্রতীকী ছবি।
‘জিঞ্জির’ কাব্যগ্রন্থের অন্তর্গত ‘অগ্র-পথিক’ কবিতায় জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম লিখেছেন, ‘প্রাণ-চঞ্চল প্রাচী-র তরুণ, কর্মবীর/হে মানবতার প্রতীক গর্ব উচ্চশির!’ কবির এ কথার সঙ্গে সবাই বোধহয় একমত হব। বলাবাহুল্য, একটি সমাজ এগিয়ে চলে মূলত তরুণ সমাজের কাঁধে ভর করেই। তরুণ বলতে কৈশোর উত্তীর্ণ নারী ও পুরুষ উভয়কেই বোঝানো হয়। তারা হয় সমাজের সবচেয়ে বেশি উদ্যমী আর কর্মঠ সদস্য। এই তরুণেরা যখন সমাজের জন্য বোঝা হয়ে যায়, তখন সেই সমাজ মুখ থুবড়ে পড়তে বাধ্য।
বর্তমানে বলা চলে, আমাদের তরুণ সমাজ নানা সমস্যায় জর্জরিত। তরুণদের বড় একটি অংশই সোশ্যাল মিডিয়া, অনলাইন গেমিং ও জুয়ায় আসক্ত। অপর আরেকটি অংশ ডুবে আছে মাদকের অন্ধকার দুনিয়ায়। মাদক শিক্ষার্থীদের জন্য যে ভয়ানক একটি ব্যাধি তা বলার অবকাশ রাখে না। এর পরও গ্রামগঞ্জ, শহর, স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয় —মাদকের ভয়াল থাবা থেকে রেহাই পাচ্ছে না তরুণরা। পুরনো মাদকের পাশাপাশি নিত্যনতুন মাদকের সহজলভ্যতার কারণে শত শত তরুণ মাদকাসক্ত হয়ে পড়ছে। ফলে দেশের অর্থনৈতিক ও শিক্ষার ব্যাপক ক্ষতি হচ্ছে। সর্বোপরি মাদকের কারণে দেশ ও সমাজে তৈরি হচ্ছে অস্থিতিশীলতা, নষ্ট হচ্ছে ভারসাম্য।
কিন্তু এসব আলেয়ার হাতছানি উপেক্ষা করে তরুণদের মনে রাখতে হবে, টগবগে যে সম্ভাবনা লুকিয়ে থাকে প্রতিটি মানুষের ভেতর, তা প্রকাশ হতে থাকে তরুণ বয়সেই। সম্ভাবনার একটি দরজা বন্ধ হলে আরও হাজারটি দরজা দেখতে পায় তারুণ্য। কৈশোরের আবছায়া দোলাচল কাটিয়ে স্পষ্টত নিজেকে প্রকাশ করার সগৌরব সময় এটি। সত্যকে সত্য এবং মিথ্যাকে মিথ্যা বলতে পারার পরম সাহস সঞ্চয়ের সময় এই তরুণ বয়স। তারুণ্য একই সঙ্গে উদারতা আর আপসহীনতার নাম। ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র স্বার্থ ছেড়ে মানুষের কল্যাণে জীবনটা কাটানোর শপথও গ্রহণ হয় এই বয়সেই।
মনে রাখতে হবে, বিশ্বে প্রযুক্তি, শিক্ষা, চিকিৎসা, স্থাপত্য, বিজ্ঞান —প্রতিটি ক্ষেত্রেই সম্ভাবনার দ্বার খুলে দিচ্ছে তরুণরা। মির্জা গালিব বলেছেন, ‘দুটি বাতি আলাদা আলাদা জ্বললেও তাদের আলো পরস্পরের সঙ্গে মিশে যায়।’ তারুণ্যের শক্তিও ঠিক তেমন। পরস্পরের মেধা, বুদ্ধি, জ্ঞান মিলেমিশে নতুন পৃথিবী তৈরি করাই তারুণ্যের সাফল্য।
তরুণদের প্রতি সরকার, সমাজ ও পরিবারের দায়িত্ব: তরুণদের বিপথে চলে যাওয়া রোধে এগিয়ে আসতে হবে দেশের সরকার, সমাজ ও পরিবারকে। সরকারি অনুদানে গড়ে তুলতে হবে পাবলিক লাইব্রেরি ও প্রশিক্ষণ কেন্দ্র। মাদকের বিরুদ্ধে শাস্তির বিধানের পাশাপাশি গড়ে তুলতে হবে সামাজিক সচেতনতা। বই পড়ার অভ্যাস গড়ে তোলা এবং মাদক থেকে তরুণদের দূরে রাখতে সুশীল সমাজকে কার্যকরী ভূমিকা পালন করতে হবে।
একজন জ্ঞানসমৃদ্ধ, নীতিবান ও দক্ষ মানুষ গড়ে তোলার প্রথম ধাপ শুরু হয় শৈশব থেকেই। এই ক্ষেত্রে পরিবার ও শিক্ষকদের ভূমিকাই মুখ্য। প্রতিটি পরিবারের দায়িত্ব সন্তানকে শৈশব থেকেই নিজ ধর্মীয় শিক্ষায় শিক্ষিত করা, সমাজের আচার ব্যবহার ও রীতিনীতি সম্পর্কে শিক্ষা দেওয়া। যাতে তার মধ্যে নৈতিকতা জাগ্রত হয়, সৃষ্টি হয় পরিমিতিবোধ। সেই সঙ্গে শিক্ষকদের দায়িত্ব নানাবিধ জ্ঞানদানের মাধ্যমে তাদের আরও সমৃদ্ধ করা। অতঃপর রাষ্ট্রের দায়িত্ব একজন নাগরিকের উচ্চশিক্ষা ও দক্ষতা অর্জনের জন্য সুষ্ঠু পরিবেশ সৃষ্টি করা এবং তার যথাযথ কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করা। আমাদের মনে রাখতে হবে, যত দিন যে দেশ ও সমাজ তার তরুণদের প্রাণে সম্ভাবনার আলো জ্বালতে সক্ষম হয়েছে, তাদেরকে মূল্যায়ন ও সঠিক পথ প্রদর্শন করতে পেরেছে, সে দেশ ও সমাজের মুখ পৃথিবীর বুকে তত বেশি উজ্জ্বল হয়েছে।