দৃশ্যদূষণ

কবি শঙ্খ ঘোষ লিখেছিলেন, ‘মুখ ঢেকে যায় বিজ্ঞাপনে’। হঠাৎ কেন বিজ্ঞাপনের কথা বলছি? কারণ এসব বিজ্ঞাপন পরিবেশকে দূষিত করছে। যাকে বলা হচ্ছে ভিজ্যুয়াল দূষণ কিংবা দৃশ্যদূষণ। কী এই দৃশ্যদূষণ?

সব সময় বায়ুদূষণ, শব্দদূষণ, পানিদূষণের কথা শুনি। দৃশ্যদূষণের কথা খুব একটা শোনা যায় না। দৃশ্যদূষণ মূলত কোনো একটি দৃশ্য দেখার ক্ষমতা কমায় বা দেখার দৃষ্টিভঙ্গিতে প্রভাব ফেলে। আরেকটু সহজ করে বললে, দৃশ্যদূষণ প্রাকৃতিক পরিবেশে নেতিবাচক পরিবর্তন আনে। সেই পরিবর্তন এমন যে, কোনো একটি দর্শনীয় স্থান দেখতেও বিরক্তিকর লাগে। সেটা হতে পারে কোনো পর্যটন স্পট, কোনো ছবি, কোনো ভাস্কর্য কিংবা কোনো স্থাপনা। রাজধানী ঢাকাসহ অন্যান্য শহরেও দৃশ্যদূষণ মারাত্মক আকার ধারণ করেছে। 

কীভাবে হয় দৃশ্যদূষণ

প্রচারণার খুব প্রাচীন কৌশল বিজ্ঞাপন। দেশ-বিদেশে যে কোনো প্রচারণার জন্য বিজ্ঞাপন খুব জনপ্রিয় মাধ্যম। কিন্তু উন্নত দেশগুলোতে বিজ্ঞাপনের জন্য কিছু নীতি মেনে চলা হয়। কিন্তু আমাদের দেশে এ ধরনের নীতিমালা মেনে চলা হয় না। ফলে রাজধানী ঢাকাসহ অন্য শহরগুলো দৃশ্য দূষণের ভয়াবহ কবলে পড়েছে। আজকাল এসব শহরের প্রকৃতি কুৎসিতভাবে ঢাকা পড়েছে। এমনকি আকাশটাও ঢেকে গেছে নানারকম তারের জঞ্জালে। চমৎকার সব স্থাপনার সামনে ঝুলছে বিজ্ঞাপন, পোস্টার, ব্যানার, দেয়াল লিখন ইত্যাদি। রাস্তার পাশের স্থাপনা দেয়াল, বৈদ্যুতিক খুঁটি, উড়াল সেতুর পিলার দখল করে নিয়েছে পোস্টার, ব্যানার। আকাশ দখল করে নিয়েছে বিদ্যুৎ, ইন্টারনেট ও ডিশ লাইনের তার। পুরো শহরকে মাকড়সার জালের মতো ঘিরে রেখেছে এসব তার। এসব দৃশ্য দেখতে বিরক্তি লাগে, চোখ ক্লান্ত হয়ে যায়।

বড় বড় শহরে যেসব বসতি গড়ে উঠেছে, তার বেশিরভাগ অপরিকল্পিত। অনেক বড় বড় ভবন গড়ে উঠেছে, অথচ সেগুলো নান্দনিক নয়। একটার সঙ্গে আরেকটা লাগোয়া। দুই ভবনের মাঝখানে ফাঁকা জায়গা নেই। সূর্যের আলো কোনো ভবনে ঠিকমতো পৌঁছতে পারে না। তাই এ ধরনের ভবন দেখতে ভালো লাগে না। এই ভালো না লাগাটাই হলো দৃশ্যদূষণ।

শহরের নদীগুলোর অবস্থাও ভালো না। শহরের ভেতর দিয়ে বয়ে যাওয়া বেশিরভাগ নদী ও খালের পানি কালো রঙের। এতে শুধু পানি ও খালদূষণ হচ্ছে না। বরং এটাও একটা দৃশ্যদূষণ। কারণ এই নদীর পানির দিকে তাকালে মানুষের মধ্যে বিরক্তি চলে আসে। অস্থিরতা কাজ করে। চোখ ক্লান্ত হয়ে যায়। অথচ এই নদীগুলো শহরের সৌন্দর্য বর্ধনে ভালো অবদান রাখতে পারত।

দৃশ্যদূষণের কারণে কী হয়

দৃশ্যদূষণ মানুষের ওপর বেশ কিছু প্রভাব ফেলে। যেমন-মানসিক বিভ্রান্তি ও অবসাদ, মতামত প্রকাশের ক্ষমতা কমে যাওয়া, পরিচয়হীনতা, রাস্তায় যানজট, বিভিন্ন ধরনের স্বাস্থ্যঝুঁকি, মানসিক অস্থিরতা ও অসুস্থতা, চোখের সমস্যা, নান্দনিকতা বোধ কমানো, কমিউনিটির সামগ্রিক ক্ষতি ইত্যাদি প্রভাব ফেলে। 

যেসব শিশু শৈশব থেকে দৃশ্যদূষণের সংস্পর্শে এসেছে, তারা প্রায়ই অপ্রীতিকর পরিবেশের সঙ্গে অভ্যস্ত হয়ে পড়ে ও তাদের স্বাভাবিক আবেগ হারিয়ে যাচ্ছে। এর বাইরে দৃশ্যদূষণ একটি দেশের পর্যটন খাতে বিরূপ প্রভাব ফেলে। যখন কোনো দেশের পর্যটন স্পটগুলো দৃশ্যদূষণের শিকার হয়, তখন পর্যটকরা সেই জায়গা ঘুরতে যেতে চায় না।

গবেষণা কী বলছে

দৃশ্যদূষণ নিয়ে গবেষণায় উঠে এসেছে ভয়ংকর তথ্য। এনভায়রনমেন্ট অ্যান্ড সোশ্যাল ডেভেলপমেন্ট অর্গানাইজেশনের (এসডো) ‘ভিজ্যুয়াল পলিউশন ইন দ্য সিটি অব ঢাকা : অ্যা পাবলিক হেলথ, এনভায়রনমেন্ট অ্যান্ড ট্রাফিক ডিসট্রাকশন’ শীর্ষক গবেষণা প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, দৃশ্যদূষণের কারণেচোখের নানা রোগ ও মানসিক সমস্যার সৃষ্টি হচ্ছে। ঢাকা শহরে প্রায় দুই লাখ ৭০ হাজার শিশু চোখের নানা রোগে এবং মাথাব্যথায় আক্রান্ত হচ্ছে। বিলবোর্ড, তারযুক্ত বিদ্যুতের খুঁটি ও বিদ্যুৎ বিতরণ নেটওয়ার্ক, কুয়াশা, গ্রাফিতিকে দৃশ্যদূষণের উদাহরণ হিসেবে দেখিয়েছে এসডো। এগুলো সৌন্দর্য উপভোগে জনগণকে বাধা দেয়। তারা বলছে, দৃশ্যদূষণের মাধ্যমে প্রাকৃতিক সৌন্দর্য ও মানবসৃষ্ট আবাসভূমি নষ্ট হওয়ায় বাস্তুসংস্থানের ক্ষতি হচ্ছে। গবেষণার ফলাফল অনুযায়ী, দৃশ্যদূষণ নিয়ে জনসচেনতার হার খুবই কম। প্রায় ৯৫ শতাংশ নগরবাসীর এ বিষয়ে কোনো ধারণা নেই।

সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh