
প্রয়াত কবি, শিক্ষাবিদ, রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব ও সাংসদ কৃষ্ণা বসু।
মানুষ মরণশীল। মানুষ মৃত্যুবরণ করে এটাই স্বাভাবিক।
কিন্তু কোনো কোনো প্রিয় মানুষ যখন চিরতরে ছেড়ে যান আমাদেরকে তখন বুঝি শোকে-সন্তাপে মুহ্যমান হয়ে যেতে হয়। স্বনামধন্য কবি, শিক্ষাবিদ, রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব এবং সাংসদ কৃষ্ণা বসু ইহলোকত্যাগ করে চলে গেলেন ২২ শে ফেব্রুয়ারি। তাঁর সঙ্গে কোনোদিন আমি কোনোদিন সাক্ষাৎ করতে পারিনি, সেই সৌভাগ্যবান নই। কিন্তু নেতাজির কারণে তিনি ছিলেন আমার অন্তরের মানুষ। তাঁর অনেক কবিতা পড়েছি, প্রবন্ধ পড়েছি। নেতাজি ও জাপান নিয়ে তাঁর একটি ধারাবাহিক গবেষণামূলক প্রবন্ধ পড়েছিলাম দেশ পত্রিকায়। কতকিছু জানতে পেরেছিলাম। নেতাজির ঘনিষ্ঠ সহকর্মী এবং ভক্ত প্রায় ৪০ জন মিলে Subhas Chandra Bose Academy গঠন করেছিলেন ১৯৫৮ সালে । সংগঠনের প্রেসিডেন্ট ছিলেন মনে হয় রেনকোওজি বৌদ্ধমন্দিরের প্রধান পুরোহিত রেভারেন্ড মোচিজুকি কিয়োওয়েই। ডেপুটি প্রেসিডেন্ট ছিলেন শ্রীমতী এমোরি কিকুকো। পরের বছর শ্রীমতী নেতাজির আত্মীয় অমিয়নাথ বসুর আমন্ত্রণে কলকাতায় গিয়েছিলেন এলগিন রোডে নেতাজির স্মৃতি জাদুঘর নির্মাণের পরিকল্পনা নিয়ে, নিশ্চয়ই তখন কৃ্ষ্ণা বসুর সঙ্গে সাক্ষাৎ হয়েছিল।
১৯৩০ সালে ঢাকায় জন্ম কৃষ্ণা বসু ছিলেন নেতাজির ভ্রাতুষ্পুত্র শিশির বসুর সহধর্মিণী । ১৯৭৯ সালে দুজনকে সুভাষচন্দ্র একাডেমী জাপানে আমন্ত্রণ জানালে তাঁরা আগমন করেন। তাঁদেরকে এক উষ্ণ সংবর্ধনা জানানো হয় টোকিওর ইচিগায়া কাইকান মিলনায়তনে। এই তথ্য জানা যায় একাডেমীর একটি স্মারক গ্রন্থে। জানি না কৃষ্ণা বসু জাপানের অভিজ্ঞতা নিয়ে কিছু লিখেছিলেন কিনা? রবীন্দ্রগবেষক নেতাজিভক্ত অধ্যাপক কাজুও আজুমার মুখে কৃষ্ণা বসুর গল্প শুনেছি আমি।
সুভাষচন্দ্র বসু একাডেমীর কর্মসচিব ছিলেন নেতাজির সহযোগী বলে দাবিদার হায়াশি মাসাও, তাঁর সঙ্গে আমার গভীর সম্পর্ক গড়ে উঠেছিল। তিনি বলেছিলেন, শিশির বসু এবং কৃষ্ণা বসু রেনকোওজি বৌদ্ধ মন্দিরে গিয়েছিলেন যেখানে নেতাজির চিতাভস্ম সংরক্ষিত আছে। এই নিয়ে বিস্তর বিতর্ক বিদ্যমান। শিশির বসুর প্রস্তাবেই কি মন্দির প্রাঙ্গণে নেতাজির আবক্ষ ভাস্কর্য স্থাপিত হয়েছে কিনা জানা নেই। ভাস্কর্যটি ১৯৯০ সালে শ্রীমতী এমোরির কন্যা মাৎসুজিমা কাজুকোর উদ্যোগে স্থাপিত হয়েছিল। ১৯৫৭ সালে প্রধান মন্ত্রী নেহরু কন্যা ইন্দিরা গান্ধী সহ জাপান সফর কালে রেনকোওজি মন্দিরে নেতাজির চিতভস্ম দেখতে যান। স্মারক গ্রন্থে তিনি যে বাণী লিখেন তাতে নেতাজির কোনো কথাই ছিল না!
২০১৩ সালের ১৩ তারিখে হঠাৎ করেই নীরবে চলে গেলেন আমার আরেকজন অত্যন্ত প্রিয় মানুষ তোজো ইউকো সান। বয়স হয়েছিল ৭৪। ডিসেম্বর মাসে দেখা করতে গেলে বললেন, দুসপ্তাহের জন্য হাসপাতালে ভর্তি হবেন। দুশ্চিন্তার কারণ নেই। তবে রোগটা বেশ জটিল, বিষণ্ন কণ্ঠে জানালেন।
পুনরায় হেসে বললেন, বয়স হয়েছে। কিছু একটা হয়ে গেলে কিছুই করার নেই।
মনটা সেই থেকে ভার হয়েছিল। এক মাস পর ফোন করে তাঁকে পেলাম না। আমরা যাঁরা তাঁর সঙ্গে ঘনিষ্ঠ কেউ বলতে পারছেন না, তোজোসানের শারীরিক অবস্থা কী রকম। ফোন বাজে ফোন কেউ রিসিভ করে না। দুশ্চিন্তায় কালাতিপাত করছিলাম।
১৪ তারিখ সন্ধেবেলা তাকারাদা সেনসেই (স্যার) ফোন করে দুঃসংবাদটি জানালেন। বুকের ভেতরটা কেমন করে উঠল সহসা! সেখানে টের পেলাম বিশাল একটা শূন্যতা নীরবে ডুকরে ডুকরে কেঁদে উঠছে।
তোজোসান ছিলেন আমার এক যুগেরও বেশি সময়ের বন্ধু ও পরম শুভাকাঙ্খী। বন্ধু রফিক পরিচয় করিয়ে দিয়েছিল। যেই শুনলেন আমি রবীন্দ্রনাথ-জাপান সম্পর্ক, প্যান-এশিয়ানিজম নিয়ে গবেষণা করছি শুনে আমার সঙ্গে কথা বলতে আগ্রহী হয়েছিলেন। সাক্ষাৎকালে জানতে পারি তিনি প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী তোজো হিদেকির দৌহিত্রী। লড়াই করছেন ঠাকুর্দার হৃত গৌরব ও ভাবমূর্তি ফিরিয়ে আনার জন্য। বই লিখেছেন একাধিক যেগুলোতে অজানা সব তথ্য। সেগুলো আমাকে দিলেন। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধপূর্ব থেকে টোকিও মিলিটারি ট্রাইব্যুনাল পর্যন্ত বহু তথ্য ও ঘটনার হদিশ তাঁর কাছেই পেলাম। তোজো হিদেকিকে ঘিরে জাপানের হৃত গৌরবকে ফিরিয়ে আনার লড়াইয়ে তিনি জগৎখ্যাতি লাভ করেছেন। দেখিয়ে দিয়েছেন চেষ্টা করলে মানুষ জয়ী হয়, এবং সত্য কোনোদিন চাপা থাকে না। আমি বরাবরই তোজো হিদেকির ভক্ত। তাঁকে নিয়ে গবেষণা করার সময় অনেক তথ্য আমি পেয়েছি এই ইউকো সানের কাছ থেকে। সেটি দীর্ঘ এক প্রবন্ধ আমার লিখিত [জানা অজানা জাপান] ২য় খণ্ডে অন্তর্ভুক্ত আছে।
২০০০ এর দিকে আমেরিকা থেকে এসেছিলেন জাপানে ইন্টারনেট এর ব্যবসা করার জন্য বিশিষ্ট বাঙালি বিজ্ঞানী ড.এমদাদ হোসেইন। রফিক, আমি, ওওৎসুকা স্যার এবং তোজোসান নানাভাবে সাহায্য করেছি তাঁকে। তারপর রফিক বাংলাদেশ ইকোনোমিক ডেভেলপমেন্ট অ্যাসোসিয়েশন (বেডা) গঠন করলে তার অন্যতম পরিচালক হয়েছিলেন তোজোসান। একাধিক অনুষ্ঠান আমরা করেছি। তাঁর অফিসের কপিয়ার মেশিনে প্রচারপত্র কপি করেছি বিনামূল্যে।
২০০২ সালে জাপান-বাংলা শিক্ষা-সাংস্কৃতিক বিনিময় সম্পর্কের শতবর্ষ উপলক্ষে আমরা গিয়েছিলাম নাগানো জেলার কারুইজাওয়া শহরে সেখানে রবীন্দ্রনাথের স্মৃতিবিজড়িত স্থানে একটি আবক্ষ মূর্তি আছে কবিগুরুর। সেখানে ভ্রমণ করেছিলাম। যেহেতু তিনি রবীন্দ্রভক্ত খুব খুশি হয়েছিলেন।
২০০৩ সালে আড্ডা টোকিও পাঠচক্র থেকে প্রথম কবিতা সম্মেলন করি তখন তিনি এসেছিলেন। গুণদা তথা কবি নির্মলেন্দু গুণ, অধ্যাপক ড. পেমা গিয়ালপো, আইটি বিশেষজ্ঞ ওওৎসুকা তোশিআকি উপস্থিত ছিলেন। তাঁদের একটি চমৎকার আলোকচিত্র তুলেছিলাম আমি। গুণদা এবং তোজোসান দুজনেই খুশি হয়েছিলেন এই অপ্রত্যাশিত সাক্ষাতে। সাপ্তাহিক ২০০০ কাগজে গুণদা লিখেছিলেন এই অনুষ্ঠানের কথা ও তোজোসানের প্রসঙ্গ।
এইসময় কলকাতা থেকে এসেছিল বিশ্বভারতীর কর্মকর্তা বিশিষ্ট লেখক ও চিত্রশিল্পী অনুজপ্রতিম বন্ধু নীলাঞ্জন বন্দ্যোপাধ্যায়, তার খুব প্রিয় ব্যক্তিত্ব জেনারেল তোজো হিদেকি। সে তাঁর নাতনীর সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে চায়। সাক্ষাৎ করিয়ে দিয়েছিলাম। রবীন্দ্রনাথের একটি ছবি সে তোজোসানকে উপহার দিয়েছিল। খুব আনন্দিত হয়েছিল নীলাঞ্জন। তোজোসানের বদান্যতায় আমরা ২০০৫ সালে টোকিওর ইয়াসুকুনি জিনজার একেবারে উপরে উঠে মন্দিরের গুরুত্বপূর্ণ বেদি দর্শন করতে সক্ষম হয়েছিলাম সেখানে সাধারণত সম্রাট বা প্রধানমন্ত্রী প্রার্থনা করেন। দৈনিক আনন্দবাজার পত্রিকার প্রাক্তন সহসম্পাদক সুমন চট্টোপাধ্যায়ও সঙ্গে ছিলেন।
নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসুর জন্মভূমিতে যেতে চেয়েছিলেন তোজো সান। আমি রবীন্দ্রগবেষক কাজুও আজুমা স্যারকে বলে তাঁকে কলকাতায় পাঠিয়েছিলাম ২০১০ সালে। নেতাজি স্মৃতি জাদুঘরে তাঁকে সংবর্ধনা দিয়েছিলেন কৃষ্ণা বসু। বিশিষ্ট ব্যক্তিবর্গ উপস্থিত ছিলেন সেদিন। নীলাঞ্জন, সুমনদাও ছিলেন।
কৃষ্ণা বসু এবং ইউকো সান চলে যাওয়ার মধ্য দিয়ে নেতাজি সম্পৃক্ত একটি যুগের অবসান হল। দুজনের বিদেহী আত্মার শান্তি কামনা করি।
লেখাটি
প্রবীর বিকাশ সরকারের ফেসবুক স্ট্যাটাস থেকে নেয়া হয়েছে।