
প্রবীর বিকাশ সরকার।
আমি লেখালেখি করি এটা আমার শতভাগ হবি বা প্যাশন। সেই ১৯৭৬ সাল থেকে লেখা শুরু করেছিলাম শিশুতোষ ছড়া দিয়ে, তখন কুমিল্লার দুজন বড় ভাই ছড়াকার ও শিশু সংগঠক হানিফ সংকেত আর কবি ও গল্পকার সুমন্ত চট্টোপাধ্যায়ের উৎসাহে। আমার চৌদ্দ গোষ্ঠীর মধ্যে কেউ কখনো লেখালেখি বা সাহিত্য নিয়ে কাজকারবার করেছে বলে জানা নেই। সেই যে শুরু হল এখনো চলছে। আমি পেশাদার লেখক নই। আমার লিখিত লেখাগুলোর কয়েকটি গ্রন্থ আছে। সেগুলো কতজন পাঠক পড়েছেন আমার জানা নেই।
আসলে আমার লেখালেখির নির্দিষ্ট কোনো বিষয়ও নেই। যখন যা ভালো লাগে তাই নিয়ে লিখি। ছড়া, গল্প, উপন্যাস, ফিচার, প্রবন্ধ, স্মৃতিকথা, গ্রন্থালোচনা, বিশিষ্টজনদের নিয়ে লেখা ইত্যাদি। লিখে আনন্দ পাই। আর কেউ যদি পড়ে মন্তব্য করেন তখন শ্লাঘা বা আত্মতুষ্টি অনুভব করি, অনুপ্রাণিত হই।
আমি যখন যা লিখি তখন মনে হয় আমি না লিখলে এই বিষয়টি আর কেউ লিখবে না। এবং জানবেও না। এই যে জানানোর তাগিদটা এটা পবিত্র এবং লেখকের জন্য গুরুত্বপূর্ণ। তখন আমি নিজেকে নতুন একজন লেখক মনে করি, এভাবে বার বার নতুন হয়ে উঠি নতুন নতুন লেখার মধ্য দিয়ে। আমি যদি তখন নিজেকে পুরনো ভাবি, অভিজ্ঞ ভাবি, লেখক-বাহাদুর ভাবি তাহলে দাম্ভিবতার জন্ম নেবে, আর এটাই হচ্ছে লেখকের জন্য অশনি সংকেত। কারণ লেখার মধ্যে যে বার্তা থাকে সেটা তার আর পরে দিতে পারেন না তারা। ফলে অপমৃত্যু ঘটতে থাকে ধীরে ধীরে।
মহান একুশ উপলক্ষে যখন ঢাকায় বইমেলা শুরু হয় তখন অনেক নতুন নতুন লেখকের বই প্রকাশিত হয়। কেউ কেউ নিজেই প্রকাশ করেন প্রকাশনা সংস্থার সঙ্গে যৌথভাবে, কেউ কেউ প্রকাশ করেন প্রকাশককে টাকা দিয়ে আবার কারো কারো বই উদারপন্থী প্রকাশকরা প্রকাশ করে থাকেন। উদারপন্থী প্রকাশক একেবারে আঙুলে গোনা। এখন অধিকাংশই লেখকের কাছ থেকে টাকা নিয়ে বই বের করে দেন। এটা যে গুরুতর অপরাধ এই বিষয়ে তারা সচেতন যদিও কিন্তু এটা কালচারে রূপলাভ করেছে।
তাই বলে যে গ্রন্থগুলো বাজে, খারাপ বা আদৌ কিছুই হয়নি একথা বলতে আমি একেবারেই নারাজ। কারণ গ্রন্থের লেখার মধ্যে লেখকের (যেই বয়সেরই হন না কেন) আশা-আকাঙ্ক্ষা, অদম্য উচ্ছ্বাস, প্যাশন, চিন্তা এবং বার্তা থাকে সেটাই হচ্ছে প্রকৃত মূল্যায়নের বিষয়। পাঠক যার যার রুচি ও জ্ঞানবুদ্ধিদ্বারা লেখার অর্থ ও লক্ষ্য বুঝে নেবেন। সবার মনন যে একইরকম হবে এটা ভাবা বাতুলতা মাত্র। মিলবে না বলেই বৈচিত্র্য, মিললে আর বৈচিত্র্য থাকে না। বিভিন্ন বিষয় বিভিন্ন বার্তা আসছে ক্রমাগত সময়ের ওপর ভর করে এটাই সভ্যতা, এটাই আধুনিকতা এবং এটাই সাহিত্যকে সমৃদ্ধ করতে বাধ্য। তাদেরকে স্বাগত জানাতেই হবে। তাদেরগ্রন্থাদি নিয়ে সামান্য হলেও আলোচনা করতে হবে, কথা বলতে হবে, উৎসাহিত করতে হবে।
জাপানের সাহিত্য জগৎ দুই বাংলার চেয়ে অনেক বড়। সারাবছরই প্রবীণদের পাশাপাশি নতুন নতুন লেখকদের লেখা পত্রপত্রিকা প্রকাশ করছে, গ্রন্থ প্রকাশিত হচ্ছে। এই দেশে দুটি বেসরকারি মর্যাদাসম্পন্ন সাহিত্য পুরস্কার রয়েছে একটি আকুতাগাওয়া পুরস্কার অন্যটি নাওকি পুরস্কার। দুটিই প্রদান করা হয় নতুন লেখকদের। জাপানে সৃজনশীল ক্ষেত্রে যেভাবে নতুনদের সুযোগ-সুবিধা প্রদান ও উৎসাহিত করা হয় তার তুলনা মেলা ভার! বস্তুত তরুণদের, নতুনদের দেশই হচ্ছে জাপান। সেই তুলনায় বাংলাদেশের কী অবস্থা সহজেই অনুমেয়।
নতুনদের লেখা নিয়ে, গ্রন্থ নিয়ে যারা নাক সিঁটকাচ্ছেন আমার বিশ্বাস তারা নতুনদের গ্রন্থ বা লেখা কখনো হাতেই নিয়ে দেখেননি! পড়বেন তো দূরের কথা। তারাই যে ভালো লেখেন এটাইবা বোঝার উপায় কী? যেযার সাধ্যমতো লিখে যাবে এটাই স্বাভাবিক, কমন সেন্স। এত কথা বলার দরকার তো নেই! পারফেক্ট লেখা বলতে পৃথিবীতে কিছুই নেই। সবই আপেক্ষিক। তবে পারফেক্ট কিছু লেখার বা কাজ করার চেষ্টাটা জরুরি। এই ব্যাপারে সচেতন থাকতে হবে।
যারা মনে করেন নিজেকে অভিজ্ঞ লেখক বা লেখক-বাহাদুর তাদের উচিত এগিয়ে এসে নতুনদের লেখা পাঠ করে ভুলভ্রান্তি ধরিয়ে দেয়া। কীভাবে ভালো করা যায় তার জন্য উপদেশ দেয়া, মতবিনিময় করা। ঢালাওভাবে ‘হয়নি’, ‘হচ্ছে না’ বা হবে না’ বলা ধৃষ্টতা। নতুনকে অবজ্ঞা, অবহেলা এবং অশ্রদ্ধা করার সামিল। এটা প্রবীণ বা অগ্রজ কোনো লেখকের চরিত্র হতে পারে না।
আড়াই বছর মাসিক “কিশোরচিত্র” সম্পাদনা করার সময় বহু শিশু, কিশোর-কিশোরীর ছড়া, কবিতা, গল্প, নিবন্ধ এবং ফিচার আমি রাত জেগে জেগে যতখানি বিদ্যাবুদ্ধিতে কুুলিয়েছে ঠিকঠাক করে, সংশোধন করে ছাপিয়েছি। এরা ছিল সবাই নতুন। এবং দেখা গেছে দ্বিতীয়বার, তৃতীয়বারে তারা বুঝতে পারছে কোথায় ভুল হয়েছে, বিষয়টি কীভাবে লিখলে ভালো হত।
আমার মনে আছে, ২০০৭-৮ সালে কলকাতার প্রখ্যাত কবি ও ‘কবিসম্মেলন’ সাময়িকীর সম্পাদক শ্যামলকান্তি দাশ তথা শ্যামলদা শিশুদের জন্য একটি লেখা চেয়েছেন, তিনি “জমজমাট” নামে একটি পুজো বার্ষিক সম্পাদনা করেন। আমি “জাপানের লিনিয়ার মোটার কার” নামে একটি দীর্ঘ ফিচার লিখে পাঠালাম। লেখা পড়ে বললেন, প্রবীর, অসাধারণ লেখা! ছেলেমেয়েরা আগ্রহসহকারে পড়বে। অনেক ধন্যবাদ। তবে কিছু মনে করো না, ভাষার কিছু সমস্যা আছে, ঠিক করতে হবে। সুনীলের (গঙ্গোপাধ্যায়) লেখাও প্রচুর ঠিকঠাক করে দিতাম আমরা।
আমি বললাম, সে তো আমার সৌভাগ্য শ্যামলদা! আমার জন্য শিক্ষার বিষয় হবে। আপনাকে কৃতজ্ঞতা জানাচ্ছি।
এই হচ্ছে নবীনের প্রতি প্রবীণের দরদ ও পথপ্রদর্শনের মননশীলতা। কারণ অভিজ্ঞ লেখকরা জানেন যে, নতুনরা যদি না আসে, তাহলে তাদের লেখা পড়বে কারা, মনে রাখবে কারা, গবেষণাই বা করবে কারা ভবিষ্যতে! সুতরাং যারা অভিজ্ঞ বা লেখক-বাহাদুর তাদের স্বচ্ছ মন নিয়ে দায়িত্বশীলতার পরিচয় দিতে হবে, এটাই ভব্যতা।
আমি নিজেই নতুন লেখক হয়ে উঠি প্রতিবার যখন কিছু লিখি, তারপরও নতুন যারা বই পাঠায় পড়ে দেবার জন্য, ভূমিকা লিখে দেবার জন্য আমি ফিরিয়ে দিই না। সাধ্যমতো তাকে উৎসাহিত করি। তার আগ্রহ, উচ্ছ্বাস এবং নবরাগটাকে অসম্মান করতে পারি না। সময় নিয়ে পড়ি এবং আলোচনাও লিখি।
আরও একটি বিষয় আমি অনুভব করি, নিজের পুরনো লেখা পড়ে নতুন করে উদীপ্ত হয়ে উঠা। নতুন কিছু লেখার ইচ্ছেতে ঝাঁপিয়ে পড়ি। রবীন্দ্রনাথ-জাপান বিষয়ে অনেক ফিচার, নিবন্ধ ও প্রবন্ধ আমি লিখেছি, তার কিছু তুলে দিলাম (ছবি), সবই গ্রন্থভুক্ত হয়েছে। তারপরও পত্রিকায় মুদ্রিত লেখাগুলো দেখলে নতুন লেখার জন্য নতুন লেখক হয়ে উঠি! এটাও একটা প্যাশন আমার।
আমি পুরনো হব কেন?
লেখাটি প্রবীর বিকাশ সরকারের ফেসবুক স্ট্যাটাস থেকে নেয়া হয়েছে।