Logo
×

Follow Us

মিডিয়া

চারণ সাংবাদিকতার পথিকৃৎ মোনাজাত উদ্দিন

Icon

মো. মামুনুর রশিদ মন্ডল

প্রকাশ: ০৩ মার্চ ২০২০, ১০:১৯

চারণ সাংবাদিকতার পথিকৃৎ মোনাজাত উদ্দিন

সাংবাদিক মোনাজাত উদ্দিন।

সাংবাদিকতা বিষয়ে কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ালেখা করিনি আমি। রাজধানীতে কোনো পত্রিকার স্টাফ রিপোর্টার হিসেবেও সাংবাদিকতা শুরু করিনি। শুরুটা করেছি মফস্বল থেকে। উত্তর জনপদের গাইবান্ধা জেলার ফুলছড়ি প্রতিনিধি হিসেবে, যার লেখা খবর পত্রিকার পাতায় পড়ে সাংবাকিতায় অনুপ্রাণিত হয়েছি, সাংবাদিকতাকে জীবনে পেশা হিসেবে নিয়েছি- তিনি হলেন চারণ সাংবাদিক মোনাজাত উদ্দিন।

বাংলাদেশের সাংবাদিকতা জগতের এক স্মরণীয় নাম। শুধু সাংবাদিক নন, তিনি নিজেই হয়ে উঠেছিলেন একটি প্রতিষ্ঠান। একজন উপজেলা প্রতিনিধি হিসেবে বিভিন্ন সংকটের মুখোমুখি হতে হয়েছে। যার সমাধান খুঁজে নিতে হয়েছে মোনাজাত উদ্দিনের বইগুলো থেকে। গ্রামে থেকেও যে চ্যালেঞ্জিং সাংবাদিকতা করা যায়, তার উদাহরণ একমাত্র তিনিই।

গ্রামে-গঞ্জে, পথ থেকে পথে ঘুরে ঘুরে এই তথ্যানুসন্ধানী সংবাদকর্মী তার সাংবাদিকজীবনে নানামাত্রিক রিপোর্ট করেছেন। পাশাপাশি লিখেছেন জীবনের অভিজ্ঞতা সমৃদ্ধ নানা ঘটনা। দূরদর্শী, মেধাবী সাংবাদিক, অসাধারণ দেশপ্রেমিক, অসম সাহসী ও সহজ-সরল ব্যক্তিত্বের প্রতীক মোনাজাত উদ্দিন।

চারণ সাংবাদিক মো. মোনাজাত উদ্দিনের জন্ম ১৯৪৫ সালের ১৮ জানুয়ারি রংপুর জেলার গঙ্গাছড়া উপজেলার মরনিয়া গ্রামে। পিতা মো. আলিমউদ্দিন আহমদ, মাতা মতিজানন্নেছা। কর্মজীবনে রংপুর পৌরসভায় উচ্চমান করণিক, রংপুর এসপি অফিসের প্রধান করণিক ছিলেন মো. আলিমউদ্দিন।

চাকরি থেকে অবসর গ্রহণ করেন রংপুর কারমাইকেল কলেজের হিসাবরক্ষক হিসেবে। রংপুর শহরের ধাপ এলাকায় ছিল তার আবাস। আলিমউদ্দিন ‘আম্বিয়া চরিত’ নামে একটি গ্রন্থ রচনা করেন। অপ্রকাশিত ‘আধুনিক যোদ্ধা’ নামে একটি বইয়ের পান্ডুলিপি রচনা করেছিলেন।

মোনাজাত উদ্দিনের লেখালেখির সূচনা ছাত্রজীবনে। সাংবাদিক হিসেবে প্রথম তিনি কর্মজীবন শুরু করেন ‘বগুড়া বুলেটিন’ পত্রিকার মাধ্যমে। ১৯৬২ সালে তিনি ঢাকার ‘দৈনিক আওয়াজ’ পত্রিকায় কিছুদিন কাজ করেন স্থানীয় সংবাদদাতা হিসেবে। পরে কিছুদিন ‘দৈনিক পূর্বদেশ’ পত্রিকায় কাজ করে ১৯৬৬ সালে ‘দৈনিক আজাদ’ পত্রিকার উত্তরাঞ্চল প্রতিনিধি হিসেবে কাজে যোগদান করেন। দৈনিক আজাদ বন্ধের পর ১৯৭৬ সালে ‘দৈনিক সংবাদ’-এ কাজ করার সুযোগ পান। বিশ বছর একটানা ‘সংবাদ’-এ কাজ করার পর তিনি দৈনিক জনকণ্ঠে সিনিয়র রিপোর্টার হিসেবে যোগদান করেন ১৯৯৫ সালের ২৪ এপ্রিল।

মোনাজাত উদ্দিনের লেখালেখির বর্ণাঢ্য জীবন আমাকে আরো কাছে টানে। কত দুর্দান্ত সাহসী তিনি। স্বাধীনতার পর ১৯৭২ সালের মার্চে স্বাধীন চিন্তা, বিশ্বাস আর আদর্শের ভিত্তিতে প্রকাশ করেন রংপুরের প্রথম দৈনিক পত্রিকা ‘দৈনিক রংপুর’। তিনি পত্রিকাটির প্রকাশক ও সম্পাদক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। ‘দৈনিক রংপুর’ ছিল মিনি সাইজের পত্রিকা, দাম মাত্র পাঁচ পয়সা।

পত্রিকা প্রকাশের জন্য আর্থিক সহযোগিতা করতেন একজন স্থানীয় ব্যবসায়ী। ওই ব্যবসায়ীর সঙ্গে মোনাজাত উদ্দিনের সম্পর্কের অবনতি হলে বন্ধ হয়ে যায় পত্রিকাটির প্রকাশনা। তখন ঢাকায় ‘দৈনিক আজাদ’ পত্রিকাও বন্ধ, তিনি সেখানে স্থানীয় প্রতিনিধি ছিলেন। এ সময় জীবিকার তাগিদে একটি কীটনাশক কোম্পানিতে চাকরি নিতে বাধ্য হন মোনাজাত উদ্দিন। কিন্তু লেখালেখির সঙ্গে তার বিচ্ছেদ ঘটেনি মৃত্যুর পূর্ব পর্যন্ত। ১৯৭৬ সালে দৈনিক সংবাদে যোগ দেওয়ার পর পত্রিকাটির সঙ্গে মিলে মিশে একাকার হয়ে গিয়েছিলেন মোনাজাত উদ্দিন। বিশ বছর একটানা ‘সংবাদ’-এ কাজ করার পরে ১৯৯৫ সালের ২৪ এপ্রিল দৈনিক জনকণ্ঠে সিনিয়র রিপোর্টার হিসেবে যোগদান করেন।

সাংবাদিকতার পাশাপাশি মোনাজাত উদ্দিন অনেক সমাজসেবামূলক কাজে অংশগ্রহণ করেছেন। গ্রামীণ এলাকায় মানুষের কুসংস্কার, অন্ধতা দূর করতে তিনি তরুণদের নিয়ে সংগঠন করেছেন। কখনো তাদের নিয়ে নাটক করিয়েছেন, উৎসাহ দিয়েছেন সাংস্কৃতিক আন্দোলন গড়ে তুলতে। তিনি নিজেও ছিলেন একজন গীতিকার ও নাট্যকার। রংপুর বেতারে নিয়মিত কাজ করতেন। তার একাধিক নাটক মঞ্চস্থ হয়েছে। যদিও চারুশিল্পে তার তেমন কোনো প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা ছিল না। কিন্তু নিজের অধ্যাবসায়ের ফলে তিনি অনেক বই ও ছোট কাগজের প্রচ্ছদ করেছেন। একজন দক্ষ ফটোগ্রাফারও ছিলেন ।

মোনাজাত উদ্দিন নাসিমা আক্তার ইতির সাথে ১৯৭০ সালের ১৪ ডিসেম্বর বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন। এ দম্পতির দুই মেয়ে ও এক ছেলে। 

১৯৭৬ সালের মে মাস। পদ্মা নদী ওপর ভারত কর্তৃক অন্যায়ভাবে নির্মিত মরণ ফাঁদ ফারাক্কা বাঁধের প্রতিবাদে মজলুম জননেতা মওলানা আব্দুল হামিদ খান ভাসানীর নেতৃত্বে রাজশাহী থেকে ফারাক্কা মিছিল বের হবে। মিছিলের তথ্য ও ছবি সংগ্রহ করার জন্য ঢাকা থেকে সাংবাদিকরা রাজশাহীতে পৌঁছেছেন। মোনাজাত উদ্দিনের তখনো কোনো পত্রিকায় স্থায়ী চাকরি হয়নি। তার নিজের কোনো অ্যাক্রেডিটেশন কার্ড নেই।

তারপরও প্রবল উৎসাহ ও চ্যালেঞ্জ সামনে রেখে তিনি মিছিলের দু’দিন রাজশাহীতে এসে পৌঁছান। ভাসানীর মিছিল কভার করার জন্য সংবাদ অফিস থেকে সাংবাদিক ও ফটোগ্রাফার পাঠানো হয়েছে। তাদের কাছে মোনাজাত উদ্দিন পাত্তাই পেলেন না। প্রতিবাদ করতে পারেননি, ঢাকার সাংবাদিকরা যদি মাইন্ড করেন! কারণ তার তো তখন একটা চাকরি দরকার।

‘সংবাদ’-এর সন্তোষ গুপ্ত সরাসরি বলে দিয়েছেন, ‘সংবাদ-এর জন্য উত্তরাঞ্চল ভিত্তিক খবর ও ছবি পাঠাতে পারেন, ভালো হলে ছাপাও হবে। কিন্তু চাকরির ব্যাপারে আমি কোনো সুপারিশ করতে পারব না। আপনার নিজের কাজের যোগ্যতায় যদি অ্যাপয়েন্টমেন্ট লেটার আদায় করতে পারেন, করুন।’ ফলে মোনাজাত উদ্দিনের কাছে প্রশ্নটা যোগ্যতার। তাকে সেই যোগ্যতার প্রমাণ দিতে হবে। 

ভাসানী মিছিল শুরুর আগে স্থানীয় এক মাদ্রাসার মাঠে বক্তব্য দিলেন। মোনাজাত উদ্দিন তার নিজের ভাঙা ক্যামেরা দিয়ে দূর থেকে সমাবেশে ভাসানীর বক্তব্যরত অবস্থার কয়েকটি ছবি তুলে নিলেন। যদিও জানেন এগুলো কোনো কাজে লাগবে না। তারপরও নেশায় পড়ে তুলে নিলেন ছবিগুলো। একবার ভাসানীর মঞ্চের কাছাকাছি যাওয়ার চেষ্টা করেছিলেন। কিন্তু কোনো পত্রিকার কার্ড না থাকায় সেটি সম্ভব হয়নি। 

ভাসানী বক্তব্য শেষ করে যে স্থান দিয়ে মিছিল নিয়ে যাবেন আগে থেকেই তার সামনে গিয়ে দাঁড়িয়ে রইলেন মোনাজাত উদ্দিন। কারণ, অন্যান্য সাংবাদিক ও ফটো সাংবাদিকদের জন্য গাড়ি তৈরি আছে মিছিলের সাথে যাবার জন্য। মোনাজাত উদ্দিনের সেখানে জায়গা হবে না তা তিনি আগেই বুঝতে পেরেছিলেন।

কিন্তু অন্যান্য সাংবাদিকদের বহনকারী গাড়িটি মুহূর্তেই মিছিল যে দিকে যাবে সেদিকে না গিয়ে ঠিক তার উল্টো দিকে যাত্রা শুরু করল। গাড়ির সাংবাদিকরা ‘গাড়ি ঘুরাও, গাড়ি ঘুরাও’ বলে চিৎকার শুরু করে দিলেন। কিন্তু ততক্ষণে জনতার স্রোত এত প্রবল হয়ে উঠেছে যে বেচারা চালকের আর সেই ক্ষমতা ছিল না। এদিকে মিছিল প্রায় চলে গেছে আধা মাইলের মতো। উপায়ান্তর না দেখে সাংবাদিকরা গাড়ি থেকে নেমে দৌড় লাগালেন মিছিলের সামনের দিকে। কিন্তু জনতার স্রোতে সেই প্রচেষ্টাও খুব বেশি সফল হলো না। 

প্রমাদ গুণলেন মোনাজাত উদ্দিন। যে অবস্থা তাতে ‘সংবাদ’-এর ফটোগ্রাফারের পক্ষে কোনো অবস্থাতেই মিছিলের সামনে ভাসানীর ছবি তোলা সম্ভব নয়। অথচ এই ছবি মোনাজাত উদ্দিনের কাছে তোলা আছে। সঙ্গে সঙ্গে সিদ্ধান্ত নিলেন এই ছবি ও সংবাদ নিয়েই রওনা দেবেন ঢাকার পথে। রাত সাড়ে এগারোটায় বংশালের ‘সংবাদ’ অফিসে পৌঁছান। সন্তোষ গুপ্ত তখন ‘সংবাদ’-এর টেবিলে মাথা গুঁজে বসে আছেন। রাজশাহী থেকে কোনো ছবি তো দূরের কথা সংবাদও এসে পৌঁছেনি। মোনাজাত উদ্দিনকে দেখে সন্তোষ গুপ্ত বুকে জড়িয়ে ধরলেন।

বললেন, ‘আমি ঠিকই ধারণা করেছিলাম, আপনি আসবেন। ছবি এনেছেন? ফিল্মটা দিন, আপনি বসুন। আমি আপনার খাবারের ব্যবস্থা করি।’ কিন্তু মোনাজাত উদ্দিন খাবার স্পর্শ না করে লিখতে বসে যান। একটানা সংবাদ লিখে শেষ করে তারপর বসেন খাবার টেবিলে। ‘সংবাদ’-এর প্রথম পাতায় ফারাক্কা মিছিলের লিড নিউজ এলো ছয় কলামজুড়ে। খবরটি ছাপা হলো মোনাজাত উদ্দিনের নামে। দুটি ছবিও ছাপা হলো তার নাম দিয়ে। রাতে অফিসেই পত্রিকার ফাইলের ওপর শুয়ে থাকলেন।

কিন্তু সেই রাতে আনন্দে ঘুম এলো না মোনাজাত উদ্দিনের দু’চোখে। সকালে সন্তোষ গুপ্ত বাসা থেকে ফোন করে জানালেন, ‘সংবাদ’ সম্পাদক আহমদুল কবীর তার সঙ্গে দেখা করবেন। কবির সাহেব এলেন। মোনাজাত উদ্দিনকে ডেকে নিলেন কামরায়।

বললেন, ‘তোমার কাজে আমি খুব খুশি হয়েছি। কি চাও তুমি?’ এই কথা শুনে, হাঁটু-বুক-গলা তিনটিই কেঁপে উঠল মোনাজাত উদ্দিনের। মিনমিনে গলায় বললেন, ‘একটা চাকরি’। শেষ পর্যন্ত মোনাজাত উদ্দিন নিজের যোগ্যতার প্রমাণ দিতে পেরেছিলেন ‘সংবাদ’ তথা সারা বাংলাদেশের সংবাদ জগতের কাছে। যোগ্যতা দিয়েই তিনি হয়ে উঠেছিলেন এ দেশের প্রথম সার্থক ‘চারণ সাংবাদিক’।

লেথক : সাংবাদিক ও কলামিস্ট

Logo

সম্পাদক ও প্রকাশক: ইলিয়াস উদ্দিন পলাশ

বার্তা ও বাণিজ্যিক কার্যালয়: ফেয়ার দিয়া ১১/৮/ই, ফ্রি স্কুল স্ট্রিট (লেভেল-৮), বক্স কালভার্ট রোড, পান্থপথ, ঢাকা ১২০৫