
সায়েমা খাতুন।
আজ যা সংবাদ, তা আগামীকালের ইতিহাসবিদের মাল-মসলা, ইতিহাস রচনার প্রথম খসড়া। হানারজ (২০০৪) এথনোগ্রাফার এবং সাংবাদিকের মধ্যে এক বিশেষ ধরনের শ্রমবিভাজনের কথা বলেন, যেখানে সাংবাদিক সাম্প্রতিক ঘটনাপ্রবাহের সাক্ষী হয়ে এবং ঘটনা নথিভুক্ত করে ইতিহাসের প্রথম ড্রাফট করেন। এই খসড়া ইতিহাস রচনার চরিত্র ও ভঙ্গি গত কয়েক দশক ধরে নাটকীয় ধরনের পরীক্ষা-নিরীক্ষার মধ্য দিয়ে গেছে।
এটা স্পষ্ট যে, বাংলাদেশ রাষ্ট্রের চরিত্রের পালাবদলের সঙ্গে সঙ্গে সংবাদমাধ্যমগুলোর চরিত্রও বদলে গেছে। মিডিয়া বাংলাদেশে যেমন খুব দ্রুত প্রসারিত ও আধুনিকতর হয়েছে, তেমনি এর পরিবেশনের চরিত্রও আমূল পাল্টে গেছে। ঘুম থেকে উঠে গোটা জাতি কি নিয়ে ভাববে, লোকজন কি নিয়ে ব্যস্ত থাকবে, কি নিয়ে কথা বলবে, প্রতিষ্ঠানের কর্মপরিকল্পনা কি হবে, সভার এজেন্ডা কি, সংগঠনের কর্মসূচি কি হবে- তা নির্ধারণ করে দিচ্ছে এই পরিবেশনা। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের আলোচনারও একটা বড় অংশ আসে প্রকাশিত সংবাদের ভিত্তিতে।
এই সংবাদ পরিবেশনায় নৃবিজ্ঞানের গবেষণা, লেখা এবং পরিবেশনের প্রধান পদ্ধতি এথনোগ্রাফির সঙ্গে হালের সাংবাদিকতার সম্পর্ক সজ্ঞানে বা অজ্ঞানে অনেক কাছাকাছি চলে এসেছে। প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা থেকে লেখার গুণে এথনোগ্রাফিও ইতিহাসের এক দলিল হিসেবে কাজ করে।
সংবাদপত্র তথা প্রিন্ট মিডিয়া জাতির যৌথমানস গঠনের চাবিকাঠির ভূমিকা পালন করে, বেনেডিকট অ্যান্ডারসন ইউরোপের আধুনিক ইতিহাস ঘেঁটে তার কল্পিত সম্প্রদায়ের আলোচনায় (১৯৮৩) সেটা স্পষ্ট করেছেন। আমাদের এখানে জাতি গঠনে এবং পুনর্গঠনে সংবাদমাধ্যম ও মিডিয়ার ভূমিকা নিয়ে জানাবোঝার মতো নির্ভরযোগ্য তেমন আলোচনা খুঁজে পাওয়া কঠিন। সংখ্যালঘু পরিচয়ের রাজনীতি এবং বিপুল জনগোষ্ঠীর রাষ্ট্রহীনতার ঝুঁকিতে পতিত গোটা দক্ষিণ এশিয়ার জন্য আজ জ্বলন্ত প্রশ্ন হলো, রাষ্ট্র কি মনোলিথিক হবে?
এক জাতি, এক ধর্মের জন্যে রাষ্ট্র হবে, নাকি বহুজাতি বহু পরিচয়ের সমষ্টি হবে? বহুত্বকে ধারণ করতে হলে জাতি গঠনের হাতিয়ার সংবাদমাধ্যমকেও বহুত্ববাদী দৃষ্টিভঙ্গি ও পদ্ধতি উভয়ভাবেই গ্রহণ করতে প্রস্তুত হতে হবে। যদি তাই করতে হয়, তবে সেটা হবে সাংবাদিকতা ও নৃবিজ্ঞানের কাছে আসবার সুযোগ। নৃবিজ্ঞানের বহুত্বকে জানাবোঝার বিশেষজ্ঞতা সাংবাদিকতায় প্রয়োগ করা সম্ভব। সাংবাদিকতার ধারার তিনটি স্তরে- জ্ঞানতাত্ত্বিক, কৌশলগত এবং স্টাইলগত নৃবিজ্ঞানের পদ্ধতি ও কৌশল প্রয়োগ করে এক নতুন ঘরানা সৃষ্টি করা সম্ভব ।
ইতিমধ্যে গত প্রায় দুই দশক ধরে বাংলাদেশে প্রিন্ট ও ব্রডকাস্ট মিডিয়া জগতে সংবাদ পরিবেশনে বৈপ্লবিক পরিবর্তন হয়েছে। এই পরিবর্তন যেমন পরিবেশনের কলা-কৌশলে, উন্নত তথ্যপ্রযুক্তির ব্যবহারে, তেমনি সংবাদ পরিবেশনের দৃষ্টিভঙ্গি এবং দর্শনেও। অনুসন্ধানী তদন্ত প্রতিবেদনের তথ্যসংগ্রহের ক্ষেত্রে এমন সব কলাকৌশল ব্যবহার করা হয়েছে, দৃষ্টিভঙ্গির পরিকাঠামোতে সাজানো হয়েছে, পরিবেশনার পদ্ধতি ব্যবহার করা হয়েছে, সেসব পড়ে-দেখে-শুনে মনে হয়েছে এটি নৃবিজ্ঞানের অনেক কাছাকাছি চলে এসেছে।
আমাদের দেশের কিছু অনুসন্ধানী সাংবাদিকতার সঙ্গে এথনোগ্রাফিক অনুসন্ধানের সাদৃশ্য বিস্ময়কর। বিশেষ করে তথ্যসংগ্রহে উন্মুক্ত প্রশ্নমালার মাধ্যমে দীর্ঘ গুণগত ধরনের সাক্ষাৎকার, সংবাদ প্রতিবেদনে কেসস্টাডি পদ্ধতির বহুলব্যবহার অনুসন্ধানী সাংবাদিকতায় নৃবৈজ্ঞানিক কৌশলেরই চমৎকার প্রয়োগ। যেখানে সংবাদের নিছক বস্তুনিষ্ঠতা ও নৈর্ব্যক্তিকতার সীমা পেরিয়ে সংবাদিত ব্যক্তির দৃষ্টিভঙ্গিকে উপস্থাপন করা হয়। সাংবাদিক তার দৃষ্টিভঙ্গি আরোপ করা থেকে সচেতনভাবে নিবৃত্ত থেকেছেন।
নৃবিজ্ঞানে একে বলা হচ্ছে, ‘বসরপ’ বা স্থানীয়দের অন্তর্গত দৃষ্টিভঙ্গি, যাতে যাদের পর্যবেক্ষণ করা হচ্ছে, তাদের দিক থেকে তাদের ভাষায় কোন কিছু জানা-বোঝা যায়। এর বিপরীতটি হল সাংবাদিকের নিজস্ব দৃষ্টিভঙ্গি বা ‘বঃরপ’ দৃষ্টিভঙ্গি, যাতে যে পর্যবেক্ষণ করেছে, তার ভাষায়, তার দৃষ্টিভঙ্গিতে জানা-বোঝা। কিন্তু এখানে আমরা সম্ভবত এখনো এই বিষয়ে পদ্ধতিগত আন্তঃশাস্ত্রীয় আলাপচারিতা শুরু করিনি।
অনেক ক্ষেত্রেই সাংবাদিক এবং সম্পাদক কাজ শুরু করবার আগেই জানেন তারা কী গল্প প্রকাশ করতে যাচ্ছেন, এমনকি শিরোনামও আগে থেকে তাদের মাথায় থাকতে পারে। সংবাদ মাধ্যমের রয়েছে নিজস্ব ফ্রেম। এটা সহজেই প্রমাণ করা সম্ভব যে, নিজেদের অনাকাক্সিক্ষত বিষয়গুলো এড়িয়ে উপযুক্ত প্রশ্ন করে সঠিক উৎস থেকে একটি কাক্সিক্ষত গল্প পাওয়া যেতে পারে। সংবাদের শিরোনাম, ফোকাস, বিষয়বস্তু সবই গোড়ায় নির্দেশনা থেকে বদলাতে পারে। এটা সবসময় ইচ্ছাকৃত পক্ষপাত নয়।
বরং, সাংবাদিকের নির্দিষ্টতাবাদী ঘটনাকেন্দ্রিক প্রত্যক্ষণের অবধারিত উপজাত। কিন্তু নৃবিজ্ঞানী সাংবাদিকের মতো ঘটনার সময়ই কেবল উপস্থিত থাকতে চান না, বরং ঘটনাবিহীন অনাড়ম্বর দিনগুলোতে ‘কিচ্ছু না হওয়া’ সময়ে মানুষজনের চলাফেরা-কর্মকা- প্রত্যক্ষ করতে আগ্রহী, যাতে করে মানুষজন তার মতো একজন বহিরাগতের উপস্থিতি ভুলে তাদের ফর্মাল মুখোশটাকে খুঁজে যার যার নিজের মতো করে জীবনযাপন করতে শুরু করে। তখনই নৃবিজ্ঞানী সমাজের প্রকৃতির গভীর সত্যের কাছে উপনীত হওয়ার সুযোগ পান। মুখোশের ভেতরের আসল মানুষগুলোর নাড়ির স্পন্দন, হাঁড়ির খবর বের করেন। এটাই নৃবৈজ্ঞানিক পদ্ধতির অনন্যতা।
প্রধানত প্রশ্নের উন্মুক্ত চরিত্রের কারণে আগে থেকেই জানেন না, তিনি কি জানবেন। তিনি উন্মুক্ত প্রশ্ন নিয়ে মাঠে নামতে পারেন, যার উত্তরে আসতে পারে সম্পূর্ণ অজানা কিছু, কিছু নজিরবিহীন অর্ন্তদৃষ্টি। এটা সত্যানুসন্ধানের অবরোহ পদ্ধতি। এথনোগ্রাফির লক্ষ্যই থাকে আগে থেকে কিছু ভেবে না যাওয়া, যাতে নিজে পক্ষপাতমুক্ত থেকে মাঠের ভেতর থেকে ধাপে ধাপে একটি সত্য উন্মোচন করা যায়, একটি হলিস্টিক বা পূর্ণাঙ্গ দৃষ্টিভঙ্গি অর্জন করা যায় (বার্ড, ২০০৫)।
নৃবিজ্ঞানীদের এই দৃষ্টিভঙ্গি দিয়ে বিভিন্ন সংস্কৃতিতে যে গবেষণা করা হয়েছে তার সংবাদমূল্যও বিশেষভাবে গুরুত্বপূর্ণ। বিখ্যাত ফরাসী নৃবিজ্ঞানী মারসেল মসকে তার প্রথম বিশ্বযুদ্ধ-উত্তর বিখ্যাত এথনোগ্রাফি ‘দ্য গিফট’ (১৯২৫) এর জন্যে অর্থনীতির সাংবাদিকও বলা হয়ে থাকে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সাংবাদিকতায় ইতিমধ্যে এটি একটি ঐতিহ্যে রূপ নিয়েছে। আমেরিকায় বহুসাংস্কৃতিক মূল্যবোধকে ধারণ করতে গিয়ে হালে নীতিগতভাবে প্রেক্ষিতনির্ভর সংবাদের ঝোঁক থেকে ফিচার সাংবাদিকতার ক্ষেত্রে এথনোগ্রাফিক সাংবাদিকতার আবির্ভাব ঘটেছে।
প্রেক্ষিত নির্দিষ্ট প্রতিবেদন ও সাংস্কৃতিক বৈচিত্র্য
দুটি ভিন্ন উদ্দেশ্যে পরিচালিত দুটি বিদ্যার নৈকট্য গল্প বলা দিয়ে। নৃবিজ্ঞান ও সাংবাদিকতা উভয়ই মানুষের জীবনের গল্প বলে যায়। উভয়ই সাক্ষ্য-প্রমাণভিত্তিক নন-ফিকশনের মর্যাদার দাবিদার, যার ওপর ভিত্তি করে বাস্তব জগতের নীতি ও কর্ম পরিকল্পনা করা হবে। এই নন-ফিকশনকে লেখার সময় সাহিত্যের গল্প বলার কলা আয়ত্ত করতে দেখা যায়। ব্রনিস্লো ম্যালিনোস্কির পাপুয়া নিউগিনিতে মাঠকর্মভিত্তিক প্রথম ক্লাসিক নৃবৈজ্ঞানিক রচনাটি পড়তে একটা গল্পের মতোই লাগে।
একবিংশ শতাব্দীর এথনোগ্রাফি নতুন নতুন পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে গল্প বলার ভঙ্গি গ্রহণ করেছে লেখকের আর জনগোষ্ঠীর সম্পর্কের সীমানা ভেঙে-চুরে দিয়ে। একজন ক্লাসিক ঘরানার সাংবাদিক সুষ্ঠু ও বস্তুনিষ্ঠ সংবাদ সংগ্রহ ও পরিবেশনায় তার সাবজেক্টকে নিজের থেকে আলাদা করে রাখার পরিষ্কার সীমারেখা টেনে রাখেন। নিরপক্ষতার সাক্ষর রাখা তার পেশার যথার্থতা ও উৎকর্ষতা উভয়ের জন্যেই জরুরী।
কিন্তু যেহেতু সংবাদের আকর্ষণ নিছক ফ্যাক্ট নয়, আবার যেহেতু সংবাদ বিক্রিও করতে হয়, সংবাদ এক ধরনের বিনোদনও, তাই পাঠককে ধরে রাখার মতো পরিবেশনও খুব গুরুত্বের বিষয়। সে বিচারে গল্প দিয়ে সংবাদ শুরু করা এখন সংবাদের আবেদন সৃষ্টির অন্যতম ভঙ্গি। সবচেয়ে প্রভাবশালী সংবাদমাধ্যমগুলো সংবাদকে গল্পের আকারে পরিবেশন করছে। শুষ্ক-কাষ্ঠ তথ্যমূল্যকে গল্পের আকারে পরিবেশন করে কেবল পাঠক-শ্রোতার কাছে আকর্ষণীয়ই করা হচ্ছে না, তাতে সংবাদ অধিকতর বিশ্বাসযোগ্য ও হৃদয়গ্রাহী হয়েছে, অধিকতর বড় পাঠক-শ্রোতা গোষ্ঠীর সঙ্গে তাৎক্ষনিক যোগাযোগ তৈরিতে গল্প বলার ভঙ্গির জুড়ি নেই।
এই গল্প বলতে গিয়ে সংবাদ সংগ্রহের পদ্ধতিতে এসেছে নতুন দৃষ্টিভঙ্গি, যাকে বলা হচ্ছে ‘নয়া সাংবাদিকতা’। ক্যাথরিন ফিঙ্ক এবং মিশেল স্কুডসন (২০১৪) দেখান, বিংশ শতকের দ্বিতীয়ার্ধে প্রথাগত সাংবাদিকতার নিছক ফ্যাক্ট তুলে আনার ঝোঁক কমে আসে, এর স্থলে ‘প্রেক্ষিতনির্দিষ্ট সাংবাদিকতা’র ঝোঁক বেড়ে যায়। তারা ১৮৯১ টি প্রবন্ধ বিশ্লেষণ করে দেখান যে কিভাবে ২০০৫ এর দিকে যুক্তরাষ্ট্রে প্রায় অর্ধেক গল্প ছিল প্রেক্ষিতনির্দিষ্ট প্রতিবেদন।
তারা দেখতে পান, প্রথাগত সাংবাদিকতাকে বদলে দিয়ে এই ধরনের সাংবাদিকতা বুদ্ধিবৃত্তিকভাবে অধিকতর উচ্চাভিলাষী লক্ষ্য হাসিল করতে আগ্রহী।
সমাজের বহুত্বকে মেনে নিতে ‘অন্য’ এর মূল্যবোধের ভিন্নতাকে গ্রাহ্য করে প্রথাগত পজিটিভিস্ট সাংবাদিকতার ছক ভেঙ্গে বেরিয়ে আসার চেষ্টা দেখা যাচ্ছে। পরিবর্তিত দার্শনিক, প্রায়োগিক এবং আত্মপ্রকাশে অংশগ্রহণকারীর পর্যবেক্ষণের মতো লক্ষণ দেখা যাচ্ছে। সঠিক প্রশ্ন করা এবং সাক্ষাৎকার গ্রহণের কলাকৌশলের উপর উভয়েরই তথ্যানুসন্ধানের সাফল্য নির্ভর করে। কুশলী তথ্য-প্রমাণভিত্তিক গবেষণা, বিশ্লেষণ এবং সিদ্ধান্তে আসার সক্ষমতার উপর নৃবিজ্ঞানী ও সাংবাদিক উভয়ই নির্ভর করেন। সাংবাদিকতার প্রশিক্ষণে নৃবিজ্ঞানের তথ্য সংগ্রহ ও বিশ্লেষণের পদ্ধতির প্রচলন নয়া সাংবাদিকতার সূচনা করেছে।
এই প্রবণতা থেকে প্রতিবেদন কৌশলে ক্রমবর্ধমানভাবে বর্ণনা ও ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ অন্তর্ভুক্ত হতে থাকে। বাংলাদেশকে যদি আমরা বহু-জাতির দেশ মানি- জাতি, শ্রেণী ও লিঙ্গের অভিজ্ঞতার পার্থক্যকে সংবাদ পরিবেশনে প্রতিফলিত করতে চাই- প্রেক্ষিতনির্দিষ্ট সাংবাদিকতার মাধ্যমে সমাজের প্রান্ত থেকে সত্য অভিজ্ঞতার কাহিনী ধারণ করা সম্ভব হতে পারে।
ঢাকাকেন্দ্রিক চোখের বদলে মফস্বল থেকে, গ্রাম থেকে, পাহাড় থেকে, বনজঙ্গল থেকে, সীমান্ত থেকে, চর থেকে, হাওর থেকে, রোহিঙ্গা ক্যাম্প থেকে দেশ জুড়ে দেখার চশমা তৈরি করা যেতে পারে। যেমনটি উত্তরবঙ্গে চেষ্টা করেছিলেন বাংলাদেশে মোনাজাত উদ্দিন, ভারতের পশ্চিমবঙ্গে মহাশ্বেতা দেবী গ্রাম ও মফস্বলের নিম্নবর্গীয় জীবনের খবরা-খবরকে সংবাদ শিরোনামে পরিণত করেছেন, সাংবাদিকতার উচ্চবর্গবাদী ভঙ্গিকে উলটে দিয়ে এক নতুন ধরনের সাংবাদিকতা ও সাহিত্য জন্ম দেন। অধুনা শাইখ সিরাজ
কৃষিক্ষেত্রকে নিয়ে এক নতুন ধরনের পরীক্ষামূলক সাংবাদিকতা মূলধারার মিডিয়াতে প্রতিষ্ঠিত করেছেন।
ফটোসাংবাদিকতায় শহিদুল আলম এবং তার প্রতিষ্ঠান দৃক ও পাঠশালা বা লিপ্ত সাংবাদিকতার পথিকৃৎ। নৃবিজ্ঞান, সাংবাদিকতা, ফটোগ্রাফি এবং অ্যাকটিভিজমের সংমিশ্রণে বাংলাদেশে একটি শক্তিশালী পথিকৃৎধারা সৃষ্টি করেছেন। প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতাকে প্রতিবেদন ও তথ্যচিত্রে উচ্চতর দক্ষতার সঙ্গে নিয়ে এসেছেন, যেখানে পাঠক, দর্শকের ঠিক ওই মুহূর্তে ওই বিশেষ পরিস্থিতির সামনে দাঁড়াবার অনুভূতি হয়। সংবাদ বা ছবির সঙ্গে নিছক নিষ্ক্রিয় দর্শক না হয়ে ব্যক্তিগতভাবে ওই গল্পে ঢুকে পড়েন।
এই ধরনের সাংবাদিকতার সবচেয়ে শক্তিশালী জায়গাটি হল, মধ্যবিত্তের চায়ের কাপে ঝড় তোলার সংবাদমাত্র না হয়ে, এটি পাঠক-দর্শককে সক্রিয় চিন্তাশীল সত্তা হিসেবে নির্মাণ করে। এটি নির্লিপ্ত সাংবাদিকতার স্থলে লিপ্ত সাংবাদিকতার নতুন ধারণা সৃষ্টি করেছে, যা পাঠক-দর্শককেও নির্লিপ্ত থাকতে দেয় না। মস্তিষ্ককে সক্রিয় ও কর্মতৎপর করে তোলে। সংবাদে পরিবেশিত চরিত্রগুলো কেবল পণ্যমাত্র নয়, পূর্ণাঙ্গ জীবন্ত বুদ্ধিমান মানবসত্তা নিয়ে হাজির হয় এবং পাঠকের সঙ্গে গতিশীল যোগাযোগ সৃষ্টি করে, মানব অভিজ্ঞতার পারস্পরিক বিনিময় ঘটে। পাঠক-দর্শক সংবাদের সাথে প্রযুক্তির সহায়তায় নজিরবিহীনভাবে ওই সময়ের দৃশ্য-শব্দ, আবেগ-অনুভূতিতে প্রবেশাধিকার পায়। সংবাদের ফলাফল প্রতিক্রিয়ায় সীমাবদ্ধ না থেকে, ক্রিয়ায় সঞ্চালিত হয়। সংবাদ পরিবেশনা জনমানুষের শক্তিশালী যোগাযোগের হাতিয়ারে পরিণত হয়।
এথনোগ্রাফিক সাংবাদিকতা
সাধারণ মানুষের জীবনে সংঘটিত বিষয়গুলোই প্রধানত সংবাদ। পারিবারিক, ব্যাক্তিগত, সামাজিক জীবনের ইস্যুগুলো সংবাদ হতে হলে সেগুলোকে জনপরিসরে দৃশ্যমান হতে হয়। পরিমাণগত সাক্ষ্যের মধ্যে অন্তর্ভুক্ত হতে হয়। রাষ্ট্র ও প্রতিষ্ঠান নীতি ও বাজেট প্রণয়নে, কর্ম পরিকল্পনায় প্রামাণ্য সাক্ষ্যের উপর ভরসা করে, প্রকাশিত সংবাদের উপর নির্ভর করে। মূলধারার সাংবাদিকতা হার্ড ফ্যাক্ট ও শুষ্ক পরিসংখ্যান-নির্ভর নিরপেক্ষ ও বস্তুনিষ্ঠ সংবাদের উপর জোর দেয়। উন্নয়ন নীতিনির্ধারক প্রকল্পগুলো সংখ্যাতত্ত্ব ও পরিসংখ্যানের টেবিলে বিশ্বাস করে।
এর বিপরীতে, এথনোগ্রাফিক সাংবাদিকতার নতুন ক্ষেত্র প্রস্তুত হওয়াতে অপেক্ষাকৃত দীর্ঘকালীন পার্টিসিপ্যান্ট অবজারভেশন বা অংশগ্রহণকারীর পর্যবেক্ষণ পদ্ধতির আংশিক প্রয়োগ করে তৈরি করা ফিচার গল্প মিডিয়াতে বেড়ে উঠছে। সংবাদমূল্য হয়ে উঠেছে তথাকথিত ‘ঘটনাবহুল’ বিষয়ের বাইরে প্রতিদিনের জীবনের আটপৌরে বিষয়গুলো। শিরোনামে আসছে সাদামাটা জীবনের চিত্র যার জন্যে কার্যকর পদ্ধতি হল নৃবিজ্ঞানে বহুল ব্যাবহৃত পদ্ধতি ও কৌশল- অংশগ্রহণমূলক পর্যবেক্ষণ।
জনগোষ্ঠীর বিশ্বাস অর্জন করে তাদের নিত্যদিনের জীবনে অংশগ্রহণ করে তথ্যসংগ্রহের কৌশল ব্যবহার করে এথনোগ্রাফিক সাংবাদিকতার দিগন্ত খুলেছে। কোনো জনগোষ্ঠী সম্পর্কে গভীরভাবে অনুসন্ধানে এর জুড়ি নেই। এথনোগ্রাফিক তথ্যসমৃদ্ধ লেখায় প্রেক্ষিতকৃত ঘন বর্ণনা, ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ-আলোচনার পথ তৈরি করে সংবাদমাধ্যমে সৃষ্টিশীল গতি সৃষ্টি করে। বহুজাতি বহু সংস্কৃতির বাস্তবতাকে কেবল তথ্য পরিবশনে ধরা সম্ভব নয়। বাস্তবতার সূক্ষ ও জটিল দিকগুলোকে উপস্থাপন করে সংবাদ মাধ্যমকে আগের যে কোনো সময়ের চেয়ে সাংস্কৃতিক সংবেদনশীল করে তুলবার প্রয়োজন, সুযোগ ও সময় হয়েছে।
সাংবাদিক যেখানে কে, কোথায়, কীভাবে, কেন প্রশ্ন করে ঘটনাকে উন্মোচন করেন, নৃবিজ্ঞানী এই প্রশ্ন করেন উপাত্ত সংগ্রহের গোটা পদ্ধতিকেই- তথ্যের উৎস কে হবে, কোথায় হবে, কখন সংগ্রহ করা হবে এবং কেনই বা এই উপাত্ত আদৌ প্রয়োজন। মিশেল ফুঁকোর ক্ষমতা ও জ্ঞানের সম্পর্কের উন্মোচনের পরে খোদ লেখার সংস্কৃতিই পুনঃবিবেচিত হয়, যেখানে সাবজেক্টকে বিষয়বস্তু করবার ঝুঁকি সম্পর্কে সজাগ হয়ে ওঠে এবং লেখকের নিজের অবস্থা বিচার করা আবশ্যিক হয়ে ওঠে। সংবাদ সংগ্রহকারীর চশমা দিয়ে অপরের বাস্তবতা বুঝতে পারবার সীমাবদ্ধতা স্বীকৃত হয়।
প্রান্তিক মানুষের জীবনকে সংবাদের শিরোনামে ফ্রেম করতে এথনোগ্রাফিক সাংবাদিকতা বাইরে না থেকে জনগোষ্ঠীর জীবনে নিমজ্জিত হয়ে নয়া সাংবাদিকতার সূচনা করে যাচ্ছে। কৃষক সমাজ, বর্গা চাষি, চিংড়িচাষি, জুম চাষি, পাহাড়ে ও সমতলের বহুজাতির মানুষ, সীমান্তে ও ক্যাম্পে আটকেপড়া রাষ্ট্রহীন মানুষ, ছিটমহলের বাসিন্দা, জেলেপাড়া, কারাগার, হাসপাতাল, ক্লিনিক, ডায়াগনস্টিক সেন্টার, এতিমখানা, মাদ্রাসা, আবাসিক বিদ্যালয়, কিশোর সংশোধন কেন্দ্র, মাদকাসক্তি নিরাময় ও পুনর্বাসন কেন্দ্র, পাগলা গারদ, টার্মিনাল, ঢাকার বস্তি, পোশাক কারখানা, প্রবাসী শ্রমিক, রোহিঙ্গা শরণার্থী, বেশ্যালয়, দলিত জনগোষ্ঠীর জীবনের বিবরণী দলিল প্রকাশের মধ্য দিয়ে বহুজাতির বাংলাদেশ গঠনের সৃষ্টিশীলতার পথ উন্মুক্ত হবে। সাংবাদিকতার উচ্চবর্গবাদী ধারার পাশে জনমানুষের সাংবাদিকতা শক্তিশালী হয়ে উঠবে নিম্নবর্গের কণ্ঠস্বর শোনার প্রস্তুতির মধ্য দিয়ে, প্রান্ত থেকে কণ্ঠস্বরগুলোকে ধারণ ও শিরোনাম করে তোলার, প্রান্তকে দৃশ্যমান করে তোলার, শিক্ষিত মধ্যবিত্ত বাঙালি মুসলমান পুরুষের আধিপত্যের বাইরে বৈচিত্র্যময় অবস্থানগুলো শক্তিশালী করবার মধ্য দিয়ে।
কিন্তু একই সঙ্গে সতর্ক হওয়ার বিষয় হলো ‘অন্যের’ জীবনের লুকানো বিষয়গুলো প্রকাশে আপনার-আমার কতখানি এখতিয়ার আছে? এর ঝুঁকি সম্পর্কে আমরা কতটা ওয়াকেবহাল? উত্তরদাতার সম্মতি, অনুমোদন এবং গোপনীয়তা প্রকাশ পাওয়ার পরিণাম সম্পর্কে ভালোভাবে জানা আছে তো? এটি যে আড়াল উন্মোচন করতে সক্ষম, সেই আড়াল উন্মোচনের দায়-দায়িত্ব নিতে আমরা কতখানি প্রস্তুত? আজকের আলোচিত এথনোগ্রাফিক সাংবাদিকতা খুলে দিতে পারে প্যানডোরার অনেক বাক্স। এগুলো সামলানোর জন্য আমরা কীভাবে প্রস্তুত হবো? অপরের গোপনীয়তা প্রকাশের কতদূর নৈতিক অধিকার আমাদের আছে? এ নিয়ে এখনও বিস্তর আলাপ বাকি রইল।
লেখক : সহযোগী অধ্যাপক, নৃবিজ্ঞান বিভাগ
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়