Logo
×

Follow Us

মিডিয়া

স্বাস্থ্য নৃবিজ্ঞানের দৃষ্টিতে করোনা আতঙ্ক: বাংলাদেশ কেস

Icon

মাহাদী হাসান রনি

প্রকাশ: ২০ মার্চ ২০২০, ১৩:৪১

স্বাস্থ্য নৃবিজ্ঞানের দৃষ্টিতে করোনা আতঙ্ক: বাংলাদেশ কেস

১. করোনাভাইরাস আতঙ্কে সারা বিশ্বের মানুষ এখন ভীত। বাংলাদেশও এর বাইরে নয়। সর্বশেষ খবর মতে বাংলাদেশে ১৭ জন কোভিড-১৯ এ আক্রান্ত হয়েছে। ইতোমধ্যে বাংলাদেশে ১ জন এ ভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুবরণ করেছে। চীনের উহান শহর আক্রান্ত হওয়ার পর প্রায় ৩ মাস পার হয়ে গেছে যার মানে হলো বিপদ মোকাবেলায় বাংলাদেশ প্রায় ৩ মাস হাতে পেয়েছিল।

তিন মাস পরেও কেন আমরা বিপদ মোকাবেলায় হিমশিম খাচ্ছি তা বিশ্লেষণের দাবি রাখে। আপাতত এই বিপদ থেকে রক্ষা পেলে কোথায় কোথায় ঘাটতি ছিল তা খুজে বের করার মাধ্যমে ভবিষ্যতে এরকম সমস্যা মোকাবেলার জন্য আমাদের অগ্রিম প্রস্তুতি গ্রহণ করতে হবে।

২. কিছুদিন আগে একটা বিশ্ববিদ্যালয়ে জনস্বাস্থ্য বিষয়ে পড়াতে গিয়েছিলাম । পড়ানোর বিষয় ছিল যে কোন ধরনের জনস্বাস্থ্য সংক্রান্ত রোগ মোকাবেলায় স্থানীয় সামাজিক ও সাংস্কৃতিক ফ্যাক্টরসমূহ বিবেচনায় নেওয়া। এর কারণ হলো ডাক্তার রা সাধারনত ইনডিভিজুয়াল রোগিকে চিকিৎসা দেয় কিন্তু যখন কোন রোগ জনস্বাস্থ্যের জন্য হুমকি হয়ে দাড়ায় বা যখন কোন রোগের সঠিক কোন চিকিৎসা দেয়া যায়না, প্রতিরোধই সর্বত্তম উপায়, ঠিক এরকম পরিস্থিতিতে ডিাক্তারদের থেকে জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা বেশি ভূমিকা রাখতে পারে।

সাধারণত এরকম পরিস্থিতিতে জনসচেতনতা তৈরি ও রোগটি প্রতিরোধ করার উপরে বেশি জোর দিতে হয়। তো এরকম ইন্টারভেনশন দেওয়ার ক্ষেত্রে ঐ সমাজ ও সংস্কৃতির মানুষের অভ্যাস, বিশ্বাস, মূল্যবোধ, আর্থসামাজিক অন্যান্য ফ্যাক্টরগুলি বিবেচনায় নিতে হয় আর এখানেই স্বাস্থ্য নৃবিজ্ঞান জনস্বাস্থ্যের সাথে একসাথে কাজ করে এবং এই দুটি ডিসিপ্লিন একে অন্যের সক্ষমতাকে গ্রহন করে যৌথভাবে সমস্যাটিকে মোকাবেলা করে।

৩. জনস্বাস্থ্য নিয়ে পড়াশোনা করার আগে কোয়ারেন্টিন শব্দটি আমি আগে কখনো শুনিনি। আই সি ডি ডি আর, বি তে গবেষণার সময় এমার্জিং ইনফেকশাস ডিজিজ বা নতুন নতুন যে সংক্রামক ব্যাধি যা আগে কখনো দেখা যায়নি সে বিষয়ে কাজ করতাম। কাজের পাশাপাশি জনস্বাস্থ্য নিয়ে পড়াশোন করা শুরু করি। তখন জানতে পারি কোয়ারেন্টিন বিষয়টি আসলে কি। কোয়ারেন্টিন হলো যখন কোন সংক্রামক ব্যাধিতে কেউ আক্রান্ত হয় তাকে বা ঐ জনগোষ্ঠিকে অন্যদের থেকে পৃথক করে রাখা যাতে আক্রান্ত ব্যাক্তি সুস্থ কাউকে আক্রান্ত না করতে পারে।

আমাদের দেশে হঠাৎ দেখলাম কর্তাব্যক্তিরা বিদেশ ফেরত মানুষদের সেল্ফ কোয়ারেন্টিন এ থাকতে বলছেন। লক ডাউন, সেল্প কোয়ারেন্টিন এই শব্দগুলো আমাদের দেশের শিক্ষিত মানুষেরাই ভালো করে জানে না। কেন সেল্ফ কোয়ারেন্টিন এ থাকবে, কিভাবে থাকবে, থাকলে ঐ ব্যক্তির কি লাভ হবে, তার পরিবারের কি লাভ হবে, দেশের কি লাভ হবে- এ বিষয়গুলো পরিষ্কার করে বুঝিয়ে বলা প্রয়োজন ছিল। আমাদের দেশের সাংস্কৃতিক বৈশিষ্ট্য  হলো কেউ বিদেশ থেকে আসলে আত্মীয় স্বজন দেখতে আসে, পাড়া প্রতিবেশি দেখতে আসে ।

আবার কেউ অসুস্থ হলে সবাই আপেল কমলা নিয়ে দেখতে আসে। এরকম পরিস্থিতিতে সেল্ফ কোয়ারেন্টিন যে কাজ করবে না তা তো আগেই বোঝা প্রয়োজন ছিল।

৪. অনেক বিদেশ ফেরত মানুষ অসুস্থ হওয়ার পরে পত্রিকা মারফত দেখলাম তারা ডাক্তারের কাছে তা লুকাচ্ছে। কেউ কেউ হাসপাতাল থেকে পালিয়েও যাচ্ছে। কেন এ রকম একটা ভয়ের পরিবেশ তৈরি হলো তা খতিয়ে দেখা দরকার। অন্যদিকে ভয় ছড়িয়ে পড়ায় তার অন্যান্য প্রভাব ও পড়তে দেখা যাচ্ছে । যেমন, মানুষ প্রয়োজনের তুলনায় বেশি নিত্যপ্রয়োজনীয় খাদ্য সামগ্রী ক্রয় করছে যার প্রভাব বাজারে পড়তে শুরু করেছে।

আবার বাজারে কোথাও স্যানিটাইজার নাই, মাস্ক নাই। আমরা যে তিন মাস সময় পেয়েছিলাম তার বিপরীতে আমরা কী ব্যবস্থা নিতে পারলাম? হজ্জ ক্যাম্পে যে কোয়ারেন্টিনের ব্যবস্থা করা হলো তা তো অপ্রতুল ছিল। দুইশো মানুষকে ৩/৪ টা গণ রুমে রাখা কি কোনভাবে স্বাস্থ্য সম্মত? যদি এক/দুই জন মানুষ ও করোনা আক্রান্ত হয়ে থাকে তাহলে বাকিদের আমরা ঝুঁকির মধ্যে ফেলে দিলাম না?

৫. লক্ষীপুরে দেখলাম করোনা মোকাবেলায় বিশাল মোনাজাতের আয়োজন করা হয়েছে। আমাদের দেশের মানুষ ধর্মভীরু এবং এরকম বিপদে মোনাযাতের আয়োজন হবে এটা স্বাভাবিক। অনেকে দেখলাম এটা নিয়ে বিদ্রুপ করছেন। এখানে বিদ্রুপ করার কিছু নেই । ধর্মীয় বিশ্বাস তো সংস্কৃতিরই একটা বড় কম্পোনেন্ট। কিন্তু যেটা করার দরকার ছিল তা হলো আগে থেকেই ধর্মীয় গুরুত্বপূ্র্ণ ব্যক্তিদের সাথে কথা বলে এ রকম সেনসিটিভ বিষয়গুলি সমাধান করা।

উদাহরণ স্বরুপ সৌদিআরবে শুনলাম মসজিদে জামাত স্থগিত রেখেছে তো আমাদের দেশের ধর্মীয় নেতারা মানতে চাচ্ছেন না। এখন এরকম গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে আলেম সমাজের প্রতিনিধিদের সাথে আলোচনার মাধ্যমে বিষয়টির গরুত্ব ও গভীরতা বুঝিয়ে বলে সমাধান করা যেতে পারতো। আবার আজ রাতে ৭১ টিভিতে দেখলাম আক্রান্ত কেউ মারা গেলে তাকে কবর দেওয়া হবে না পোড়ানো হবে তা নিয়ে আলোচনা করছেন ।

ডা: এ বি এম আবদুল্লা বার বার বলছেন প্রটেকশন নিয়ে কবর দিলে কোন সমস্যা নেই কিন্তু মডারেটর বার বার পোড়ানো বেশি বিজ্ঞানভিত্তিক হবে কিনা সে ব্যাপারে জানতে চাচ্ছেন (একাত্তর জার্ণাল, সময়: ১২:১৫ মি:)। এ রকম সেনসিটিভ ব্যাপারে অযথা আলোচনা করে বিতর্ক তৈরি করার কোন মানেই হয়না। আমাদের মনে রাখতে হবে এ রকম ভয়াবহ বিপদ মোকাবেলায় সমাজের সব শ্রেনীর সকল মানুষের সমান বোঝাবুঝি ও সমান অংশগ্রহণ ভীষণভাবে প্রয়োজন।

৬. মূল কথা হলো বিদেশী শব্দ ব্যবহারের আগে আমাদের সাংস্কৃতিক বাস্তবতা বিবেচনা করা প্রয়োজন ছিল। কোন শব্দ ব্যবহারে বা কোন ভাষা ব্যবহারে আমরা মানুষদের আরো বেশি সচেতন করতে পারতাম তা আমাদের বিবেচনা করা প্রয়োজন ছিল। দ্বিতীয়ত আমাদের দেশের বাস্তবতায় হোম কোয়ারেন্টিন যে কাজ করবে না তা আমলে নিয়ে আমাদের হয় সমস্ত আন্তর্জাতিক ফ্লাইট বাতিল করা উচিৎ ছিল, না হয় হজ্জ ক্যাম্পের পরিবর্তে বিদেশ ফেরত মানুষদের জন্য অস্থায়ী কোয়ারেন্টিন বা পৃথক করে রাখার ভালো ব্যবস্থা করা দরকার ছিল।
এ ছাড়া পরিস্থিতি বিবেচনায় আমরা স্যানিটাইজার ও মাস্ক এর উৎপাদন/আমদানি/স্থানীয় জ্ঞান কাজে লাগিয়ে তৈরি বৃদ্ধি করতে পারতাম। আমরা ধর্মীয় প্রতিনিধিদের সাথে আগে থেকে আলোচনার মাধ্যমে সিদ্ধান্ত নিতে পারতাম, আমরা অভিভাবকদের বুঝিয়ে বলতে পারতাম যে স্কুল বন্ধ দেওয়া মানে বাচ্চাকে নিয়ে সমূদ্র দেখতে যাওয়ার সময় এখন নয়।
মোদ্দা কথা হলো আমাদের বিভিন্ন ডিপার্টমেন্টের মধ্যে আন্ত:সমন্বয় সাধনের মাধ্যমে গত তিন মাসে আমরা বিপদ মোকাবেলায় সমন্বিত উদ্যোগ নিতে পারতাম । সমন্বিত ও বাস্তবসম্মত উদ্যোগ নিলে বর্তমানে আমরা হয়তো আরো সক্ষমতার সাথে পরিস্থিতি সামাল দিতে পারতাম। তবে, সব কথার শেষ কথা হলো এখনো সময় ফুরিয়ে যায়নি। ব্যপক জনসচেতনতা ও সম্পর্কিত বিভিন্ন মন্ত্রণালয়/বিভাগ সমূহ, বেসরকারি সংস্থাসমূহ, মিডিয়া ও অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ স্টেকহোল্ডারদের মধ্যে সুষ্ঠ সমন্বয় সাধনের মাধ্যমে বাংলাদেশ এ বিপদ থেকে রক্ষা পেতে পারে। আর স্বাধীনতার এই মাসে এটা হোক আমাদের এই মুহূর্তের অঙ্গিকার।

লেখাটি মাহাদী হাসান রনির ফেসবুক স্ট্যাটাস থেকে নেয়া হয়েছে।

Logo

সম্পাদক ও প্রকাশক: ইলিয়াস উদ্দিন পলাশ

বার্তা ও বাণিজ্যিক কার্যালয়: ফেয়ার দিয়া ১১/৮/ই, ফ্রি স্কুল স্ট্রিট (লেভেল-৮), বক্স কালভার্ট রোড, পান্থপথ, ঢাকা ১২০৫