-(1)-5e773378d7c15.jpg)
করোনা দ্রুত ছড়িয়ে পড়ছে। আমরা সাধ্যমত চেষ্টা করছি করোনা থেকে নিজেদের ও পরিবারের সদস্যদের নিরাপদ রাখতে। সমস্যা হলো করোনা যেভাবে পৃথিবীর অন্যান্য দেশে ছড়িয়েছে তা বিশ্লেষণ করলে দেখা যায় এটা মোটামুটি ক্ষমতা, আর্থ-সামাজিক অবস্থান, ধনী দরিদ্র নির্বিশেষে সবাইকেই আক্রান্ত করছে।
স্বাভাবিকভাবেই আমাদের দেশেও করোনা একইভাবে ছড়াবে। কিন্তু সমস্যা হলো ধনী দেশগুলোতে স্বাস্থ্য সেবার মান ও প্রতুলতা ভালো হওয়ায় মৃত্যুর হার বেশ কম কিন্তু আমাদের মত স্বল্প আয়ের দেশে করোনার ফাটালিটি রেট বা মৃত্যুর হার অনেক বেশি হবে (সূত্র: বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা)।
কম বয়সী অনেকেই মনে করছে করোনা বয়োঃজৈষ্ঠ্যদের আক্রান্ত করবে বা বয়স্ক মানুষেরা বেশি বিপদে রয়েছে কিন্তু দরিদ্র দেশগুলোতে শঙ্কা করা হচ্ছে কম বয়সীরাও সমানভাবে বিপদগ্রস্থ হতে পারে। আর এই আশঙ্কা সত্যি হলে বাংলাদেশসহ দরিদ্র দেশগুলোতে ভয়াবহ বিপর্যয় নেমে আসবে। দরিদ্র দেশগুলোতে স্বাস্থ্য ঝুঁকি যেমন বেশি ঠিক একইভাবে অন্যান্য ঝুঁকিও অনেক বেশি।
স্বাস্থ্য ঝুঁকির পাশাপাশি করোনার কারণে দরিদ্র দেশগুলোতে এর আর্থ-সামাজিক ঝুঁকিও রয়েছে। ধনী দেশগুলোতে নাগরিকদের দৈনন্দিন নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্য সামগ্রী সরবরাহ করা হচ্ছে। যেমন ধরুন কানাডা তার নাগরিকদের এমন সুবিধা দিতে পারছে কারণ রাষ্ট্রের সেই সক্ষমতা রয়েছে কিন্তু একই পরিস্থিতি আমাদের দেশে হলে আমরা কতজনকে এরকম সামাজিক নিরাপত্তা সুবিধা দিতে পারবো?
দ্বিতীয় বিষয় হলো নাগরিক সমস্যা। আমাদের দেশে মানুষের মধ্যে সচেতনতার লেভেল আর কানাডা বা উন্নত বিশ্বের নাগরিকদের সচেতনতার লেভেল এক নয়। আমরা মাস্ক না মার্ক্স এ বিতর্কে দুই গ্রুপে মারামারি করি এবং মানুষ খুন করি। রাজবাড়ীতে দেখলাম রোগী করোনায় আক্রান্ত হয়ে মারা গেছে কি না সেই বিতর্কে দুই দলের সংঘর্ষে একজন মারা গেছে। আমরা অনেক বেশি গুজবে কান দেই। যে কোন বিষয়কে আমরা সহজেই সাম্প্রদায়িক রূপ দেই। করোনার ফলে আসন্ন বিপদের মধ্যেও আমরা হাজারো লোকের সমাগম করি। শূন্য আসনে নির্বাচন করি, বিবাহত্তোর সংবর্ধনার আয়োজন করি, আমাদের স্বাস্থ্য মন্ত্রী চারপাশে অজস্র মানুষ নিয়ে করোনা বিষয়ে সংবাদ ব্রিফিং করেন। আমাদের দেশের কর্তাব্যক্তিদেরই যখন এই অবস্থা তখন ঠিক কী বার্তা আমরা দেশবাসীকে দিতে পারছি তা ভেবে দেখার বিষয়।
তৃতীয় বিষয় হলো প্যানিক বায়িং যার বাংলা করলে দাঁড়ায় আসন্ন বিপদ আঁচ করতে পেরে মানুষ যখন ভীত সন্ত্রস্ত হয়ে পাগলের মত নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্য কিনতে থাকে। প্রয়োজনের তুলনায় তখন মানুষ দ্বিগুণ তিনগুণ বেশি ক্রয় করে এবং যা বাজারের উপরের খুবই নেতিবাচক প্রভাব ফেলে। সম্পূর্ণ ভ্যালুচেইন সিস্টেমটাই ভেঙ্গে পড়ে এবং এই সুযোগে ব্যবসায়ীরা দাম বাড়িয়ে দেয়। ধরুন যে পণ্যের দাম ৫০ টাকা প্রতি কেজি ছিল সেটা হয়তো ৮০ টাকা বা তারও বেশি হয়ে যায়। যেমন, গত কয়েক মাস ধরেই বাংলাদেশে পেঁয়াজের দাম অনেক বেশি ছিল। সম্প্রতি দাম কমে ৪০/৪৫ টাকা হয়েছিল কিন্তু এখন আবার বেড়ে ৭০ টাকা হয়ে গেছে যা এই প্যানিক বায়িং এর ফলাফল। এটা কিন্তু শুধু আমাদের দেশে হয়েছে তা নয় বরং উন্নত বিশ্বের অনেক দেশেও একই অবস্থা তৈরি হয়েছে। অস্ট্রেলিয়ায় দেখলাম সুপারশপে কোন পাউরুটি পাওয়া যাচ্ছে না, এমনকি টিস্যু পেপারও নেই। কিন্তু আমাদের দেশের সমস্যা হলো ক্রয় ক্ষমতা সবার এক রকম না। যার টাকা আছে সে হয়তো কিনে রাখছে কিন্তু হাজার হাজার মানুষ যারা দিন আনে দিন খায়, তাদের কি হবে? বাড়তি দাম দিয়ে তারা কি কিনতে পারবে? এই প্যানিক বায়িং বন্ধ করতে ডেনমার্ক দেখলাম খুব ভালো একটা উদ্যোগ নিয়েছে। ডেনমার্কের সুপার শপে এক বোতল স্যানিটাইজার বিক্রি হচ্ছে স্বাভাবিক দামে কিন্তু যদি কেউ এক সাথে ২ বোতল কিনতে চায় তাহলে কয়েকগুন বেশি দামে কিনতে হবে ফলে মানুষ বাধ্য হয়ে প্রয়োজনের তুলনায় বেশি ক্রয় করছে না।
চতুর্থ বিষয় হলো অর্থনৈতিক সমস্যা। কাঁচামালের অভাবে অধিকাংশ গার্মেন্টস ফ্যাক্টরি কিছুদিনের মধ্যে বন্ধ হয়ে যেতে পারে। খবরে দেখলাম নীলফামারির উত্তরা ইপিজেডের অনেক ফ্যাক্টরির মজুদকৃত কাঁচামাল শেষ কারণ হলো প্রয়োজনীয় কাঁচামাল চীন থেকে আমদানি করা হতো। বর্তমানে আমাদানি বন্ধ থাকায় অনেক ফ্যাক্টরিতেই কাজ বন্ধ হওয়ার উপক্রম হয়েছে যার অর্থ হলো একটা বিশাল অংকের মানুষ বেকার হতে চলেছে। খবরে দেখলাম শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকায় এবং মানুষ রাস্থায় কম বের হওয়ায় অনেক দিন মজুর ও শ্রমিক কাজ না থাকায় ঢাকা ছেড়ে গ্রামের বাড়ি চলে যাচ্ছে। এই মানুষগুলোর তো এমন কোন জমানো টাকা নেই যে তারা আগামী দুই তিন মাস কাজ না করেও জীবন চালাতে পারবে। করোনা গ্রামে-গঞ্জে ছড়িয়ে পড়লে আমাদের দেশের একটা বড় অংশের মানুষ উপার্জন ছাড়া থাকবে এবং এই আপদকালীন সময়ে তাদের খেয়ে পরে বেঁচে থাকাটাও কঠিন হয়ে পড়বে। একদিকে উপার্জন থাকবে না অন্যদিকে যাদের হাতে টাকা আছে তাদের বিবেক বর্জিত প্যানিক বায়িং এর ফলে বাজারে মূল্যবৃদ্ধিতে কম ও নিম্ন আয়ের মানুষজনের বেচেঁ থাকাটা কঠিন হয়ে পড়বে।
অন্য আরেকটি বিষয় হলো পুষ্টি সমস্যা। বাজারে দ্রব্যমূল্যের উর্ধগতির ফলে কম আয়ের মানুষেরা কম খাবে যা তাদের ও তাদের পরিবারের সদস্যদের প্রয়োজনীয় পুষ্টি চাহিদা পূরণ করতে পারবে না যার পরিণামে শরীরে ইমুইনিটির ঘাটতি তৈরি হবে। ইমুইনিটি ঘাটতি হলে করোনাসহ অন্যান্য রোগ ব্যাধিতে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি বৃদ্ধি পাবে।
মূল বিষয়টি হলো করোনার স্বাস্থ্যগত ঝুঁকি তো রয়েছেই পাশাপাশি দরিদ্র দেশগেুলোতে এর আর্থসামাজিক ঝুঁকিও রয়েছে যা এখনি বিবেচনায় নেওয়া জরুরি। রাষ্ট্রের দায়িত্ব হলো সকল নাগরিকের সুরক্ষা নিশ্চিত করা। বাজার মনিটরিং এর পাশাপাশি করোনার প্রভাবে এদেশের লক্ষ লক্ষ সাধারণ মানুষ যেন ক্ষুধা ও দারিদ্র্যের শিকার না হয় সে দিকেও লক্ষ্য রাখতে হবে। এই মুহূর্তে আমাদের সমন্বিত উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে। একদিকে করোনার ভয়াবহ ছোবল থেকে দেশকে রক্ষা করতে হবে পাশাপাশি করোনার ফলে সৃষ্ট আর্থিক সংকট থেকেও দরিদ্র মানুষদের সুরক্ষা দিতে হবে। আফ্রিকার দরিদ্র দেশ উগান্ডা। দেশটিতে করোনা ভয়াবহ রূপ না নিলেও দেশটির সরকার নাগরিকদের সুরক্ষা দিতে ইতোমধ্যে কিছু উদ্যোগ গ্রহণ করেছে। উগান্ডা পারলে আমরা পারবো না?
তবে রাষ্ট্রের পাশাপাশি আমাদের অর্থাৎ নাগরিকদেরও দায়িত্বশীল আচরণ করতে হবে। একটা কথা আমাদের বুঝতে হবে যে দেশে কোন দুর্ভিক্ষ শুরু হয়নি যে আমাদের আগামী ছয় মাসের বাজার একদিনে করে স্টক করতে হবে। বিষয়টা এমন নয় যে এদেশের লক্ষ লক্ষ মানুষ না খেয়ে থাকবে আর আমি আপনি ঘরে শান্তিতে পেট ভরে খাবো আর করোনা থেকে মুক্ত থাকবো। আমাদের একটা কথা মনে রাখতে হবে যে নগর পুড়লে দেবালয় রক্ষা পায় না।
লেখাটি মাহাদী হাসান রনির ফেসবুক স্ট্যাটাস থেকে নেয়া।