Logo
×

Follow Us

মিডিয়া

প্রকৃতির সাথে সহাবস্থান: করোনা থেকে শিক্ষা

Icon

মাহাদী হাসান রনি

প্রকাশ: ০৪ এপ্রিল ২০২০, ১৩:২৩

প্রকৃতির সাথে সহাবস্থান: করোনা থেকে শিক্ষা

প্রথমবার কক্সবাজার যাই ১৯৯৪ সালে। যদিও ২৬ বছর আগের কথা কিন্তু স্পষ্ট মনে আছে, সাগর পাড়ে যেয়ে হাজার হাজার স্টারফিস, অসংখ্য শামুক ঝিনুক, বিস্তির্ণ বালুচর জুড়ে সাগর লতা, অসংখ্য পাখি দেখতে পেয়েছিলাম। সাগরের পানি বেশ পরিষ্কার আর নীল ছিল। জীবনে প্রথম সাগর দেখা বলে কথা, প্রতিটি মূহুর্তের কথা এখনো স্পষ্ট মনে আছে।

দ্বিতীয়বার কক্সবাজার যাই ২০০৮ সালে। বিশ্ববিদ্যালয়ে তখন মাস্টার্স- এ পড়ি। মাইগ্রেশন কোর্সের অংশ হিসাবে রোহিঙ্গা ক্যাম্পে একটা গবেষণার কাজে গিয়েছিলাম। সেই বার কক্সবাজার যেয়ে ছোটবেলার কক্সবাজারের স্মৃতির সাথে একদম মেলাতে পারিনি। কোন স্টারফিস ছিল না বীচে, তবে কিছু কাঁকড়া দেখতে পেয়েছিলাম আর সাথে সাগর লতা। অসংখ্য মানুষ দেখতে পেয়েছিলাম। বীচে থেকে তাকালে সারি সারি হোটেল দেখা যায়। অসংখ্য নতুন হোটেলের কাজ চলছে দেখতে পেয়েছিলাম। যাইহোক তখনও কক্সবাজার প্রকৃতির আর্শিবাদ থেকে বঞ্চিত হয়নি।

তৃতীয়বার কক্সবাজার যাই ২০১৫ সালে। ২০০৮ সালের সাথেও ২০১৫ সালের স্মৃতি একদমই মেলাতে পারিনি। স্টারফিস তো ২০০৮ এও দেখতে পাইনি । ক্রমাগত জনসমাগমের ফলে লাল কাঁকড়া, সাগর লতা যা ২০০৮ সালেও দেখেছিলাম ২০১৫ সালে তাও বিলুপ্ত হয়ে গিয়েছিল। এরপর যতবার কক্সবাজার গিয়েছি বীচে শুধু অসংখ্য মানুষ দেখেছি। মানুষের ভীড়ে দাড়ানোর যায়গা পাওয়া যায়না। মানুষেরই যেখানে দাড়ানোর জায়গা হয়না তো সেখানে প্রকৃতির অন্য প্রাণীর সুযোগ কই?

মোটামুটি একই রকম চিত্র দেখতে পেয়েছি দেশের অন্য ট্যুরিস্ট স্পটগুলোতেও। যেখানেই মানুষ বেশি গিয়েছে সেখানে প্রাকৃতিক পরিবেশ নষ্ট হয়েছে। আমরা যারা ঢাকা শহরে দীর্ঘদিন যাবত থাকি তারা বুঝতে পারবো এই শহর কিভাবে দিনে দিনে দূষণের শিকার হয়েছে। 

সেটা বুড়িগঙ্গার তলদেশে কয়েক স্তরের পলিথিন দূষণ হোক, তুরাগসহ ঢাকা শহরের চারপাশ দিয়ে বয়ে যাওয়া অন্য নদীগুলোর দুষিত কালো নোংরা পানিই হোক আর বায়ু দূষণে সম্প্রতি ঢাকা শহরের অগ্রগামী অবস্থানই হোক, উন্নয়নের সাথে প্রকৃতি দূষণ যেন পাল্লা দিয়ে এগিয়েছে। 

শহর হোক আর নিভৃত গ্রাম হোক দূষণের হাত থেকে কিছুই রক্ষা পায়নি। উন্নয়নের নামে আর ক্রমাগত জনসংখ্যার চাপে বিভিন্নভাবে আমরা বুঝে অথবা না বুঝে ক্রমাগত প্রকৃতি ধ্বংস করে চলেছি। মানুষের চাহিদা পুরণে আমরা হয়তো ভুলে গিয়েছি প্রকৃতির ও কিছু চাহিদা রয়েছে।

দূষণের এই চিত্র যে শুধু বাংলাদেশে বা দরিদ্র দেশ গুলোতে এমন নয়। প্রকৃতি ধ্বংসে বরং উন্নত বিশ্বের দেশগুলোই অনেক এগিয়ে। বায়ুমন্ডলে সবচেয়ে কার্বন নির্গতকারী দেশ দুটো হলো চীন আর যুক্তরাষ্ট্র। ২০১৯ সালের সাথে ২০২০ সালের বর্তমান সময়ের তুলনায় দেখা যাচ্ছে চীন, যুক্তরাজ্য, যুক্তরাষ্ট্র, ফ্রান্স, ইতালি সহ আরো কিছু দেশের বাতাসে নাইট্রোজেন ডাইঅক্সাইডের পরিমান উল্লেখযোগ্য হারে কমেছে।

চীনের ক্ষেত্রে দেখা যাচ্ছে গত বছরের তুলনায় এ বছর প্রায় ৩০ শতাংশ দূষণ কম। এই চিত্র অন্যান্য দেশ গুলোর ক্ষেত্রেও দেখা যাচ্ছে যদিও বিজ্ঞানীরা বলছেন এটা নিয়ে কোন সিদ্ধান্তে পৌছাতে আরো গবেষণার প্রয়োজন। তবে গবেষণা না করেই অবশ্য দূষণ যে এখন যে কোন সময় থেকে কম তা চোখ বন্ধ করেই বল যায়। লন্ডনের বাসিন্দারা বলছেন যে তারা নিকট অতীতে এতটা পরিষ্কার আকাশ দেখেনি। ইটালিতে সাগর তীরে ডলফিন দেখা যাচ্ছে, লেকগুলোতে হাঁস ফিরে এসেছে।

একই চিত্র দেখা যাচ্ছে চীন, সিঙ্গাপুর, ইসরায়েল, যুক্তরাজ্য সহ অন্যান্য দেশগুলোতেও। আমাদের কক্সবাজারের সাগরেও ডলফিন দেখা যাচ্ছে। ফিরে এসেছে ২৬ বছর আগে দেখা লাল কাঁকড়া আর সাগর লতা । বিভিন্ন প্রজাতির পাখিও দেখা যাচ্ছে সাগর তীরে। আমাদের কুয়াকাটাতেও লাল কাঁকড়া ফিরে এসেছে। প্রকৃতি তার নিজস্ব রুপ আবার ফিরে পেতে শুরু করেছে।

প্রকৃতির এই নিজস্ব রুপ ফিরে পাওয়ার জন্য কোন মিরাকল কাজ করেনি। মাত্র কয়েক সপ্তাহের বিরতিতে প্রকৃতি নিজেকে একটু গুছিয়ে নেওয়ার সুযোগ পাচ্ছে। বিশ্বজুড়ে করোনা সংক্রমন থেকে বাঁচতে গোটা পৃথিবী এখন লকডাউনে রয়েছে। মানুষগুলো সব ঘর বন্দী আর এই সুযোগে প্রকৃতি একটু হাফ ছেড়ে বাঁচার চেষ্টা করছে। পরিবেশবিদগণ বলছেন করোনা সংক্রমন প্রকৃতিকে রিসেট বাটন প্রেস করার সুযোগ দিয়েছে। ‍

পৃথিবী জুড়ে দূষণ কমছে, কমছে কার্বন নি:সরন, কমছে বাতাসে নাইট্রোজেন অক্সাইডের পরিমান যা গ্লোবাল ওয়ার্মিং কমাতে ভূমিকা রাখবে। বিজ্ঞানীরা বলছেন এর সুফলও পৃথিবীর মানুষেরা পেতে শুরু করবে। বায়ুদূষণ জনিতে রোগ থেকে মানুষ রক্ষা পাবে। ‍কৃষিতেও এর সুফল মিলবে কারণ বায়ু দূষণের ফলে কৃষক ভালো ফসল পেতনা। কম দূষণ আর মানুষের টানা ঘর বন্দী থাকার ফলে প্রকৃতিতে জীববৈচিত্র্য প্রাণ ফিরে পাবে।

করোনা সংক্রমণ নিয়ে নানা ধরনের মতামত লক্ষ্য করা গেছে। শেষ খবর অনুযায়ী সমস্ত বিশ্বে এই প্রাণঘাতী ভাইরাস ছড়িয়ে পড়েছে। ৫০ হাজারের অধিক মানুষ মারা গেছে আর আক্রান্ত হয়েছে প্রায় ১ মিলিয়ন মানুষ। আক্রান্ত হওয়ার এবং মারা যাওয়ার গতি বিশ্লেষণ করলে দেখা যায় যত দ্রুত এই ভাইরাস ছড়াচ্ছে তাতে নিকট ভবিষ্যতে সারা পৃথিবীর মানুষের অস্তিত্ব সংকটের মুখে পড়তে পারে।

পৃথিবীব্যাপি মানুষের জীবনযাত্রা, খাদ্যাভাস,বৈশ্বিক রাজনীতি, অর্থনীতিসহ জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে করোনার ভয়াবহ প্রভাব পড়তে পারে। অসংখ্য মানুষ মারা যেতে পারে, দীর্ঘদিন যাবত বন্ধ থাকতে পারে একদেশের সাথে অন্য দেশেরে যোগাযোগ ব্যবস্থা। করোনাকে ঘিরে বৈশ্বিক ক্ষমতা সম্পর্কের ক্ষেত্রেও গুরুত্বপূর্ণ পরিবর্তন আসতে পারে।

কোভিড-১৯ এর সূত্রপাত নিয়ে এখন পর্যন্ত দুই ধরনের মতবাদ পাওয়া যাচ্ছে। প্রথমটি এবং মোটামুটি বিজ্ঞানীদের কাছে গ্রহণযোগ্য ব্যাখ্যাটি হলো এটা উহানের সামুদ্রিক বাজার থেকে ছড়িয়েছে। কেউ কেউ বলছেন এটা বাদুরের স্যুপ থেকে ছড়িয়েছে, কেউ কেউ বলছেন এটা প্যাঙ্গুলিন নামের বিলুপ্তপ্রায় স্তন্যপায়ী প্রাণী থেকে ছড়িয়েছে। উহানের এই বাজারটিতে বন্যপ্রাণী বেচাকেনা হতো। অন্যপক্ষটির বক্তব্য হলো এটা উহানের ল্যাবরেটরি থেকে ছড়িয়েছে যার তেমন কোন সত্যতা মেলেনি।

কোভিড-১৯ এর উৎসের বিষয়ে উপরের যেটাই সত্য হোকনা কেন পৃথিবীবাসীর অন্তত একটা কথা বোঝা প্রয়োজন সেটা হলো প্রকৃতির ওপর আমরা বড় বেশি অত্যাচার করে ফেলেছি। আমাদের মাত্র কয়েক সপ্তাহের ঘর বন্দী থাকার ফলাফল হিসাবে প্রকৃতির যে পরিবর্তন লক্ষ করা যাচ্ছে তাতে কোন ধরনের গবেষণা ছাড়াই বলা যায় প্রকৃতি ক্লান্ত হয়ে গিয়েছিল। প্রকৃতির তো একটু বিশ্রাম দরকার যেটাকে আমরা বলি ব্রেদিং স্পেস।

আর এই স্পেসটুকু না পেলে প্রকৃতি হয়তো নানাভাবে রিসেট বাটন প্রেস করবে, সেটা করোনর প্রাদুর্ভাব হোক, ভয়াবহ ভূমিকম্প হোক অথবা অন্যকোন দুর্যোগ হোক। পৃথিবীর মানুষদের একটা সহজ অংক বুঝতে হবে যে পৃথিবী মানুষ ছাড়াও আরো হাজার হাজার প্রাণীর আবাস স্থল। এটা মনুষ্য প্রজাতির একমাত্র আবাসভূমি নয়। প্রকৃতিতে সব প্রাণীর সহাবস্থান খুবই গরুত্বপূর্ণ। প্রকৃতির কাছে মনুষ্য প্রজাতির পাশাপাশি অন্য সব প্রাণীও সমান অর্থ বহন করে।

এখন মানুষ যদি প্রকৃতির এই স্বাভাবিক নিয়ম না মেনে ক্রমাগতভাবে প্রকৃতিকে ধ্বংস করতে থাকে তাহলে এরকম ঝাঁকুনি মাঝেমধ্যে আসবেই। মানুষের উচিত করোনা থেকে শিক্ষা নিয়ে প্রকৃতির অন্য সন্তানদের জন্য স্পেস ছেড়ে দেয়া এবং যুগপৎ অবস্থান করা। অন্যথায় এ যাত্রায় আমরা বেঁচে গেলেও ভবিষ্যতে অন্য কোনো দুর্যোগ আসবে আর সবসময় হয়তো আমরা বাঁচতে পারবোনা।


লেখাটি মাহাদী হাসান রনির ফেসবুক স্ট্যাটাস থেকে নেয়া হয়েছে। 

Logo

সম্পাদক ও প্রকাশক: ইলিয়াস উদ্দিন পলাশ

বার্তা ও বাণিজ্যিক কার্যালয়: ফেয়ার দিয়া ১১/৮/ই, ফ্রি স্কুল স্ট্রিট (লেভেল-৮), বক্স কালভার্ট রোড, পান্থপথ, ঢাকা ১২০৫