বেইলি রোড ট্র্যাজেডি
মুসলিম-হিন্দু বিতর্কে মর্গে পড়ে আছে নারী সাংবাদিকের লাশ

ডেস্ক রিপোর্ট
প্রকাশ: ০২ মার্চ ২০২৪, ১০:০৭

অভিশ্রুতি শাস্ত্রী (বৃষ্টি খাতুন)। ফাইল ছবি
মুসলিম নাকি হিন্দু? এই বিতর্কে মর্গে পড়ে আছে রাজধানীর বেইলি রোডে আগুনের ঘটনায় নিহত এক তরুণীর লাশ। তার বাবা দাবি করা ব্যক্তি বলছেন, তার নাম বৃষ্টি খাতুন। তবে সহকর্মী ও পরিচিতরা বলছেন, লাশটি অভিশ্রুতি শাস্ত্রীর।শুক্রবার বিকেল থেকে এই নিয়ে চলে পাল্টাপাল্টি লাশ দাবি।
কুষ্টিয়ার খোকসা উপজেলার বনগ্রাম এলাকার বাসিন্দা সবুজ শেখ। আগুনে পুড়ে মারা গেছে তার মেয়ে বৃষ্টি খাতুন- এমন খবর কানে আসার পর কুষ্টিয়া থেকে ছুটে এসেছেন ঢাকায়। রাত থেকে অজ্ঞাত পরিচয়ে পড়ে থাকা মেয়ের লাশ দেখে শনাক্ত করেন তিনি। বাবা পরিচয় দেওয়া সবুজ শেখ বলেন, তিনি ও তার মেয়েসহ পরিবার মুসলিম ধর্মাবলম্বী। সেই অনুযায়ী দেখান বৃষ্টির এনআইডি কার্ডের কপি। তবে এরপরই বাঁধে বিপত্তি। লাশটি দেখে তার সহকর্মী ও পরিচিতরা দাবি করেন, নিহত তরুণীর নাম অভিশ্রুতি শাস্ত্রী।
বাংলাদেশ পূজা উদযাপন পরিষদের সাংগঠনিক সম্পাদক বিপ্লব দে বলেন, নিহত ওই তরুণীর নাম অভিশ্রুতি শাস্ত্রী। সনাতন ধর্মের অনুসারী তিনি। পূজার্চনায় নিয়মিত অংশ নিতেন রমনা কালী মন্দির ও ঢাকেশ্বরীতে।
বিপ্লব দে ও অভিশ্রুতির সহকর্মীরা দাবি করেন, তিনি দ্যা রিপোর্ট অনলাইন পোর্টালের ইলেকশন কমিশন বিটের রিপোর্টার। এই নামেই সবাই চেনেন তাকে। অন্য একটি অফিসে যেই সিভি পাঠিয়েছিলেন সেখানেও তার নাম, অভিশ্রুতি শাস্ত্রী। তার সনাতন ধর্মাবলম্বী বাবা-মাকে খুঁজে বের করে তাদের হাতে লাশ বুঝিয়ে দেওয়ার দাবি তাদের।
এদিকে, সার্টিফিকেট, জন্ম নিবন্ধন ও জাতীয় পরিচয়পত্রে তার নাম বৃষ্টি খাতুন। বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন নিহতের পরিবার, স্বজন ও বেতবাড়ীয়া ইউনিয়নের ৭নং ওয়ার্ডের ইউপি সদস্য আব্দুল মজিদ।
তার বাবা শাবলুল আলম সবুজ ইসলাম ধর্মের অনুসারী এবং তার মা স্ত্রী বিউটি বেগমও ইসলাম ধর্মের অনুসারী। তবে অভিশ্রুতির বায়োডাটায় দেখা গেছে তিনি একজন সনাতন ধর্মাবলম্বী।
বৃষ্টির মা বিউটি বেগম ও তার খালা সাবানা খাতুন বলেন, বৃষ্টি কবে হিন্দু ধর্ম গ্রহণ করেছে জানি না। সে মুসলিম পরিবারের মেয়ে। সার্টিফিকেট, জন্ম নিবন্ধন ও জাতীয় পরিচয় পত্রে তার নাম বৃষ্টি খাতুন। তার লাশ আমরা গ্রামের বাড়িতে দাফন করব। বৃষ্টি যতই ভুল করুক না কেন, আমাদের সন্তান আমরা দাফন করব।
তামিম নামে বৃষ্টির কাজিন জানায়, বৃষ্টি ধর্মান্তরিত হয়েছিল। তারপর স্থানীয় কয়েকজনের সঙ্গে যোগাযোগ করে বিষয়টির সত্যতা মেলে।
৭নং ওয়ার্ডের ইউপি সদস্য আব্দুল মজিদ বলেন, অভিশ্রুতি শাস্ত্রীর আসল নাম বৃষ্টি। তিনি মুসলিম। বৃষ্টি ইডেন কলেজে পড়াশোনা করতেন। সার্টিফিকেট, জন্ম নিবন্ধন ও জাতীয় পরিচয়পত্রে তার নাম বৃষ্টি।
এদিকে, শুক্রবার বিকালে অভিশ্রুতির গ্রামের বাড়িতে গিয়ে দেখা যায়, মেয়ের সঙ্গে কথা বলবেন, তাই হন্নে হয়ে নিজের ফোন খুঁজছেন মা বিউটি বেগম। কখনো ফোনের জন্য চিৎকার করে সারা বাড়ি মাতম করে ফিরছেন। ফোন পেলেই মেয়ে বৃষ্টি খাতুনের কাছে ঢাকায় যাবেন। ছোট মেয়ে বর্ষা মাকে শান্ত করার চেষ্টা করছেন।
প্রতিবেশীরা যেন শোকে পাথর হয়ে গেছেন। নিহতের মাকে সান্ত্বনা দেওয়ার ভাষা হারিয়েছেন প্রতিবেশীরা। গ্রামের বাড়ি থাকেন মা বিউটি বেগম ও ছোট বোন দশম শ্রেণির ছাত্রী বর্ষা।
নিহত সাংবাদিকের বাবা শাবলুল আলম সবুজ রাজধানী ঢাকায় একটি বেসরকারি কোম্পানিতে চাকরি করেন। দরিদ্র পিতার তিনটিই কন্যা সন্তান। বৃষ্টি খাতুন সবার বড়। মেঝো মেয়ে শারমিনা সুলতানা ঝর্ণা রাজবাড়ী সরকারি কলেজে প্রথম বর্ষের ছাত্রী। ছোট মেয়ে বর্ষা পড়ে দশম শ্রেণিতে।
বৃষ্টি প্রাথমিক ও মাধ্যমিকে পড়েছেন গ্রামের বিদ্যালয়ে। উচ্চ মাধ্যমিক পড়েছেন কুষ্টিয়া সরকারি কলেজে। বিসিএস ক্যাডার হওয়ার স্বপ্ন নিয়ে ঢাকার ইডেন কলেজে দর্শন শাস্ত্র নিয়ে পড়ছেন। উচ্চ শিক্ষা শেষ করার আগে বিসিএস কোচিং নিয়ে ব্যস্ত ছিল।
নিহতের ছোট বোন শারমিনা সুলতানা ঝর্না বলেন, বৃহস্পতিবার দুপুরে মায়ের সঙ্গে বৃষ্টির শেষ বার মোবাইল ফোনে কথা হয়। বৃষ্টি সাংবাদিকতা করলেও বাড়ি থেকে মা টাকা পাঠাতেন। বড় বোনের মৃত্যুতে তাদের সব স্বপ্ন শেষ হয়ে গেছে।
তিনি বলেন, দুই মাস আগে অভিশ্রুতি সর্বশেষ গ্রামের বাড়ি এসেছিলেন।
তার বোন হিন্দু ধর্মে গ্রহণ করেছিলেন কি না এমন প্রশ্নে ঝরনা বলেন, এটা হতেই পারে না। আমার বোন মনে প্রাণে একজন মুসলিম। সে কখনই নিজ ধর্ম ত্যাগ করেনি। তবে সম্প্রতি তার বোন অভিশ্রুতি শাস্ত্রী নামে ফেসবুক আইডি খুলেছিলেন এবং ওই নামেই সাংবাদিকতা করতেন বলে স্বীকার করেন ঝর্না।
বেতবাড়ীয়া ইউপি চেয়ারম্যান ও বনগ্রাম মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক শফিকুল ইসলাম জানান, ওই বিদ্যালয় থেকে ২০১৫ সালে মানবিক বিভাগ থেকে এসএসসি করে বৃষ্টি। স্বাধীনচেতা ছিল। ছোট বেলা থেকে সে সরকারি বড় চাকরির স্বপ্ন দেখত।
বৃষ্টির ধর্মান্তরিত হওয়ার বিষয়টি তিনিও অস্বীকার করেন। তিনি বলেন, মাস দুয়েক আগে ওর সঙ্গে রাজধানীর ফার্মগেটে দেখা ও কথা হয়। তার দাবি ধর্মান্তরের যে কথাটি বলা হচ্ছে তা সম্পূর্ণ মিথ্যা।
এর আগে, গত বৃহস্পতিবার (২৯ ফেব্রুয়ারি) রাত ৯টা ৫০ মিনিটে আগুনের ঘটনা ঘটে। ফায়ার সার্ভিসের ১৩টি ইউনিটের ২ ঘণ্টার চেষ্টায় রাত ১১টা ৫০ মিনিটে আগুন নিয়ন্ত্রণে আসে। আগুন নিয়ন্ত্রণে কাজ করেছে পুলিশ, আনসার, র্যাব ও এনএসআই। এই অগ্নিকাণ্ডে এখন পর্যন্ত ৪৬ জনের মৃত্যুর তথ্য নিশ্চিত হওয়া গেছে।
এ ঘটনায় আহতদের মধ্যে শেখ হাসিনা জাতীয় বার্ন ও প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউটে ১০ জন এবং ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে দুজন ভর্তি আছেন। তাদের প্রত্যেকের অবস্থাই আশঙ্কাজনক বলে জানিয়েছেন স্বাস্থ্যমন্ত্রী ডা. সামন্ত লাল সেন। আহতদের চিকিৎসার সমস্ত ব্যয়ভার সরকার বহন করছে বলেও জানিয়েছেন তিনি।