দুবাই আনলকড: যে প্রতিবেদনে বের হলো ধনীদের ‘থলের বিড়াল’

নিজস্ব প্রতিবেদক
প্রকাশ: ১৬ মে ২০২৪, ১৮:৫৬

‘দুবাই আনলকড’ নামে বৈশ্বিক অনুসন্ধানী সাংবাদিকতার এক প্রকল্পে দুবাইয়ে গড়ে ওঠা ধনীদের গোপন সম্পদের তথ্য ফাঁস হয়েছে। ছবি: সংগৃহীত
সংযুক্ত আরব আমিরাতের দুবাইয়ে বিশ্বের বিভিন্ন দেশের ধনাঢ্য ব্যক্তিদের ‘থলের বিড়াল’ তথা গোপনে সম্পদের তথ্য-উপাত্ত ফাঁস করে একটি অনুসন্ধানী প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে একটি বৈশ্বিক অনুসন্ধানী সাংবাদিকতা প্রকল্প 'অরগ্যানাইজড ক্রাইম অ্যান্ড করাপশন রিপোর্টিং প্রজেক্ট' (ওসিসিআরপি)। অনুসন্ধানী প্রতিবেদনটির নাম দেওয়া হয়েছে ‘দুবাই আনলকড’।
এক সময়ের বিরান মরুভূমি থেকে বর্তমানে আধুনিক বিলাসবহুল শহরে রূপ নেয়া দুবাইয়ে বিশ্বের বিভিন্ন দেশের হাজার হাজার মানুষ বিপুল পরিমাণ গোপন সম্পদের পাহাড় গড়ে তোলার সুযোগ পেয়েছে। অর্থের উৎস সম্পর্কিত কোনো প্রশ্নের মুখোমুখি হওয়া ছাড়াই ব্যাংকের মাধ্যমে কিংবা ব্যক্তিগত বিমান ভরে অর্থ নেয়ার সুযোগ রয়েছে আমিরাতে। আর এই সুযোগে বিভিন্ন দেশের ব্যবসায়ী, রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব থেকে শুরু করে নিষেধাজ্ঞার মুখে পড়া ব্যক্তি, অর্থপাচারকারী ও অপরাধীরা দুবাইয়ে গড়ে তুলেছেন নিজেদের সম্পদের পাহাড়।
গত মঙ্গলবার (১৪ মে) ‘দুবাই আনলকড’ নামে বৈশ্বিক অনুসন্ধানী সাংবাদিকতার এক প্রকল্পে দুবাইয়ে গড়ে ওঠা এই গোপন সম্পদের তথ্য ফাঁস হয়েছে। অনুসন্ধানী এই প্রকল্পে ৫৮টি দেশের ৭৪টি সংবাদমাধ্যমের প্রতিনিধিরা দীর্ঘ ছয় মাস ধরে অনুসন্ধান চালিয়েছেন। এসব সংবাদমাধ্যমের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে- আল জাজিরা, ডন, ফোর্বস, স্ট্রেইটস টাইমস, আফ্রিকা আনসেনসরড, সিডনি মর্নিং হেরাল্ড, দ্য নিক্কেই, অস্ত্রো ও বেলারুশিয়ান ইনভেস্টিগেটিভ সেন্টার।
প্রকল্পের প্রতিবেদন মতে, শিথিল নীতিমালার কারণে দুবাইয়ের আবাসন খাত অপরাধী, পলাতক আসামি, রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব ও বিভিন্ন দেশের অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞায় থাকা ব্যক্তিদের আকর্ষণ করতে সফল হয়েছে। বস্তুত, অবৈধ অর্থ লুকিয়ে রাখার জন্য অত্যন্ত আকর্ষণীয় গন্তব্যে পরিণত হয়েছে দুবাই।
এই প্রতিবেদনে প্রকাশ পেয়েছে, কারা মধ্যপ্রাচ্যের আর্থিক লেনদেন নিয়ন্ত্রণ করেন এবং কীভাবে সারা বিশ্বে অপরাধীর তকমা পাওয়া হাজারো মানুষকে নানা সুবিধা দিয়েছে দুবাই।
এর আগেও দুবাইকে ঘিরে অনুসন্ধানী প্রতিবেদন তৈরি করা হয়েছে। কিন্তু সেসব প্রতিবেদনে কোনো একটি নির্দিষ্ট অঞ্চল বা দেশের ওপর নজর দেওয়া হয়েছে। এবারই প্রথমবারের মতো 'দুবাই আনলকড' প্রকল্পে বিশ্বের প্রতিটি দেশে নজর দেওয়া হয়েছে।
তথ্য সংগ্রহের উৎস
দুবাইয়ের ভূমি অধিদপ্তরসহ কয়েকটি সরকারি প্রতিষ্ঠানের ফাঁস হওয়া তথ্য-উপাত্তের ভিত্তিতে এ অনুসন্ধান চালানো হয়। এতে ২০২০ থেকে ২০২২ সালের মধ্যে দুবাইয়ে এসব ব্যক্তির মালিকানায় থাকা ও ব্যবহার করা সম্পদের বিস্তারিত চিত্র উঠে এসেছে।
ফাঁস হওয়া তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহ করেছে ওয়াশিংটনভিত্তিক অলাভজনক প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর অ্যাডভান্সড ডিফেন্স স্টাডিজ (সিফোরএডিএস)। প্রতিষ্ঠানটি আন্তর্জাতিক অপরাধ ও সংঘাত নিয়ে গবেষণা করে। পরে এসব তথ্য-উপাত্ত ই-টোয়েন্টিফোর এবং ওসিসিআরপির হাতে আসে।
এই অনুসন্ধানী সাংবাদিকতা প্রকল্পের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে সংবাদমাধ্যম ফোর্বস।
কয়েক মাস ধরে দুবাইয়ের হাজারো ভূমি নিবন্ধন নথি খুঁটিয়ে দেখেন পত্রিকাটির সাংবাদিকরা। বিশ্বের কোন কোন ধনী ব্যক্তি দুবাইয়ে সম্পদের মালিক এবং সেখানে তাদের কী পরিমাণ সম্পদ রয়েছে, সেসব জানার চেষ্টা করেছেন তারা।
যেসব তথ্য পাওয়া গেছে
প্রতিটি সম্পত্তির মূল মালিকের নাম, তাদের জন্ম তারিখ, পাসপোর্ট নম্বর ও জাতীয়তার তথ্য রয়েছে এতে। কিছু কিছু ক্ষেত্রে মালিকের বদলে যারা এসব সম্পত্তি ভাড়া নিয়েছেন, তাদের বিস্তারিত পরিচয় পাওয়া গেছে।
প্রতিবেদন মতে, ২০২২ সালে দুবাইয়ের আবাসন খাতে বিদেশিদের অবদান ১৬ হাজার কোটি ডলার।
ওসিসিআরপির প্রতিবেদনে ২০০ ব্যক্তির দিকে আলাদা নজর দেওয়া হয়েছে। তাদের মধ্যে আছেন অভিযুক্ত অপরাধী, পলাতক আসামি, রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব ও নিষেধাজ্ঞার আওতায় থাকা মানুষ। তারা সম্মিলিতভাবে দুবাইয়ে এক হাজারেরও বেশি সম্পত্তির মালিক।
উল্লেখ্য, দুবাইয়ে গোপন সম্পদের বিষয়ে ফাঁস হওয়া তথ্যে কয়েকশ’ বাংলাদেশিরও পরিসংখ্যান পাওয়া গেছে। ওসিসিআরপির তথ্য বলছে, আকাশচুম্বী অট্টালিকার এই শহরে গোপনে সম্পদ গড়েছেন অন্তত ৩৯৪ জন বাংলাদেশি। শহরটিতে এই বাংলাদেশিদের মালিকানায় রয়েছে ৬৪১টি সম্পত্তি। বাংলাদেশিদের মালিকানায় থাকা এসব সম্পত্তির মূল্য ২২ কোটি ৫৩ লাখ ডলারেরও বেশি।
তবে বাংলাদেশিদের সম্পদ ও মালিকানার তথ্য জানানো হলেও তাদের বিষয়ে বিস্তারিত কোনও তথ্য প্রকাশ করেনি ওসিসিআরপি।
ওসিসিআরপি প্রতিবেদনে আরও বলা হয়েছে, দুবাইয়ে সামগ্রিকভাবে সম্পদের মূল্যের দিক থেকে সবার ওপরে আছেন ভারতীয়রা। ২০২২ সালে দুবাই শহরে ভারতীয়দের সম্পদের মূল্য ছিল ২১ দশমিক ৩ বিলিয়ন বা ২ হাজার ১৩০ কোটি ডলার। ২০২২ ও ২০২০ উভয় বছরেই দ্বিতীয় স্থানে ছিলেন যুক্তরাজ্যের নাগরিকেরা; তাঁদের সম্পদের মূল্য ছিল যথাক্রমে ১২ দশমিক ৭ বিলিয়ন বা ১ হাজার ২৭০ কোটি ডলার ও ১০ দশমিক ১ বিলিয়ন বা ১ হাজার ১০ কোটি ডলার। ২০২২ সালে তৃতীয় স্থানে ছিল সৌদি আরব; ২০২০ সালে ছিল পাকিস্তান। এ ছাড়া ২০২২ সালে যেসব দেশের মানুষেরা শীর্ষ ১০–এ ছিলেন, সেগুলো হলো চীন, মিসর, জর্ডান, রাশিয়া, কানাডা, ইরান প্রভৃতি।
অবাক করা বিষয় হলো, তৈরি হয়নি এমন সম্পদ কেনার দিক থেকে ২০২২ সালে সবার ওপরে ছিলেন যুদ্ধবিধ্বস্ত ইয়েমেনের নাগরিকেরা। ২০২০ সালে শীর্ষে ছিলেন আরেক যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশ সিরিয়ার নাগরিকেরা। ২০২২ সালের তালিকায় শীর্ষ ১০-এ ফিলিস্তিন, সুদান ও আফগানিস্তানের মতো দেশের নাগরিকেরাও আছেন।
এদিকে, ফাঁস হওয়া নথি অনুযায়ী দুবাইয়ে ১৭ হাজার পাকিস্তানি সম্পদের মালিক। তবে তথ্য-উপাত্ত ও অতিরিক্ত সূত্র ব্যবহার করে এ সংখ্যা ২২ হাজারের মতো বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞরা।
যেভাবে যাচাই করা হয়েছে তথ্য
সাংবাদিকরা ফাঁস হওয়া তথ্যে উল্লেখিত মানুষদের পরিচয় যাচাই করার জন্য বেশ কয়েক মাস সময় নেন। পাশাপাশি, তারা আসলেই এসব সম্পত্তির মালিক কি না, সেটাও আনুষ্ঠানিক নথি, ওপেন সোর্স গবেষণা ও অন্যান্য ফাঁস হওয়া তথ্যের মাধ্যমে যাচাই করা হয়।
শুধু যাদের পরিচয় ও মালিকানা স্বাধীনভাবে যাচাই করা সম্ভব হয়েছে, তাদের তথ্যই প্রতিবেদনে তুলে ধরা হয়েছে।