Logo
×

Follow Us

মিডিয়া

ভারতে সেন্সরশিপ ও কর্তৃত্ববাদের ভীতি

Icon

শাহেরীন আরাফাত

প্রকাশ: ২৫ এপ্রিল ২০২০, ০৮:৫৯

ভারতে সেন্সরশিপ ও কর্তৃত্ববাদের ভীতি

ভারতীয় জনগণকে এখন দুই দিকে লড়তে হচ্ছে- একদিকে বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে পড়া মহামারি কভিড-১৯; অন্যদিকে অপরিকল্পিত লকডাউনের খেসারত দেয়া জনগণ। লাখো শ্রমিক ও গৃহহীন মানুষ অভুক্ত। 

ঐতিহাসিকভাবে আমরা দেখেছি- মহামারি, যুদ্ধ, দুর্ভিক্ষের মতো দুর্যোগ জনগণের গণতান্ত্রিক অধিকার ও স্বাধীনতা জিম্মি রাখার বিনিময়ে রাষ্ট্রের ক্ষমতা বৃদ্ধি করে। আর যখন কোনো দেশে গণতন্ত্রের মান হ্রাস করা হয়, তখন অবধারিতভাবে সবচেয়ে ভয়ংকর আঘাতটা আসে মত প্রকাশের স্বাধীনতার ওপর।

১৮৯৬ সালে তৎকালীন ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদের অধীন বোম্বে প্রেসিডেন্সিতে বিউবোনিক প্লেগ আক্রান্ত রোগী প্রথম শনাক্ত হয়। রোগটি দ্রুত মহামারি আকারে ছড়িয়ে পড়ে- মহামারি আটকাতে তেমন কোনো কার্যকর ভূমিকা রাখেনি ঔপনিবেশিক ব্রিটিশ সরকার। এ নিয়ে প্রশ্ন তোলায় ১৮৯৭ সালে ভারতীয় উপমহাদেশে প্রথম রাষ্ট্রদ্রোহিতার দায়ে অভিযুক্ত হন ব্রিটিশ-বিরোধী সংগ্রামী বাল গঙ্গাধর তিলক। অভিযোগ আনা হয়, ঔপনিবেশিক সরকার যেভাবে প্লেগ মহামারি নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করছে, সেই পদ্ধতি নিয়ে তার পরিচালিত দুটি সংবাদপত্র কেশরী ও মারহাট্টায় সমালোচনা তুলে ধরা হয়। বাল গঙ্গাধর তিলককে ১৮ মাসের সশ্রম কারাদণ্ড দেয়া হয়। 

এভাবেই তৎকালীন সরকারের হাতে আসে রাষ্ট্রদ্রোহের মতো একটি আইন, যা ঔপনিবেশিক ব্রিটিশ সরকার তার সমালোচনার মুখ বন্ধ করে দিতে মহামারি-পরবর্তী সময়ে ব্যাপকহারে ব্যবহার করে। এই আইন আজও ভারতে একই ধাঁচে সমালোচনাকারীদের মুখ বন্ধ করতে, মিডিয়াকে নিয়ন্ত্রণ করতে ব্যবহার করা হচ্ছে।

ইতোমধ্যে ভারতের তিনটি রাজ্য সংবাদমাধ্যমগুলোকে জানিয়েছে, ওইসব রাজ্যের মহামারি সংক্রান্ত কোনো তথ্য প্রচারের আগে অবশ্যই কর্তৃপক্ষের অনুমতি নিতে হবে। কেন্দ্রে ক্ষমতাসীন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির সরকার এই সেন্সরশিপকে আরো বাড়িয়ে পুরো ভারতে পৌঁছে দিতে চায়। কেন্দ্র সরকার এজন্য ব্যবহার করতে চাইছে সর্বোচ্চ আদালতকে। সুপ্রিম কোর্টে পিটিশন করে নির্দেশনা জারি করতে চেয়েছিল তারা। 

ওই পিটিশনে বলা হয়, রাষ্ট্রের মহামারি মোকাবেলার সমালোচনা করা কোনো খবর বা মতামত মিডিয়ায় প্রচার করা যাবে না। এমন অগণতান্ত্রিক নির্দেশনা যে মত প্রকাশের স্বাধীনতাকে গলা চেপে ধরবে তা বলাই বাহুল্য। সুপ্রিম কোর্ট ওই পিটিশন গ্রহণ না করে বলেছেন, এমন নির্দেশনা দিলে তা মহামারি নিয়ে মুক্ত আলোচনায় ব্যাঘাত ঘটাবে। 

তবে সুপ্রিম কোর্ট নির্দেশনা দিয়েছেন, মিডিয়াগুলো যেন মহামারি সম্পর্কিত সরকারি ভাষ্যই প্রচার করে। এবারই প্রথম ভারতের বিচার বিভাগ থেকে এমন বিতর্কিত নির্দেশনা প্রদান করা হলো। তবে সরকারি পিটিশন না গ্রহণ করায় মত প্রকাশের স্বাধীনতা অন্তত এ যাত্রায় বেঁচে গেল!

বাল গঙ্গাধর তিলককে যে বছর কারাদণ্ড দেয়া হয়, সে বছরই মহামারি আইন-১৮৯৭ জারি করা হয়। এর মধ্য দিয়ে সরকার জনগণের চলাফেরা নিয়ন্ত্রণ করা থেকে শুরু করে সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতা নিয়ন্ত্রণেরও অধিকার পায়। এ আইন পুরনো হয়ে পড়ায় আসে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা আইন-২০০৫, যা এমন দুর্যোগপূর্ণ অবস্থান কার্যকর হয়। আর সেখানেও জনগণ ও মিডিয়া নিয়ন্ত্রণের ধারা যুক্ত করা হয়।

দুই.

মিডিয়ার ওপর নিয়ন্ত্রণের খড়গ এখানেই শেষ নয়। ‘হেলথ ইমার্জেন্সি’ ঘোষণা করার মধ্য দিয়ে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম নজরদারির দায়ভার এসে পড়ে রাজ্য পুলিশের ঘাড়ে। অনেক ক্ষেত্রে দেখা গেছে, পুলিশের পক্ষ থেকে সতর্কবাণীও দেয়া হয়েছে- ‘আমরা কিন্তু সব দেখছি’। কার্যত এগুলো সুস্পষ্ট হুমকি। বলা হচ্ছে, এসব উদ্যোগ নেয়া হয়েছে গুজব ও মিথ্যা তথ্য নিয়ন্ত্রণের জন্য; অথচ ব্যক্তিগত ও রাজনৈতিক স্বার্থে এর ভুল ও ভ্রান্তিকর প্রয়োগই বেশি চোখে পড়ে। 

উদাহরণ হিসেবে বলা যায়- উত্তর প্রদেশের সাংবাদিক বিনয় বিনীতের কথা, যিনি সেখানকার একটি গ্রামের মুসাহার দলিতদের দুঃখগাথা তুলে ধরেছিলেন। বিনয় লিখেছেন, অপরিকল্পিত লকডাউন ঘোষণার ফলে ওই দলিত গোষ্ঠীর লোকজন অভুক্ত থেকে দিন কাটাচ্ছেন, ঘাস খেয়ে বাঁচার চেষ্টা করছেন। ওই প্রতিবেদন প্রকাশের পর জেলা প্রশাসন বিনয়ের নামে একটি নোটিস জারি করে, যেখানে তাকে আতঙ্ক তৈরির জন্য অভিযুক্ত করা হয়।

এর কয়েকদিন পর প্রতিষ্ঠান-বিরোধী সংবাদমাধ্যম দ্য ওয়াইরের সম্পাদক সিদ্ধার্থ ভরদরাজনের বিরুদ্ধে উত্তর প্রদেশের মুখ্যমন্ত্রী যোগী আদিত্যনাথের সমালোচনা করায় মামলা করা হয়। দু’শতাধিক বিশিষ্ট সাংবাদিক, এডিটরস গিল্ড ও বিভিন্ন রাজনৈতিক দল এ রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত মামলার বিরোধিতা করে বক্তব্য দিয়েছে। সিদ্ধার্থের বিরুদ্ধে দিল্লি থেকে প্রায় ৭০০ কিলোমিটার দূরবর্তী এক আদালত সমন জারি করেছেন; অথচ ভারতে লকডাউন চলছে!

করোনাকালে মত প্রকাশের স্বাধীনতায় হস্তক্ষেপের উদাহরণ এখানেই শেষ নয়। সম্প্রতি সরকারি কর্মকাণ্ড নিয়ে প্রশ্ন তোলায় কাশ্মীরি নারী সাংবাদিক মোশরাত জোহরার বিরুদ্ধে ‘বেআইনি কার্যকলাপ নিরোধক আইনে’ (ইউএপিএ) মামলা করা হয়েছে। গত ফেব্রুয়ারিতে দিল্লিতে সাম্প্রদায়িক সংঘর্ষ চলার সময় ‘উস্কানিমূলক মন্তব্য’ দেয়ার অভিযোগ তুলে জওহরলাল নেহরু ইউনিভার্সিটির (জেএনইউ) সাবেক ছাত্রনেতা উমর খালিদের বিরুদ্ধেও ইউএপিএ আইনে করা হয়েছে মামলা। দিল্লির ওই সাম্প্রদায়িক সংঘর্ষে অর্ধশতাধিক মানুষ প্রাণ হারিয়েছিলেন। এর আগে জামিয়া মিলিয়া ইসলামিয়ার দুই শিক্ষার্থী- মিরন হায়দার ও সাফুরা জারগারের নামেও একই আইনে মামলা করা হয়। তারা দু’জনই এখন বিচারবিভাগীয় হেফাজতে রয়েছেন।

তিন.

মত প্রকাশের স্বাধীনতায় হস্তক্ষেপের সাথে আরেকটা বিষয়ও লক্ষণীয়- ভারতে ক্রমবর্ধমান মুসলিম-বিদ্বেষ বা ইসলামোফোবিয়া। কভিড-১৯ মহামারিকেও দাঙ্গাবাজরা মুসলিম বিদ্বেষ প্রকাশের মাধ্যম করে তুলেছে। মহামারির সময়ে আন্তর্জাতিক সম্মেলন করার মতো অবিবেচক সিদ্ধান্তের কারণে নিশ্চিতভাবেই করোনাভাইরাস ছড়ানোর সুযোগ পেয়েছে। এজন্য তাবলিগ জামাতের সমালোচনা হওয়া উচিত, অনেকে করেছেনও। 

তবে বিদ্বেষীদের প্রচারণায় তাবলিগ জামাত নয়, তাদের পরিচয় শুধুই মুসলিম। তাদের প্রচারণায় দেখা যায়- তাবলিগ জামাতই যেন বিশ্বব্যাপী মহামারি ছড়ানোর জন্য দায়ী। এটিকে ‘করোনা জিহাদ’ বলে বিভ্রান্তিকর প্রচারণা চালায় বিদ্বেষীরা। গত কয়েক সপ্তাহ ধরে ভাইরাস ছড়িয়ে পড়ার জন্য হোয়াটসঅ্যাপ, টুইটার, ফেসবুকে বিজেপি ও হিন্দুত্ববাদীরা টানা মুসলিমদের দায়ী করে প্রচারণা চালাচ্ছে তারা। 

এনডিটিভির সাংবাদিক রাভীশ কুমার বা বিশিষ্ট লেখক রাণা আইয়ূব, সাবা নকভীদের হত্যার হুমকি দেয়ার মতো ঘটনা এখন খুবই সাধারণ বিষয়ে পরিণত হয়েছে। মত প্রকাশ করলে মামলার ভয় থাকলেও, বিদ্বেষ প্রচারের প্রশ্নে প্রশাসন নীরব।

মুসলিম বিদ্বেষ প্রসঙ্গে সম্প্রতি জার্মান সংবাদমাধ্যম ডয়চে ভেলেকে দেয়া এক সাক্ষাৎকারে অরুন্ধতী রায় বলেন, ‘নরেন্দ্র মোদি রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সংস্থার (আরএসএস) সদস্য, এটি বিজেপির মূল সংগঠন। তারা দীর্ঘদিন ধরে বলে আসছে ভারতের ‘হিন্দু রাষ্ট্র’ হওয়া উচিত। মুসলিমদের প্রতি তাদের চিন্তাভাবনা ইহুদিদের প্রতি নাৎসিদের চিন্তার সঙ্গে মিলে যায়। তারা কভিড-১৯’কে মুসলিমদের বিরুদ্ধে ব্যবহার করছে, এটিও ইহুদিদের বিরুদ্ধে টাইফাস রোগকে ব্যবহারের সাথে মিলে যায়।’

চার.

ভারতের সব হাসপাতাল থেকে ডাক্তারদের সাবধান করে দেয়া হয়েছে, কেউ যেন সাংবাদিকদের কাছে দেশের ধুঁকতে থাকা স্বাস্থ্যসেবা নিয়ে মুখ না খোলেন। কলকাতার ক্যান্সার বিশেষজ্ঞ ডা. ইন্দ্রনীল খান সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে লিখেছিলেন, ডাক্তারদের পিপিইর বদলে দেয়া হয়েছে রেইনকোট। 

তিনি জানান, ওই পোস্ট দেয়ার জন্য কলকাতা পুলিশ তাকে প্রায় ১৬ ঘণ্টা জেরা করে। পরে পোস্টটি ডিলিট করে ছাড়া পান। পশ্চিমবঙ্গে অন্তত আরো ১০ জন ডাক্তার জানিয়েছেন, সরকারের সমালোচনা করায় পুলিশ তাদের হুমকি দিয়েছে, তাদের বদলি অথবা বরখাস্ত করা হয়েছে। পশ্চিমবঙ্গেই এমন অবস্থা! উত্তর প্রদেশ, বিহার, ঝাড়খণ্ডের মতো রাজ্যগুলোতে স্বাস্থ্য খাতের অব্যবস্থাপনা রীতিমতো অকল্পনীয়। তবে এ নিয়ে মুখ খোলায় মানা!

সম্প্রতি ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি সংবাদপত্র মালিকদের সাথে বৈঠক করেছেন। সেখানে তিনি পত্রিকা মালিকদের মহামারি সম্পর্কিত ‘নেতিবাচক’ খবর প্রকাশ না করার আহ্বান জানান। কার্যত এর মধ্য দিয়ে সংবাদপত্রে এক ধরনের ‘সেলফ সেন্সরশিপ’ কার্যকর করার চেষ্টাই তিনি করেছেন। 

উল্লেখ্য, ভারতীয় মিডিয়ার একটা বড় অংশই এখন ক্ষমতাসীন সরকারের পক্ষের প্রচারযন্ত্রে পরিণত হয়েছে। এমন পক্ষপাতদুষ্ট সাংবাদিকতার ভিড়েও বেশ কয়েকটি মিডিয়া মাথা তুলে দাঁড়িয়ে আছে। ক্ষমতাসীনরা এখন কোনো সমালোচনাই সহ্য করতে রাজি নয়। সংখ্যাগরিষ্ঠতাবাদ কাজে লাগিয়ে তারা আগেই কাশ্মীর রাজ্য বিলুপ্ত করেছে। সাম্প্রদায়িক নাগরিকত্ব আইন ও নাগরিক নিবন্ধনের মতো বিতর্কিত কাজ করেছে। সর্বোচ্চ আদালত বিতর্কিত হয়েছে বাবরি মসজিদ ভাঙার পক্ষে অবস্থান নিয়ে। এখন মহামারির সময়ে মোদি সরকার তার কর্তৃত্ববাদ আরো একদফা যে বাড়াবে সেটি নিশ্চিত। 

তবে মহামারি-পরবর্তী সময়ে ভেঙে পড়া অর্থনীতির কারণে জনরোষের মুখে পড়তে পারে সরকার। এজন্যই আগেভাগে মিডিয়াকে আরো নিয়ন্ত্রণের মধ্যে রাখতে চাইছে তারা।

তবে আমরা জানি- গিঁট বেশি শক্ত করতে গেলে, তা ছিঁড়ে যাওয়ার সম্ভাবনাও থাকে। এ সেন্সরশিপ ও কর্তৃত্ববাদ শেষ পর্যন্ত ক্ষমতাসীনদের পতনের দিকেও নিয়ে যেতে পারে। সেটি মহামারি-পরবর্তী সময়ই বলে দেবে। তবে মহামারির এ ক্রান্তিকাল যে ভারতীয় জনগণের জন্য শাঁখের করাতের চেয়ে কম নয়, তা হলফ করেই বলে দেয়া যায়।

Logo

সম্পাদক ও প্রকাশক: ইলিয়াস উদ্দিন পলাশ

বার্তা ও বাণিজ্যিক কার্যালয়: ফেয়ার দিয়া ১১/৮/ই, ফ্রি স্কুল স্ট্রিট (লেভেল-৮), বক্স কালভার্ট রোড, পান্থপথ, ঢাকা ১২০৫