জাল সনদ দেখিয়ে স্কুলে চাকরি, সাংবাদিকের ২ বছরের কারাদণ্ড

চুয়াডাঙ্গা প্রতিনিধি
প্রকাশ: ১১ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ১৯:৪৯

আসামি খাইরুল ইসলাম (বামে)। ছবি: চুয়াডাঙ্গা প্রতিনিধি
চুয়াডাঙ্গার বাংলাদেশ বর্ডার গার্ড ব্যাটালিয়নের সীমান্ত মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে জাল সনদপত্র দাখিল করে চাকরী করার অপরাধে খাইরুল ইসলাম নামের এক ব্যক্তিকে ২ বছরের সশ্রম কারাদণ্ড ও ৫ হাজার টাকা অর্থদণ্ড দিয়েছেন চুয়াডাঙ্গা চীফ জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালত। আসামি খাইরুল ইসলাম বর্তমানে দৈনিক সমকাল পত্রিকার জেলা প্রতিনিধি ও চেম্বার এ্যান্ড কমার্সের অফিস সচিব হিসেবে কর্মরত রয়েছেন।
আজ বুধবার (১১ সেপ্টেম্বর) আসামির উপস্থিতিতে এ রায় ঘোষণা করেন চুয়াডাঙ্গা চীফ জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালতের বিচারক মো. লুৎফর রহমান শিশির। মামলাটির বাদী পক্ষে ছিলেন এ্যাডভোকেট আব্দুস সামাদ ও আসামি পক্ষে ছিলেন এ্যাডভোকেট এস এম শাহজাহান মুকুল।
মামলার বিবরণ ও আদালত সূত্রে জানা যায়, চুয়াডাঙ্গা সীমান্ত মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে কম্পিউটার বিষয়ে সহকারী শিক্ষক হিসেবে খাইরুল ইসলাম ২০০২ সালের ১ আগস্ট যোগদান করেন। ২০১৭ সালের ১১ এপ্রিল বিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের অনুসন্ধানে প্রমাণিত হয় তার দাখিল করা সনদপত্র জাল। এ ব্যাপারে তাকে জিজ্ঞাসাবাদের এক পর্যায়ে তিনি কর্তৃপক্ষের কাছে জাল সনদপত্র দাখিলের বিষয়টি স্বীকার করেন। এ ঘটনায় বিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ তাকে পুলিশে সোপর্দ করতে পারে এ সংশয়ে সে বিদ্যালয়ের তৎকালীন সভাপতি ও বিজিবি পরিচালক বরাবর ২০১৭ সালের ১১ এপ্রিল আবেদন করে স্বেচ্ছায় চাকরী হতে পদত্যাগ করেন।
এরপর হঠাৎ করে খাইরুল ইসলাম তার চাকরি ফিরিয়ে দেয়ার শর্তে ৩ লাখ টাকা চাঁদা নেয়ার অভিযোগে ওই বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষিকা মেহজাবিন চন্দনার (৪৬) বিরুদ্ধে চুয়াডাঙ্গা চীফ জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে মামলা করেন। এ মামলাটি তদন্ত করেন সেই সময়কার সদর পুলিশ ফাঁড়ির উপপুলিশ পরিদর্শক ওহিদুল ইসলাম।
তিনি মামলাটি তদন্ত করে আদালতে ২০১৭ সালের ১১ জুলাই চুড়ান্ত তদন্ত প্রতিবেদন দাখিল করেন। ওই তদন্ত প্রতিবেদনে তিনি মামলার বাদী খাইরুল ইসলামের দাখিল করা মামলা সাজানো, সম্পূর্ন মিথ্যা ও ভিত্তিহীন বলে উল্লেখ করেন এবং মিথ্যা মামলা করায় তার বিরুদ্ধে দণ্ডবিধি ২১১ ধারায় আইনগত ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য আদালতে আবেদন করেন। সেই সঙ্গে চাঁদা দাবি ও গ্রহণ করার স্বপক্ষে কোন সাক্ষী বা প্রমাণ না পাওয়ায় বিবাদী চুয়াডাঙ্গার গুলশানপাড়ার গোলাম ফারুকের স্ত্রী ও মরহুম মহিউদ্দিনের মেয়ে সীমান্ত মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষিকা মেহজাবিন চন্দনাকে মামলার দায় হতে অব্যাহতি প্রদানের আবেদন জানান।
এরপর ২০১৮ সালের ১৮ এপ্রিল আদালতের বিজ্ঞ বিচারক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষিকা মেহজাবিন চন্দনাকে বেকসুর খালাসের আদেশ দেন।
তারপর বিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ সভাপতির পক্ষে প্রধান শিক্ষিকা মেহজাবিন চন্দনা বাদী হয়ে ২০১৮ সালের ৬ জুন চুয়াডাঙ্গা চীফ জুডিশিয়াল আদালতে বিবাদী চুয়াডাঙ্গা সদর উপজেলার কুলচারা গ্রামের মরহুম ফয়জুর রহমানের ছেলে পদত্যাগকারী সহকারী শিক্ষক খাইরুল ইসলামের বিরুদ্ধে সিআর-৭০৫/১৭ (বর্তমানে টিআর-২৫৮/১৮) মামলা করেন।
এই মামলার স্বপক্ষে বিদ্যালয়ে চাকরি গ্রহণের সময় খাইরুল ইসলামের দাখিল করা বগুড়ার ফুলতলায় অবস্থিত জাতীয় বহুভাষী সাঁটলিপি প্রশিক্ষণ ও গবেষণা একাডেমির (নট্রামস) দাখিল করা জাল সনদ এবং ২০০২ সালের ১ আগস্ট থেকে ২০১৭ সালের ১১ এপ্রিল পর্যন্ত জাল সনদ দাখিল করে বেতন হিসেবে প্রতারণার মাধ্যমে ১৭ লাখ ৬৮ হাজার ৫৪ টাকা ৯৯ পয়সা গ্রহণ করায় তার বিরুদ্ধে করা ২০১৭ সালের ১৮ জুনে করা লিগ্যাল নোটিশের কপি প্রাপ্তি স্বীকার রশিদসহ সংযুক্ত করা হয়।
এছাড়া ২০১৭ সালের ৬ মার্চ খাইরুলের চাকরির সময় জমা দেয়া সনদপত্রটি যাচাইয়ের জন্য বগুড়া ফুলতলায় অবস্থিত জাতীয় বহুভাষী সাঁটলিপি প্রশিক্ষণ ও গবেষনা একাডেমীর (নট্রামস) পরিচালক বরাবর পাঠানো হয়। সেখান থেকে ২০১৭ সালের ১৭ মার্চ একাডেমীর পরিচালক (উপ-সচিব) এস.এম. ফেরদৌস আলম স্বাক্ষরিত এক পত্রে জানানো হয় ‘খাইরুল ইসলাম, পিতা: ফয়জুর রহমান, সনদ নং-১৯২৮৩ রেজিস্ট্রেশন-১৭৮৬১, রেজিস্টার যাচাইয়ে দেখা যায় যে, সনদপত্রটি সাবেক নট্রামস কর্তৃক ইস্যুকৃত নয়,সনদপত্রটি জাল/ভুয়া। সেই তথ্যগুলো মামলার নথিতেও সংযুক্ত করা হয়।
মামলাটি তদন্ত করেন তৎকালীন অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (সদর সার্কেল) তরিকুল ইসলাম।
ওই তদন্ত করার জন্য তিনি খাইরুলকে তার সনদপত্রের মূল কপি দেখাতে বললে তিনি জানান, ‘দাখিল করা সনদপত্রটির কপি তার নয়। তাকে ফাঁসানোর জন্য ওই কপি আদালতে জমা দেয়া হয়েছে’। এরপর তাকে তার সঠিক সনদপত্রের ফটোকপি জমা দিতে বললে খাইরুল আবার তার সনদপত্র জমা দেন। যার সিরিয়াল নম্বর-১৩৫৯০ ও রেজিস্ট্রেশন নম্বর-১৩৫৮৭। এই সনদপত্রটি যাচাইয়ের জন্য আবারো জাতীয় বহুভাষী সাঁটলিপি প্রশিক্ষণ ও গবেষনা একাডেমীতে (নট্রামস) পাঠানো হলে সেটাও জাল/ভুয়া প্রমাণিত হয়।
এই মামলাটির অনুসন্ধানপূর্বক তদন্ত করে জানা যায়, অভিযুক্ত খাইরুল ইসলাম ভুয়া কম্পিউটার সনদপত্র দাখিল করে সীমান্ত মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে কম্পিউটার শিক্ষক হিসেবে নিয়োগ পান এবং তার দেয়া জবানবন্দিটি মিথ্যা বলে প্রতীয়মান হয় এবং বাদী মেহজাবিন চন্দনা কর্তৃক অভিযোগের আবেদনটির সত্যতা পাওয়া যায়।
প্রতিবেদনটি ২০১৮ সালের ২৬ আগস্ট অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (সদর সার্কেল) তরিকুল ইসলাম আদালতে দাখিল করেন।
এ মামলাটি কোয়াশমেন্ট চেয়ে খাইরুল ইসলাম উচ্চ আদালতে মামলা করেন। যার নম্বর-১৩৩৫৫৯৮/২০২৩। টেন্ডার নম্বর-৪০৬৮৭। মামলাটি ২০২৩ সালের ৭ জুন, ওই মাসের ১৪ জুন, ২১ জুন উচ্চ আদালতের এনেক্স বিল্ডিংয়ের ১৬ নম্বর আদালতে বিচারপতি রেজাউল হক ও বিচারপতি কে এম এমরুল কায়েশ এবং ওই বছর ১২ জুলাই ও সর্বশেষ ১৯ জুলাই বিচারপতি রেজাউল হক ও বিচারপতি শশাঙ্ক শেখর সরকারের আদালতে উপস্থাপিত হয়ে কোয়াশমেন্ট চাইলে তা বাতিল হয়। এর ফলে নিম্ন আদালতে মামলাটি চলমান থাকে। যার রায় আজ প্রদান করা হয়।