Logo
×

Follow Us

মিডিয়া

ভারতীয় মিডিয়ায় শেখ হাসিনার পতন

Icon

শাহেরীন আরাফাত

প্রকাশ: ১২ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ১৫:২৯

ভারতীয় মিডিয়ায় শেখ হাসিনার পতন

বাংলাদেশের পরিস্থিতি নিয়ে ভারতীয় গণমাধ্যমে সংবাদ প্রকাশ। ছবি: সংগৃহীত

গত ৫ আগস্ট বাংলাদেশের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ছাত্র-জনতার স্বৈরাচারবিরোধী অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে পদত্যাগ করতে বাধ্য হন এবং ভারতে পালিয়ে যান। বিশ্বের তথাকথিত বৃহত্তম গণতন্ত্রের দেশ ভারতের মিডিয়া এই গণ-অভ্যুত্থান নিয়ে কীভাবে প্রতিবেদন করল? তারা কি বাংলাদেশের গণ-অভ্যুত্থানকে ব্যাখ্যা করতে চেয়েছে, নাকি ভারতের আঞ্চলিক আধিপত্যের স্বার্থ রক্ষার জন্য অপপ্রচারে লিপ্ত ছিল? কার্যত ভারতীয় মিডিয়া দেশটিতে মুসলিমবিদ্বেষ উসকে দিতে বাংলাদেশের গণ-অভ্যুত্থান-পরবর্তী ঘটনাপ্রবাহকে ব্যবহার করেছে। 

শেখ হাসিনার স্বৈরতান্ত্রিক শাসনে সহিংসতা ও লাশের মিছিল যখন দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতর হচ্ছিল, তখনও ভারত তার নিন্দা জানাতে অস্বীকার করেছিল। ৫ আগস্ট তার ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার পর ভারত সরাসরি ক্ষতি পুষিয়ে নিতে কাজ শুরু করে।

এর পরদিন ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী এস জয়শঙ্কর পার্লামেন্টে দেওয়া ভাষণে বলেন, ‘...আমরা বারবার সংযমের পরামর্শ দিয়েছি এবং সংলাপের মাধ্যমে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের আহ্বান জানিয়েছি।’

একইভাবে শেখ হাসিনার পদত্যাগের পর ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি মূলধারার রাজনীতিতে জামায়াতে ইসলামীর প্রত্যাবর্তনের বিরুদ্ধে নয়াদিল্লির উদ্বেগের কথা জানিয়ে ‘একটি গণতান্ত্রিক ও প্রগতিশীল বাংলাদেশের প্রতি ভারতের সমর্থন’ পুনর্ব্যক্ত করেছেন। শেখ হাসিনার শাসনামলের শেষ পর্যায়ে এই ইসলামপন্থি দলটিকে নিষিদ্ধ করা হয়েছিল।

সরকারের ইঙ্গিত বুঝে নিয়ে ভারতীয় মূলধারার মিডিয়াগুলো পররাষ্ট্রনীতি প্রতিষ্ঠার জন্য উঠেপড়ে লাগে; আর এতে ভারতীয় ডানপন্থিদের উদ্বেগের কোনো সীমা-পরিসীমা ছিল না।

মূলধারার মিডিয়া শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পরপরই এটিকে ‘ইসলামপন্থিদের বিজয়’ হিসেবে চিহ্নিত করার চেষ্টা করেছে।

৬ আগস্ট ভারতের সবচেয়ে বেশি বিক্রীত ‘টাইমস অব ইন্ডিয়া’ সংবাদপত্রে শেখ হাসিনার পতনের পেছনে বাংলাদেশের বৃহত্তম ইসলামি দল জামায়াতে ইসলামীকে দায়ী করেছে। বাংলায় অনুবাদ করলে পত্রিকাটির শিরোনাম দাঁড়ায়, ‘‘জামায়াতে ইসলামী কী? ‘পাকিস্তান সমর্থিত’ রাজনৈতিক দল যারা বাংলাদেশে শেখ হাসিনা সরকারের পতন ঘটায়।”

এখানেই শেষ নয়।

ভারতের ইলেকট্রনিক মিডিয়া ষড়যন্ত্র তত্ত্ব আর ইসলামোফোবিক বক্তব্যে ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের তাৎপর্য বাতিল করার চেষ্টায় রত ছিল। সরকারপন্থি ইন্ডিয়া টুডে চ্যানেলের প্রাইম টাইম অনুষ্ঠানে উপস্থাপক রাহুল কানওয়াল পাকিস্তানের গোয়েন্দা সংস্থা আইএসআই কীভাবে বাংলাদেশে সরকার পতনের পেছনে কাজ করেছে তা নিজের মনগড়া কাহিনি দিয়ে বর্ণনা করেন। আনুষ্ঠানে রাহুল প্রশ্ন করেন, শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে অভ্যুত্থান কি মানুষের মধ্য থেকেই গড়ে উঠেছিল, নাকি এর পেছনে বড় কোনো ষড়যন্ত্র ছিল?

এরপর তিনি নিজেই গোয়েন্দা সূত্রের বরাত দিয়ে বলতে শুরু করেন, ‘শীর্ষ গোয়েন্দা সূত্র ইন্ডিয়া টুডেকে জানিয়েছে যে, পাকিস্তান-ভিত্তিক আইএসআই এবং চীন শেখ হাসিনার সরকারকে উৎখাত করার ষড়যন্ত্র করেছিল। সূত্র আরও জানায়, জামায়াতের ছাত্র শাখা বিক্ষোভকারীদের মগজ ধোলাই করে এবং উসকানি দেয়।’

ভারতের রাষ্ট্রীয় সম্প্রচার মাধ্যম ডিডি ইন্ডিয়া লাইভে বাংলাদেশে ভারতের সাবেক হাইকমিশনার বীনা সিক্রি ‘বহিরাগত শক্তির’ ভূমিকার দিকে ইঙ্গিত করেন। তিনি বলেন, ‘ইসলামি শক্তির উত্থান গণতন্ত্র ও ধর্মনিরপেক্ষতার মূল্যবোধকে হুমকির মুখে ফেলছে।’

কয়েক দিন পর দ্য ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস সংবাদপত্র ‘ইসলামিক মৌলবাদের’ উত্থানের সঙ্গে কথিত ধর্মনিরপেক্ষ শেখ হাসিনার পতনের যোগসূত্র খোঁজার চেষ্টা করে।

ঠিক আগের মতো না হলেও কয়েক সপ্তাহ পরও টাইমস অব ইন্ডিয়া প্রশ্ন তোলে, ‘শেখ হাসিনার পর বাংলাদেশ : এটি কি পরবর্তী আফগানিস্তান বা পাকিস্তান হবে?’

অনেক ভারতীয় পর্যবেক্ষক এই ঘটনাগুলোকে ভারতের জন্য নিরাপত্তা হুমকি ছাড়া আর কিছুই দেখছেন না। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক ভারতীয় সাংবাদিক সীমা সিরোহি ইকোনমিক টাইমস পত্রিকায় লিখেছেন, ‘ভারতের জন্য বাংলাদেশে পটপরিপর্তন গণতন্ত্রের অন্বেষণ নয়, নিরাপত্তার জন্য বাস্তব হুমকি। যেখানে কোনো দূরত্ব নেই, রয়েছে বিপজ্জনক নৈকট্য। সীমান্তবর্তী রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রীরা ইতোমধ্যে নিজেদের ভবিষ্যৎ এবং শরণার্থীদের সঙ্গে আর কে কে আসতে পারে, তা নিয়ে দুশ্চিন্তায় আছেন।’ সীমা সিরোহির এ বক্তব্য ভারতীয় পররাষ্ট্রনীতি বিশেষজ্ঞদের দীর্ঘকাল ধরে চর্চিত অবস্থানেরই প্রতিধ্বনি। যারা হাসিনার আওয়ামী লীগকে মিত্র হিসেবে মনে করেন। তাদের কাছে বিএনপি এবং সাধারণ বাংলাদেশিদের অন্য কোনো বিরোধী দল আগামী দিনের জিহাদি ও অনুপ্রবেশকারী।

তিনি আরও বলেন, ‘গণতন্ত্রের প্রবর্তকদের দেখতে হবে, বিএনপি-জামায়াত জোটের অধীনে নির্বাচন হলে কী হয়। এমনকি ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বাধীন অন্তর্বর্তী সরকারেও ইসলামপন্থি রয়েছে।’

শেখ হাসিনা প্রধান বিরোধী দল বিএনপিকে ‘সন্ত্রাসী’ বলে আখ্যা দিয়েছিলেন; দেশের বৃহত্তম বেসরকারি বাণিজ্যিক ব্যাংক, ইসলামী ব্যাংককে দখল করেছিলেন এবং শেষে জামায়াতকে নিষিদ্ধ করেন।

২০১০ সালে তিনি জামায়াতে ইসলামীর প্রতিষ্ঠাতা আবুল আ‘লা মওদুদীর বই নিষিদ্ধ করেন। তার সরকার গ্রন্থাগার থেকে বই অপসারণকে ন্যায্যতা দিয়েছিল। আর এ ক্ষেত্রে যুক্তি দেওয়া হয়, ওই বই ‘জঙ্গিবাদ ও সন্ত্রাসবাদ’-এর প্রচার করে। এটি ইসলামপন্থি এবং ধর্মীয় গোষ্ঠীগুলোর ওপর হাসিনার আক্রমণ, যা ভারত সরকারকে মুসলমানদের টার্গেটে পরিণত করতে উদ্বুদ্ধ করেছিল।

আশ্চর্যের কিছু নেই যে, ভারতীয় মিডিয়া অনন্ত অ্যাস্পেন সেন্টারের ইন্দ্রাণী বাগচীর মতো লোকেদের প্ল্যাটফর্মে পরিণত হয়েছে, যারা পাঠকদের বলেন, ‘শেষবার যখন খালেদা জিয়া ক্ষমতায় ছিলেন, তখন সন্ত্রাসী মাদ্রাসাগুলো ফুলে ফেঁপে উঠেছিল।’

এটাও আশ্চর্যজনক ছিল না যে ভারতীয় মিডিয়া হাসিনার পুত্র সজীব ওয়াজেদ জয়ের ভাষ্য অনুযায়ী ষড়যন্ত্র তত্ত্ব প্রকাশ করবে, যিনি সরকারবিরোধী বিক্ষোভের জন্য একটি বিদেশি গোয়েন্দা সংস্থাকে দায়ী করেন।

যত দিন যাচ্ছে, ডানপন্থি মিডিয়া ও পোর্টালগুলো ৫ আগস্টের গণঅভ্যুত্থানের পর বাংলাদেশে হিন্দু সংখ্যালঘুদের ওপর হামলার বিষয়ে বিভ্রান্তিকর এবং প্রায়শই মিথ্যা প্রতিবেদন প্রচার করছে। একটি ডানপন্থি প্রকাশনা, হিন্দুদের ওপর হামলাকে ‘গণহত্যা’ হিসেবে বর্ণনা করেছে।

সামাজিক মাধ্যমে বাংলাদেশি হিন্দু ক্রিকেটার লিটন দাসের বাড়িতে আগুন দেওয়ার খবর ভাইরাল হয়। অথচ সেটি ছিল ক্রিকেটার থেকে রাজনীতিক হওয়া মাশরাফি বিন মোর্ত্তজার বাড়ি। এসব ভুয়া খবর ছড়িয়ে ভারতজুড়ে মুসলমানদের বিরুদ্ধে প্রতিশোধমূলক হামলাও হয়েছে।

শেখ হাসিনা ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার পর হিন্দুদের ওপর হামলা হয়েছে, তা অস্বীকার করার কিছু নেই। তবে ভারতীয় মিডিয়া এই হামলাগুলোকে চরম অতিরঞ্জিত করেছে।

এ প্রসঙ্গে ক্রাইসিস গ্রুপের বাংলাদেশ ও মিয়ানমারের সিনিয়র কনসালট্যান্ট থমাস কিন বলেছেন, হিন্দুদের শুধু তাদের বিশ্বাসের কারণে নয়, আওয়ামী লীগ দলের সঙ্গে যুক্ত থাকার কারণে তাদের লক্ষ্য করে হামলা করা হয়েছে।

বাংলাদেশ হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিষ্টান ঐক্য পরিষদের মতে, হাসিনার ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার পর যে দুই শতাধিক মানুষ নিহত হয়েছেন, তাদের মধ্যে পাঁচজন হিন্দু বাংলাদেশি ছিলেন।

তবে কয়েকজন ভারতীয় সাংবাদিক ও সম্পাদক বিচক্ষণ ও সমালোচনামূলক প্রতিবেদন করেছেন। দ্য হিন্দু সংবাদপত্রের পররাষ্ট্র বিষয়ক সম্পাদক সুহাসিনী হায়দার যুক্তি দিয়েছিলেন যে, ‘সাম্প্রদায়িক বাইনারির সঙ্গে প্রতিবেশীর সম্পর্ক হ্রাস করা একটি ভুল সিদ্ধান্ত।’ তিনি আরও উল্লেখ করেছেন যে, মোদি সরকারের সংখ্যালঘু বিরোধী নীতিগুলো প্রতিবেশীদের ক্ষেত্রে ব্যাকফায়ার করেছে। সুহাসিনী বলেন, ‘বাংলাদেশে সংখ্যালঘুদের নিরাপত্তার বিষয়ে ভারতের উদ্বেগ আরও গুরুত্ব পাবে তখন, যখন ভারত সরকারও তার ক্রিয়াকলাপের মাধ্যমে দেখায় যে, তারা নিজ সীমান্তের মধ্যে সংখ্যালঘুদের সুরক্ষার ক্ষেত্রে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ।’

আগস্টের শেষের দিকে ও সেপ্টেম্বরে ষড়যন্ত্র তত্ত্ব এবং ভারতের জন্য ইসলামি দলগুলোর উত্থানের অর্থ কী হতে পারে সে বিষয়ে উদ্বেগ প্রকাশ পেতে থাকে।

সংবাদমাধ্যম ফার্স্টপোস্টের একটি শিরোনাম ছিল, ‘বিশৃঙ্খল প্রতিবেশীদের দ্বারা বেষ্টিত ভারত’।

এর মধ্য দিয়ে অধ্যাপক ইরফান আহমেদ ‘হিন্দু ওরিয়েন্টালিজম’ ব্যাখ্যার উদাহরণ খুঁজে পান। ইরফান আহমেদের মতে, ‘হিন্দু ওরিয়েন্টালিজম’-এ মুসলমানদের শুধুমাত্র অশান্ত বা কোলাহলপূর্ণ এবং শান্তির জন্য বিপদ হিসেবে দেখানো হয় এবং তারা কখনোই ন্যায়, ন্যায্যতা এবং সৌন্দর্য অনুসরণ করে সামাজিক রূপান্তরের ধারক হতে পারে না।

ইরফান আহমেদ সামাজিক মাধ্যম এক্সে লিখেছেন, “বাংলাদেশের মুসলমানদের ‘সহিংস’, ‘অসহনশীল’ হিসেবে চিত্রিত করা এবং হিন্দুদের সম্পর্কে দেওয়া ফাঁপা উদ্বেগ মূলত পশ্চিমা ওরিয়েন্টালিজম থেকে ধার করা একটি অংশ, যা ভারতীয় হিন্দু এবং তাদের ক্ষমতাশালী অভিজাতরা সহজেই গ্রহণ করে।’ 

সূত্র : substack.com

Logo

সম্পাদক ও প্রকাশক: ইলিয়াস উদ্দিন পলাশ

বার্তা ও বাণিজ্যিক কার্যালয়: ফেয়ার দিয়া ১১/৮/ই, ফ্রি স্কুল স্ট্রিট (লেভেল-৮), বক্স কালভার্ট রোড, পান্থপথ, ঢাকা ১২০৫