ভারতীয় সংবাদমাধ্যমের উসকানিতে সাম্প্রদায়িক হামলা

বাংলাদেশে পটপরিবর্তনে বিভিন্ন ভারতীয় সংবাদমাধ্যম যে মিথ্যা ও উসকানিমূলক খবর দিচ্ছে, তাতে দেশটির সাম্প্রদায়িক শক্তি আরও বেশি মুসলিম বিদ্বেষের রসদ পাচ্ছে। ইতোমধ্যে একাধিক স্থানে মুসলিমদের ওপর হামলা চালিয়েছে হিন্দুত্ববাদী কয়েকটি সংগঠন।

৯ আগস্ট হিন্দুত্ববাদী সংগঠন হিন্দু রক্ষা দলের (এইচআরডি) কর্মীরা তাদের নেতা ভূপেন্দর তোমর ওরফে পিঙ্কি চৌধুরীর নেতৃত্বে গুলধর রেলওয়ে স্টেশনের কাছে গাজিয়াবাদের কবি নগর এলাকার একটি বস্তিতে আক্রমণ চালায়। তাদের দাবি, এখানকার বাসিন্দারা মুসলিম, অবৈধ বাংলাদেশি ও রোহিঙ্গা এবং তারা অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডে জড়িত। আক্রমণের দুটি ভিডিও সামাজিক মাধ্যমে ভাইরাল হয়েছে। এসব ভিডিও প্রথমে ওই হিন্দুত্ববাদী সংগঠনের ফেসবুক পেজে প্রথম প্রকাশ হয়। ভিডিওতে দেখা যায়, হিন্দুত্ববাদীরা বস্তিবাসীদের তাঁবু ভাঙচুর করছেন, বাসিন্দাদের জিনিসপত্র জ্বালিয়ে দিতে এবং ক্রমাগত ধর্মীয় স্লোগান ও সাম্প্রদায়িক গালি দিচ্ছে। সেই সঙ্গে মুসলিমদের ওপর লাঠি দিয়ে হামলা করতে দেখা যায়। চলতি সপ্তাহে হিন্দুত্ববাদী সংগঠনটির এটি দ্বিতীয় হামলা। এই হামলার আগের দিন এইচআরডির আরেক সহযোগী দক্ষ চৌধুরীর নেতৃত্বে দিল্লির শাস্ত্রী নগরের একটি বস্তিতে আক্রমণ চালানো হয়।

ভাঙচুরকারীরা শুধু বস্তিই জ্বালিয়ে দেয়নি; বরং বস্তিবাসীদের পরিচয় নিশ্চিত করার পর মুসলিমদের পোশাক ও জিনিসপত্রও তুলে নেয়। সামাজিক মাধ্যমে বাংলাদেশে হিন্দুদের ওপর হামলার প্রতিশোধ নেওয়ার আহ্বান জানিয়ে তারা এই হামলা চালায়। সামাজিক মাধ্যমে হামলার আহ্বানকারীদের মধ্যে রয়েছেন বিজেপির বিধায়ক নীতীশ রানে এবং এমপি কঙ্গনা রানাউত।

রানে এক্সে লিখেছেন, ‘যদি বাংলাদেশে হিন্দুদের টার্গেট করে হত্যা করা হয়। কেন আমরা এখানে একজন বাংলাদেশিকেও শ্বাস নিতে দেব? আমরাও টার্গেট করে হত্যা করব।’ প্রসঙ্গত গত ৫ আগস্ট শেখ হাসিনা প্রধানমন্ত্রীর পদ থেকে ইস্তফা দিয়ে ঢাকা থেকে পালিয়ে যাওয়ার পর রাজনৈতিক পটপরিবর্তনে দেশজুড়ে চলছে অস্থিরতা। এরই মধ্যে অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব নিলেও পুলিশের কর্মবিরতিতে অস্থিরতা কাটেনি। প্রশাসনের নিষ্ক্রিয়তার সুযোগে দেশের বিভিন্ন স্থানে বাড়িঘর ও ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে হামলা-ভাঙচুর-অগ্নিসংযোগ, এমনকি লুটপাটের ঘটনাও ঘটেছে। এর বেশিরভাগ রাজনৈতিক প্রতিহিংসামূলক, আবার কিছু ঘটনা সুযোগসন্ধানী অপশক্তি ঘটিয়েছে। এসব ঘটনায় ভারতের কয়েকটি সংবাদমাধ্যম প্রচার করছে উসকানিমূলক প্রতিবেদন। আর ফেসবুক, এক্স, টিকটক ও ইউটিউবের মতো সামাজিক মাধ্যমে চলছে ভয়াবহ প্রোপাগান্ডা ও গুজব।

গত ৭ আগস্ট বিকেলে এক্সে ‘মোহন গৌড়া’ নামের আইডি থেকে একটি ছবি পোস্ট করে বলা হয়, ‘বাংলাদেশ-আসাম সীমান্তে শরণার্থীদের ভিড় তৈরি হয়েছে’ শিরোনামে। অথচ যে ছবি পোস্ট করা হয়েছে, সেটি ২০১৮ সালে বাংলাদেশ-ভারত সীমান্তে দুই দেশে বসবাসরত বিচ্ছিন্ন আত্মীয়দের মিলনমেলার ছবি। একই দিন এক্সে ‘সালওয়ান মোমিকা’ নামের আইডি থেকে একটি ভিডিও পোস্ট করে বলা হয়, ‘বাংলাদেশে ইরাকের মতো হিন্দু নারীদের বন্দি করে বিক্রি করা হচ্ছে’। অথচ ওই ভিডিওটি বেগম বদরুন্নেসা সরকারি মহিলা কলেজে ছাত্রলীগের কয়েকজন নেত্রীকে বেঁধে রাখার সময়ের। ৬ আগস্টে রিপাবলিক বাংলার অফিসিয়াল ইউটিউব চ্যানেল থেকে প্রকাশিত একটি ভিডিওর শিরোনাম করা হয়, ‘চট্টগ্রামে লালদীঘি পাড় নবগ্রহ মন্দির ভাঙচুর’। অথচ খবরটি পুরোপুরি বানোয়াট।

সিলেটে হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের ওপর আক্রমণেরও একটি খবর ছড়ানো হয়। রিউমার স্ক্যানার একটি সংবাদমাধ্যমের বরাত দিয়ে জানায়, সিলেটে যে হিন্দুদের বাড়িঘরে হামলা হয়েছে, তারা আওয়ামী লীগের নেতা। এই তথ্য দিয়েছে হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিষ্টান ঐক্য পরিষদ। ওই সংগঠনের এক নেতা নাম প্রকাশ না করার শর্তে সংবাদমাধ্যমকে বলেন, ‘আমি এখন পর্যন্ত জানি, কোনো নিরীহ হিন্দু সিলেটে আক্রান্ত হননি। যারা হয়েছেন, তারা আওয়ামী লীগের নেতা।’

ভারতীয় সংবাদ ও সামাজিক মাধ্যমের এই প্রোপাগান্ডা বা গুজবের বিষয়টি ধরা পড়ছে আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যমের চোখেও। কাতারভিত্তিক আল জাজিরা একটি বিশ্লেষণধর্মী প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ভারতীয় সংবাদমাধ্যম ও সামাজিক মাধ্যমে বিভ্রান্তিকর নিবন্ধ ও ভিডিও প্রচার করা হচ্ছে।

বিজেপিঘনিষ্ঠ ভারতীয় সংবাদ সংস্থা এএনআই সে দেশের এক ছাত্রনেতাকে উদ্ধৃত করে বলেছে, এ দেশে অভ্যুত্থান ইসলামপন্থিরা ঘটিয়েছে। অথচ এই আন্দোলনের নেতৃত্বে ছিল ‘বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন’। আর শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর দেশের মূলধারার সব সংবাদমাধ্যম বিষয়টিকে ‘ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থান’ বা ‘ছাত্র-জনতার বিজয়’ বলেই উল্লেখ করে। টাইমস অব ইন্ডিয়ার একটি নিবন্ধেও দাবি করা হয়েছে, জামায়াতে ইসলামী শেখ হাসিনার সরকারকে ক্ষমতাচ্যুত করেছে। সাম্প্রদায়িক রং মাখিয়ে বানানো এসব গুজব-প্রোপাগান্ডার ঢেউ এসে পড়ছে ভারতের মুসলিমদের ওপর। আক্রান্ত হচ্ছে ভারতীয় মুসলিমরা। তা এপাড়েও অনুরণিত হচ্ছে। ফলে অস্থিরতা আরও উদ্বেগজনক রূপ নিচ্ছে।

সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh

// //