ইসরায়েল কি সাংবাদিক হত্যা করতেই থাকবে

নুসিরাত শরণার্থীশিবিরের মধ্যে আল আওদা হাসপাতাল। সেখানে পেশাগত দায়িত্ব পালনকালে পাঁচ সাংবাদিক খুনের শিকার হয়েছেন এবারের বড়দিনের পরদিন। ইসরায়েলি সেনাবাহিনী এক বিবৃতিতে এদের হত্যার কথা স্বীকার করেছে। কিন্তু নির্লজ্জের মতো উল্টো এই যুদ্ধাপরাধকে যৌক্তিক দেখাতে দাবি করেছে, ওই সাংবাদিকরা যে গাড়িতে ছিল, এতে কোনো সংকেত ছিল না, যা দেখে বোঝা যায় তা প্রেসের গাড়ি। অথচ আলজাজিরার এক প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, ওই গাড়িতে স্পষ্ট অক্ষরে ‘প্রেস’ কথাটা লেখা ছিল। এই নিরীহ পাঁচ ভিকটিম হচ্ছেন ইব্রাহিম শেখ আলী, ফয়সল আবু আল কামসন, মোহাম্মদ আল লাড্ডা, ফাদি হাসুনা ও আয়মান আল গেদি। আয়মান তার সন্তানসম্ভবা স্ত্রীকে নিয়ে হাসপাতালে গিয়েছিলেন। এ রকম কঠিন চাপের সময় সহকর্মীরা দেখতে এসেছিলেন, তাদের সঙ্গে গাড়ির কাছে গিয়ে কথা বলছিলেন আয়মান। ঠিক সে সময়ই ইসরায়েলি গোলা আঘাত হানে গাড়িতে। কয়েক ঘণ্টা পর তার ছেলে পৃথিবীর আলো দেখেছে, যে মুহূর্ত দেখে যেতে পারেননি আয়মান। 

ইসরায়েলি সেনাবাহিনী আরেক ধাপ এগিয়ে তাদের অপরাধের পক্ষে যুক্তি দিতে গিয়ে দাবি করেছে, এই পাঁচজন হামাসের যোদ্ধা, তারা আসলে সাংবাদিক রূপে ওই শিবিরে গিয়েছিলেন। এরা ফিলিস্তিনি ইসলামিক জিহাদের মদদপুষ্ট আল কুদস আল ইয়োম টিভির সঙ্গে জড়িত। শুধু এটুকু বলেনি যে, এরা খাতা-কলম বা বুমের বদলে গোলাবারুদ বা বোমা নিয়ে ঘুরছিলেন।

পশ্চিমা গণমাধ্যমগুলো পড়লে অবশ্য বোঝার উপায় নেই ইসরায়েলি বাহিনী যা বলছে তা সত্য না মিথ্যা। মানে এমনভাবে উপস্থাপন করা হয় যেন সত্যিই পাঁচজন হামাস যোদ্ধাকে হত্যা করেছে ইসরায়েল। পশ্চিমা গণমাধ্যমগুলো সাংবাদিকতার অনেক জ্ঞান এমনকি বিনে পয়সাও বিতরণ করে থাকে। কিন্তু যখন ইসরায়েলি আগ্রাসনের কথা হচ্ছে, তখন তারা পাঠককে এ কথা স্মরণ করিয়ে দেয় না যে, সাংবাদিক- এমনকি যেসব সাংবাদিক মিথ্যা প্রচারণা চালানোয় জড়িত বলে অভিযোগ আছে, তাদের ওপর হামলা করাও একটা যুদ্ধাপরাধ। আন্তর্জাতিক মানবাধিকার আইন দ্বারা সব সাংবাদিকই সুরক্ষা পাওয়ার কথা, এতে কোনো সেনামুলুক তাদের প্রতিবেদন পছন্দ করুক চাই না করুক।

জেনেভা কনভেনশনের অ্যাডিশনাল প্রটোকলের আর্টিকেল ৭৯ বলছে, সাংবাদিকরা জীবন বিপন্ন হওয়ার ঝুঁকি নিয়ে কাজ করেন। তারা যখন যুদ্ধক্ষেত্রে পেশাগত দায়িত্ব পালন করবেন, তখন তাদের বেসামরিক হিসেবে গণ্য করতে হবে এবং সেই কারণে তাদের জীবনের সুরক্ষাও দিতে হবে। 

কিন্তু ইসরায়েলি সেনাবাহিনী এসব আন্তর্জাতিক আইনকে থোড়ায় পাত্তা দেয়। গত ১৫ মাসে আমরা তা চেয়ে চেয়ে দেখছি। গাজা সরকারের গণমাধ্যম দপ্তর থেকে পাওয়া তথ্য অনুসারে, ২০২৩ সালের ৭ অক্টোবর থেকে অবরুদ্ধ উপত্যকায় এ পর্যন্ত তারা ২০১ জন সাংবাদিককে হত্যা করেছে। ২০২৩ সালের ৭ অক্টোবর গাজার সশস্ত্র সংগঠন হামাস ইসরায়েলের দক্ষিণাঞ্চলে হামলা চালিয়ে এক হাজার ১৩৯ জনকে হত্যা করে। জিম্মি করে নিয়ে যায় আরো প্রায় আড়াইশ জনকে। কিছুসংখ্যক জিম্মি মুক্তি পেয়েছে। কিছু জিম্মির মরদেহ উদ্ধার করেছে ইসরায়েল। গাজায় এখনো ৯৬ জন ইসরায়েলি জিম্মি রয়েছেন। তাদের মধ্যে ৩৪ জনের মৃত্যু হয়েছে বলে জানিয়েছে ইসরায়েলি সেনাবাহিনী।

এই যুদ্ধে শুরু থেকে পশ্চিমা দেশগুলো ইসরায়েলকে জঘন্যভাবে সমর্থন জুগিয়ে আসছে। এরই মধ্যে ৪৫ হাজারের বেশি ফিলিস্তিনি নিহত হয়েছে। নিহতদের মধ্যে এক-তৃতীয়াংশই নিরীহ ও নিরস্ত্র শিশু। গণহত্যা ও যুদ্ধাপরাধের অভিযোগে আন্তর্জাতিক বিচার আদালত ইসরায়েলি প্রধানমন্ত্রী বেঞ্জামিন নেতানিয়াহুর বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করেছেন। কিন্তু নেতানিয়াহু ও তার বধির প্রতিরক্ষা বাহিনী এখন পর্যন্ত কোনো ধরনের নমনীয়তা দেখায়নি। যুক্তরাষ্ট্রের নতুন প্রেসিডেন্ট হিসেবে এ মাসে ডোনাল্ড ট্রাম্প দায়িত্ব নেওয়ার পর ইসরায়েলের গাজানীতি কতটা বদলায় তা অবশ্য দেখার বিষয়।

সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2025 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh