
১১ দিন ধরে চলা ইসরায়েলি ধ্বংসযজ্ঞের পরও উঠে দাঁড়াচ্ছে ফিলিস্তিন। ছবি : এপি
জায়নবাদী দখলদাররা একদিকে পূর্ব জেরুজালেম দখল করে সেখানকার বৈধ ফিলিস্তিনি বাসিন্দাদের উচ্ছেদ করে সে সম্পত্তি অবৈধ ইসরায়েলি সেটেলারদের হাতে তুলে দিচ্ছে; অপরদিকে গাজায় টানা ১১ দিন নির্বিচারে বেসামরিক স্থাপনায় নৌ, স্থল ও আকাশপথে বোমা হামলা চালিয়েছে।
বিশ্বজুড়ে ইসরায়েলি দখলদারিত্ব ও হত্যাযজ্ঞের সমালোচনা হচ্ছে। তবে ব্যতিক্রম ভারতে ক্ষমতাসীন হিন্দুত্ববাদী শক্তি। ভারতের কেন্দ্রে ক্ষমতাসীন ভারতীয় জনতা পার্টির (বিজেপি) অনেক নেতা-কর্মী ও অন্যান্য হিন্দুত্ববাদী সংগঠনের প্রভাবশালী সংগঠকরা ইসরায়েলি আগ্রাসনকে সমর্থন করছেন। এমনকি এর পক্ষে বিভিন্ন কৌশলে সাফাই গাইছেন।
বিশ্বব্যাপী ইসরায়েলি আগ্রাসনের বিরুদ্ধে জনমত গড়ে ওঠে। এমনকি ইসরায়েলের অভ্যন্তরে ও বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে যুদ্ধবিরোধী ইহুদিরা বিক্ষোভ করেছে। বিশ্ব জনমতের চাপে ইসরায়েলি প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহুকেও নরম হতে হয়। মিসরের মধ্যস্থতায় অস্ত্রবিরতিতে যেতে বাধ্য হয় ইসরায়েল। আর আগ্রাসী শক্তির এ পিছু হটাকে ফিলিস্তিনের বিজয় বলে মনে করা হচ্ছে।
তবে বিশ্ব জনমত ফিলিস্তিনের পক্ষে থাকলেও ভারতের ক্ষমতাসীনদের বিষয়টি ভিন্ন। কাতারভিত্তিক সংবাদমাধ্যম আল জাজিরা এক প্রতিবেদনে জানিয়েছে, গাজায় ইসরায়েলি আগ্রাসনের সমর্থনে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে বিভিন্ন ধরনের হ্যাশট্যাগ ব্যবহার করছে ভারতীয় হিন্দুত্ববাদীরা। এর মধ্যে রয়েছে ‘আইসাপোর্টইসরায়েল’, ‘ইন্ডিয়াউইথইসরায়েল’, ‘ইন্ডিয়াস্ট্যান্ডসউইথইসরায়েল’, ‘ইসরায়েলআন্ডারফায়ার’। হিন্দুত্ববাদীরা ইসরায়েলের সুরে সুর মিলিয়ে ফিলিস্তিনের স্বাধীনতাকামী সংগঠনগুলোকে ‘সন্ত্রাসী’ বলেও উল্লেখ করেছে। গত ১৫ মে (শনিবার) রাতে টুইটারে ভারত থেকে পোস্ট করা সবচেয়ে ব্যবহৃত হ্যাশট্যাগ ছিল ‘প্যালেস্টাইনটেরোরিস্টস’।
ইসরায়েলকে সমর্থন জানিয়ে পোস্ট করাদের বেশিরভাগই বিজেপির সাথে জড়িত। গত ১৯ মে (বুধবার) এক টুইট বার্তায় সংসদ সদস্য ও মুসলিমবিদ্বেষী বক্তব্যের কারণে পরিচিত বিজেপি নেতা তেজস্বী সূর্য লেখেন, ‘আমরা তোমাদের সঙ্গে আছি। শক্ত থাকো, ইসরায়েল।’ ওই পোস্টে লাইক দিয়েছেন প্রায় ৫০ হাজার মানুষ এবং এটি শেয়ার হয়েছে প্রায় ১৩ হাজার বার।
গত ১৪ মে (শুক্রবার) চন্ডীগড় শহরের বিজেপির মুখপাত্র গৌরব গোয়েল ইসরায়েলি সেনাদের একটি ছবি টুইটারে পোস্ট করে লেখেন, ‘প্রিয় ইসরায়েলিরা, আপনারা একা নন। আমরা ভারতীয়রা আপনাদের সঙ্গে আছি।’
হারদিক ভাসবার নামে এক টুইটার ব্যবহারকারীর প্রায় দেড় লাখ ফলোয়ার রয়েছেন। তাদের মধ্যে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি ও স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহও রয়েছেন। গত ১৫ মে (শনিবার) গাজায় ইসরায়েলি হামলায় আল জাজিরা ও এপির অফিস ধসে পড়ার ভিডিও শেয়ার করে তিনি লেখেন, ‘হ্যাপি দিওয়ালি লিবারেলস।’ সেখানে হ্যাশট্যাগ হিসেবে ব্যবহার করেন ‘ইন্ডিয়াস্ট্যান্ডসউইথইসরায়েল’।
গত ১৬ মে (রোববার) ভারতীয় সাংবাদিক ও গবেষক রানা আইয়ুব এক টুইট বার্তায় লেখেন, ‘বেশিরভাগ ক্ষেত্রে ইসরায়েলকে সমর্থন জানানো হয়েছে মুসলমানদের প্রতি পুষে রাখা বিদ্বেষ থেকে। এসব পোস্ট করার ক্ষেত্রে মুসলমানদের গণহত্যার শিকার হতে দেখার বাসনাও কাজ করেছে।’
লেখক ও গবেষক শ্রীনিবাস কোদালি বলেন, ‘হিন্দুত্ববাদীদের একটি অংশ শুধু মুসলমানরা মরছে বলেই ইসরায়েলি হামলাকে সমর্থন করছে। মুসলমানদের প্রতি ঘৃণার কারণেই ইসরায়েলের কর্মকাণ্ড তাদের উল্লসিত করছে।’
উল্লেখ্য, ভারত শুরু থেকেই ফিলিস্তিনিদের মুক্তি সংগ্রামে সমর্থন জানিয়ে আসছিল। ১৯৮১ সালের ২৯ নভেম্বর ফিলিস্তিনের প্রতি সংহতি জানিয়ে একটি ডাকটিকিটও প্রকাশ করে দেশটি। ১৯৫০ সালে ইসরায়েলকে স্বীকৃতি দেয় ভারত। তবে ১৯৯২ সালের আগে কূটনৈতিক সম্পর্ক স্থাপিত হয়নি। এরপর থেকে এই সম্পর্ক আরো গভীর হয়েছে। বর্তমানে ইসরায়েলি অস্ত্রের সবচেয়ে বড় ক্রেতা ভারত। ইসরায়েলের রফতানি করা অস্ত্রের ৪৬ শতাংশই যায় ভারতে।
তবে ২০১৪ সালে ভারতে হিন্দুত্ববাদী নরেন্দ্র মোদি সরকার ক্ষমতায় আসার পর থেকে ইসরায়েলের সাথে ঘনিষ্ঠতা ব্যাপকভাবে বৃদ্ধি পায়। ২০১৭ সালে ভারতের প্রথম প্রধানমন্ত্রী হিসেবে ইসরায়েল সফরে যান মোদি। দেশটির প্রেসিডেন্ট বেনিয়ামিন নেতানিয়াহুকে ‘বন্ধু’ বলেও সম্বোধন করেন তিনি। গত বছর করোনাকালেও ভারত অস্ত্রচুক্তি করেছে ইসরায়েলের সাথে।
তবে গত ১৭ মে (সোমবার) ইসরায়েলের বিরুদ্ধে ফিলিস্তিনিদের প্রতিরোধে সমর্থন জানিয়ে বুকারজয়ী লেখক অরুন্ধতী রায় ও নয়নতারা শেহগালের নেতৃত্বে কয়েকজন লেখক, শিল্পী, বুদ্ধিজীবী বিবৃতি দিয়েছেন। বিবৃতি দাতাদের মধ্যে আরো রয়েছেন অভিনেত্রী রত্না পাঠক, নাসিরুদ্দিন শাহ, গীতা হরিহরণ, অর্থনীতিবিদ প্রভাব পাটনায়েক প্রমুখ। ওই বিবৃতিতে তারা ফিলিস্তিনি শিশুদের হত্যা ও অবৈধভাবে ফিলিস্তিনিদের ভূখণ্ড কেড়ে নেয়ার জন্য ইসরায়েল সরকার ও ইসরায়েলি সেটেলারদের দায়ী করেছেন।
জায়নবাদের পক্ষে লাখো টুইট এলেও ওই বিবৃতিটিই ছিল এখন পর্যন্ত ভারত থেকে দেয়া ফিলিস্তিনের প্রতিরোধ যুদ্ধের পক্ষে সবচেয়ে শক্তিশালী বক্তব্য। বিবৃতিতে বলা হয়, গাজার ফিলিস্তিনিরা ইসরায়েলকে লক্ষ্য করে রকেট নিক্ষেপ করছে। এই রকেট নৃশংসতা শুরু বা নির্ধারণ করেনি। অবৈধ দখলের বিরুদ্ধে এই রকেটগুলো প্রতিরোধের অংশ, যা আন্তর্জাতিক আইন সমর্থন করে।
এর আগে ১৬ মে (রবিবার) জাতিসংঘের এক সভায় রাষ্ট্রীয়ভাবে ফিলিস্তিনিদের প্রতি সংহতি জানায় ভারত। এটিকে ‘লজ্জাজনক কূটনীতি’ হিসেবে অভিহিত করেছে বিজেপির হিন্দুত্ববাদী সমর্থকরা। কার্যত এর মধ্য দিয়ে ওই হিন্দুত্ববাদীরা মুসলিমবিদ্বেষী অবস্থানের জানান দিয়ে নিজের সাম্প্রদায়িক পরিচয় তুলে ধরছে এবং সংখ্যাগরিষ্ঠতাবাদের সমর্থন নিতে চাইছে। যে মুসলিমবিদ্বেষ জায়নবাদ ও হিন্দুত্ববাদকে ‘সহজাত পরম বন্ধু’ করে তোলে।
সাম্প্রতিক আগ্রাসন
ফিলিস্তিনে সাম্প্রতিক ইসরায়েলি আগ্রাসন শুরু হয় পূর্ব জেরুজালেমের দখলীকৃত শেখ জারা এলাকায় কয়েকটি ফিলিস্তিনি পরিবারকে উচ্ছেদ করা দিয়ে। ফিলিস্তিনিরা বলছেন, ইসরায়েলের নানা পদক্ষেপ এবং কঠোর বিধিনিষেধের কারণে তারা খুবই দুর্দশার মধ্যে আছে। পূর্ব জেরুজালেম এবং পশ্চিম তীরে বসবাসকারী ফিলিস্তিনিদের বিভিন্ন অজুহাতে উচ্ছেদ করা হয়। ইসরায়েলি বাহিনীর প্রত্যক্ষ মদদে সেটেলাররা ফিলিস্তিনিদের ওপর হামলা চালায়। গত রবিবারও (২৩ মে) উগ্র-জায়নবাদী একটি গ্রুপ ইসরায়েলি বিশেষ বাহিনী সহযোগিতায় আল-আকসা মসজিদে তাণ্ডব চালিয়েছে।
চলতি বছরের এপ্রিলের মাঝামাঝি রমজান মাসের শুরু থেকে উত্তেজনা বাড়তে থাকে। তখন প্রায় প্রতি রাতেই পূর্ব জেরুজালেম ও পশ্চিম তীরের ফিলিস্তিনিদের সঙ্গে ইসরায়েলি পুলিশের সংঘর্ষ চলছিল। রমজান মাসের প্রথম রাত ১৩ এপ্রিল আল-আকসা মসজিদের কাছাকাছি ওয়েস্টার্ন ওয়ালে ইসরায়েলি প্রেসিডেন্টের বক্তব্য দেয়ার কথা ছিল। ওই দিন ছিল ইসরায়েলের ‘মেমোরিয়াল ডে’। ইসরায়েলি কর্মকর্তাদের আশঙ্কা ছিল- আজানের কারণে ইসরায়েলি প্রেসিডেন্টের বক্তব্যে বিঘ্ন ঘটতে পারে। মসজিদে ঢুকে পড়ে ইসরায়েলি পুলিশের একটি দল। তারা কেটে দেয় লাউড স্পিকারের সংযোগ। জেরুজালেমের গ্র্যান্ড মুফতি শেখ একরিমা সাবরি বলেন, ‘মসজিদে ইসরায়েলি পুলিশের ওই অভিযানের কারণেই পরিস্থিতি এতটা খারাপ হয়ে পড়ে।’
ওয়ার্ল্ড জায়নিস্ট অর্গানাইজেশনের সাবেক চেয়ারম্যান ও ইসরায়েলি পার্লামেন্টের সাবেক স্পিকার আব্রাহাম বার্গ বলেন, গাজায় বছরের পর বছর ধরে চলা অবরোধ ও নিষেধাজ্ঞা, পশ্চিম তীর দখল করে রাখা ও আরবদের বিরুদ্ধে বৈষম্যমূলক আচরণের পরিণতিতেই এমন সংঘর্ষের ঘটনা ঘটছে।
এরপর পশ্চিম তীরে আগ্রাসনের সঙ্গে সঙ্গে গাজায় হামলা চালানো শুরু করে ইসরায়েল। ফিলিস্তিন কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে, গত ২৩ মে (রোববার) পর্যন্ত অধিকৃত পশ্চিম তীরে ইসরায়েলি পুলিশ ও বিশেষ বাহিনীর অন্তত ২৫ ফিলিস্তিনিকে হত্যা করেছে। এর মধ্যে চারজনের বয়স ১৮ বছরেরও কম। অন্তত ১৪ ফিলিস্তিনিকে বাড়ি থেকে গ্রেফতার করা হয়েছে। গত ১০ মে (সোমবার) থেকে শুরু করে টানা ১১ দিন নৌ, স্থল ও আকাশপথে গাজায় বোমা হামলা চালিয়েছে জায়নবাদীরা। এ গণহত্যায় অন্তত ২৪৮ জন নিহত হয়েছেন। এর মধ্যে ৬৬ শিশু ও ৩৯ নারী রয়েছেন। আহতের সংখ্যা প্রায় দুই হাজার।
গাজায় ক্ষমতাসীন হামাস সেখানে অন্যান্য প্রতিরোধী শক্তির সঙ্গে জোট গঠন করে ঐক্যবদ্ধভাবে রকেট হামলা চালিয়েছে ইসরায়েলে। চারদিক থেকে আসা এ ‘রকেট বৃষ্টি’ ইসরায়েলের ক্ষেপণাস্ত্র প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা আটকাতে সক্ষম হয়নি। ফলে এর বেশ কয়েকটি ইসরায়েলে আঘাত করেছে। অন্তত ১২ ইসরায়েলি নিহত হওয়ার কথা আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যমগুলো জানিয়েছে।
বিশ্লেষকেরা বলছেন, ইসরায়েলি সরকার আধিপত্য বজায় রাখতে একের পর এক হামলা চালিয়ে যাচ্ছে। আর এক্ষেত্রে ইসরায়েলের চোখে সন্ত্রাসী দল হামাস ফিলিস্তিনি আন্দোলনে নিজেদের অবস্থান আরো পোক্ত করতে পারছে। তারা ভিন্ন মতাবলম্বীদের সাথে এবারই প্রথম জোটবদ্ধ হয়ে প্রতিরোধ যুদ্ধ চালিয়েছে।