চলমান যুদ্ধ নিয়ে আব্বাসের বক্তব্য ও হামাস-ফাতাহ বৈরিতা

ডেস্ক রিপোর্ট
প্রকাশ: ১৬ অক্টোবর ২০২৩, ২১:৩৩

হামাস নেতা ইসমাইল হানিয়া ও ফিলিস্তিনি প্রেসিডেন্ট মাহমুদ আব্বাস। ছবি- সংগৃহীত
ফিলিস্তিনের প্রধান রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে দ্বন্দ্ব চূড়ান্ত পর্যায়ে পৌঁছায় ২০০৭ সালের জুন মাসে। সে সময় গাজা উপত্যকায় হামাস এবং ফাতাহর লড়াইয়ে বহু মানুষ হতাহত হয়েছিল। এই সশস্ত্র সংঘাত, ‘গাজার যুদ্ধ’ নামেও পরিচিত। এই লড়াই দুই প্রতিদ্বন্দ্বীর মধ্যে এত গভীর বৈরিতা সৃষ্টি করেছিল যে সেই সংঘাতের চিহ্ন আজও বয়ে বেড়াতে হচ্ছে।
সম্প্রতি ইসরায়েলে হামাসের হামলা এবং এর জবাবে গাজায় ইসরায়েলের লাগাতার পাল্টা হামলার ঘটনায় ফিলিস্তিনিদের পক্ষে বিভিন্ন দেশে বিশেষ করে মধ্যপ্রাচ্যে বিক্ষোভের জোয়ার বয়ে যাচ্ছে।
ভেনেজুয়েলার প্রেসিডেন্ট নিকোলাস মাদুরোর সঙ্গে ফোনালাপে ফিলিস্তিনের প্রেসিডেন্ট মাহমুদ আব্বাস বলেছেন, হামাসের কর্মকাণ্ড ও নীতি ফিলিস্তিনি জনগণের প্রতিনিধিত্ব করে না।
আব্বাস উভয় পক্ষের বেসামরিক লোকদের হত্যার প্রত্যাখ্যান নিশ্চিত করেছেন। এ ছাড়া উভয় পক্ষের বেসামরিক নাগরিক ও বন্দিদের মুক্তির আহ্বান জানিয়েছেন তিনি।
আব্বাসের এই বক্তব্য ফিলিস্তিনের স্বাধীনতাকামী গোষ্ঠি হামাসের রাজনৈতিক চিন্তার ঠিক বিপরীত। ২০০৬ সালে ফিলিস্তিনের পার্লামেন্ট নির্বাচনে ফাতাহ হেরে যাওয়া ও হামাস যোদ্ধারা গাজার নিয়ন্ত্রণ নেওয়ার পর হামাস-ফাতাহ’র এই দ্বন্দ্ব শুরু হয়। এর মাধ্যমে ফিলিস্তিনের যৌথ সরকারের বিলুপ্তি ঘটে এবং ফিলিস্তিনি ভূখণ্ডে শাসনভার ভাগ হয়ে যায়।
ফিলিস্তিনের দুই অংশ- পশ্চিম তীর ফাতাহ আর গাজা হামাসের শাসনে চলে যায়।
ধর্মনিরপেক্ষ বনাম ইসলামপন্থি
মাহমুদ আব্বাস ২০০৪ সালের ১১ নভেম্বর থেকে প্যালেস্টাইন লিবারেশন অর্গানাইজেশনের (পিএলও) সভাপতি এবং ২০০৫ সালের ১৫ জানুয়ারি থেকে ফিলিস্তিনের জাতীয় কর্তৃপক্ষের রাষ্ট্রপতি। তিনি ফাতাহ রাজনৈতিক দলের প্রতিনিধিত্ব করেন, যার সঙ্গে হামাসের তিক্ত প্রতিদ্বন্দ্বিতা রয়েছে।
গত ৭ অক্টোবর ক্ষমতাধর ইসরায়েলের আকাশ প্রতিরক্ষা ভেদ করে ভোরে হামলা চালায় ফিলিস্তিনের মুক্তিকামী বাহিনী হামাস। আক্রমণের পরপরই ফিলিস্তিনের ভূরাজনীতিতে দলটির শক্ত অবস্থান প্রতীয়মাণ হয়ে উঠেছে। তবে অবরুদ্ধ গাজা উপত্যকায় হামাসের একচ্ছত্র রাজত্ব থাকলেও, পুরো ফিলিস্তিনের রাজনীতি আছে জটিল অবস্থায়। সবচেয়ে প্রভাবশালী দল ফাতাহ। তার পরেই আসে হামাসের নাম। হামাস ইসলামপন্থি আর ফাতাহ ধর্মনিরপেক্ষ।
হামাস অর্থ ‘উদ্যম’। এটি হারাকাত আল-মুকাওয়ামাহ আল-ইসলামিয়া বা ইসলামি প্রতিরোধ আন্দোলনের সংক্ষিপ্ত রূপ। ইসরায়েলের দখলদারত্বের বিরুদ্ধে ফিলিস্তিনি বিদ্রোহ শুরুর পরপরই ১৯৮৭ সালে গাজায় প্রতিষ্ঠিত হয় দলটি। ইমাম শেখ আহমেদ ইয়াসিন ও সহযোগী আবদুল আজিজ আল-রান্টিসি দলটি গঠন করেন। ২০১৭ সালে হামাস নতুন একটি ধারা প্রকাশ করে, যা ফাতাহর সম্পূর্ণ বিপরীত। ইসরায়েলের রাষ্ট্রকে সম্পূর্ণ অস্বীকৃতি জানিয়ে বলা হয়, ‘হামাস বিশ্বাস করে যে ‘ইসরায়েল’ প্রতিষ্ঠা সম্পূর্ণ ‘অবৈধ’।
লক্ষ্য এক, ভিন্ন দৃষ্টিভঙ্গি
প্যালেস্টাইন লিবারেশন অর্গানাইজেশনের (পিএলও) অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন ইয়াসির আরাফাত। ফাতাহ ইসরায়েল রাষ্ট্রের অস্তিত্বকে স্বীকৃতি দেয়।
অন্যদিকে হামাস ইসরায়েল রাষ্ট্রকে স্বীকৃতি দেয় না। বরং এই সশস্ত্র গোষ্ঠীটি তাদের ১৯৮৮ সালের প্রতিষ্ঠা সনদে বর্তমান ইসরায়েলসহ ফিলিস্তিনি অঞ্চলগুলো নিজেদের নিয়ন্ত্রণে নেয়ার কথা ঘোষণা করেছে।
২০১৭ সালে স্বাক্ষরিত একটি নতুন নথিতে তারা ১৯৬৭ সালের যুদ্ধের আগে বিদ্যমান সীমানাকে ফিলিস্তিনি রাষ্ট্রের ভিত্তি হিসাবে স্বীকার করে। যেখানে জেরুজালেম হবে রাজধানী।
নথিতে জোর দেওয়া হয়েছে যে, হামাসের লড়াই ইহুদিদের বিরুদ্ধে নয় বরং ‘দখলকারী ইহুদিবাদী হানাদারদের’ বিরুদ্ধে।
দুটি রাজনৈতিক দলের লক্ষ্য একটি একক ফিলিস্তিন রাষ্ট্র গঠন। কিন্তু তাদের দৃষ্টিভঙ্গি স্পষ্টতই ভিন্ন।
ফাতাহ, কখনও কখনও আল-ফাতাহ নামে পরিচিত, ফিলিস্তিনি কর্তৃপক্ষের (পিএ) এই বৃহত্তম রাজনৈতিক দলের নেতা হলেন, মাহমুদ আব্বাস। তিনি ফিলিস্তিনের প্রেসিডেন্ট হিসেবে আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত।
ফাতাহ নিজেদের একটি ধর্মনিরপেক্ষ রাজনৈতিক দল হওয়ায় ইসরায়েলিদের সাথে আলোচনা করতে পারে সেইসাথে বিভিন্ন আন্তর্জাতিক ফোরামে অংশ নিতে পারে।
যেখানে হামাস ফিলিস্তিনি অঞ্চলে ইসরায়েলি দখলদারিত্বের বিরুদ্ধে লড়াই করার জন্য এবং একটি ইসলামিক রাষ্ট্র গঠনের জন্য সশস্ত্র পথ বেছে নিয়েছে।
প্রত্যাশা পূরণ না হওয়ায় হতাশ ফিলিস্তিনিরা
১৯৪৮ সালে ইসরায়েল রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার পর থেকে ৭৫ বছর পেরিয়ে গিয়েছে। ফিলিস্তিনিদের একটা বড় অংশ এই দেখে হতাশ যে তারা তাদের প্রত্যাশা এখনও অর্জন করতে পারেনি, না কূটনৈতিক উপায়ে না সশস্ত্র উপায়ে।
পরিস্থিতি জটিল কারণ একটি প্রশ্ন থেকেই যায় যে, কারা আসলে ফিলিস্তিনিদের প্রতিনিধিত্ব করছে।
বিশ্লেষকরা মনে করেন, এই অচলাবস্থার কারণে হামাস তাদের সশস্ত্র প্রতিরোধের মাধ্যমে মানুষের ব্যাপক সমর্থন আদায় করতে পেরেছিল, অন্তত গাজায় তারা অনেক সমর্থন পায়।
বর্তমান সংকটময় পরিস্থিতিতে হাজার হাজার মানুষ হতাহত হওয়ার আগ পর্যন্ত হামাস এই সমর্থন পেয়েছে।
এখন প্রশ্ন উঠেছে, ৮৭ বছর বয়সী মাহমুদ আব্বাস প্রায় ২০ বছর ধরে ফিলিস্তিনি কর্তৃপক্ষের দায়িত্ব পালন করে আসছেন, এখন তার স্থলে পশ্চিম তীরের শীর্ষ নেতৃত্বে কে আসবেন?
এটাও বলা যাচ্ছে না, গাজায় ইসরায়েলের সাথে বর্তমান সংঘাতের অবসান হলে হামাস নেতাদের কী হবে? অথবা নতুন পরিস্থিতির আলোকে পশ্চিম তীর এবং গাজা উপত্যকার তরুণ ফিলিস্তিনিরা ভবিষ্যতে কীভাবে প্রতিক্রিয়া দেখাবে তাও অজানা।
সূত্র- বিবিসি