গোটা মধ্যপ্রাচ্যকে যুদ্ধক্ষেত্র বানাচ্ছে যুক্তরাষ্ট্র

অরুন্ধতী সুর
প্রকাশ: ১১ অক্টোবর ২০২৪, ১০:৩০

লেবাননে ইসরায়েলের হামলা। ছবি: সংগৃহীত
প্রথমে গাজায়, এখন লেবাননে সামরিক আগ্রাসন চালিয়ে বেসামরিক মানুষকে হত্যা করছে ইসরায়েল। এসব হামলায় দেশটিকে প্রকাশ্যে অর্থ ও অস্ত্র-সহায়তা দিয়ে আসছে যুক্তরাষ্ট্র; কিন্তু মিত্রকে শত্রুশিবির থেকে রক্ষার পররাষ্ট্রনীতির মোড়কে মার্কিন নেতৃত্ব মূলত গোটা মধ্যপ্রাচ্যকেই যুদ্ধক্ষেত্রে পরিণত করছে। এই ক্ষেত্রে ওয়াশিংটনের দ্বিচারিতা দিবালোকের মতোই স্পষ্ট।
মধ্যপ্রাচ্যে আঞ্চলিক অস্থিতিশীলতা এবং মার্কিন মাতব্বরির ইতিহাস বেশ পুরনো। ইরান ও সৌদি আরবে শিয়া-সুন্নি বৈরিতা, ফিলিস্তিনে ফাতাহ ও হামাসের অনৈক্য- এসবকে পুঁজি করে এই অঞ্চলে সব দিক থেকেই প্রভাব বিস্তার করে আছে যুক্তরাষ্ট্র। প্রয়োজনে ইহুদি ফ্যাসিবাদী সরকারকে অন্ধের মতো সমর্থন দিতে পিছপা হয় না তারা।
যুক্তরাষ্ট্রের আশকরায় ইসরায়েলি দখলদারত্বের শিকার হয়ে আসছে গাজা উপত্যকার ফিলিস্তিনিরা। দীর্ঘ ৫৬ বছরের শ্বাসরুদ্ধকর দখলদারত্বের প্রতিশোধ নিতে গত বছর ৭ অক্টোবর ইসরায়েলে অতর্কিতে হামলা করে গাজার শাসকগোষ্ঠী হামাস। এতে নারী, শিশুসহ ১১শ’র বেশি মানুষ নিহত হয়। হামাস আড়াইশর মতো মানুষকে জিম্মি করে নিয়ে যায়। পাল্টা প্রতিশোধ নিতে সেদিনই গাজায় সর্বাত্মক সামরিক আগ্রাসন শুরু করে ইসরায়েল; কিন্তু জিম্মিদের জীবিত উদ্ধারে ব্যর্থ দেশটি এই এক বছরে প্রায় ৪২ হাজার ফিলিস্তিনিকে হত্যা করেছে, এদের বেশিরভাগই নিরীহ ও নিরস্ত্র নারী ও শিশু এবং বেসামরিক মানুষ।
হামাসকে ইসরায়েল এবং যুক্তরাষ্ট্রসহ মিত্ররা সন্ত্রাসী সংগঠন বলে মনে করে; কিন্তু তুরস্কের প্রেসিডেন্ট রিসেপ তাইয়েপ এরদোগানের ভাষায়- হামাস হলো ফিলিস্তিনের স্বাধীনতাকামী সংগঠন। হামাস ও স্বাধীনতাকামী ফিলিস্তিনিদের পক্ষে এই যুদ্ধে প্রথম থেকেই সমর্থন এবং মাঝেমধ্যেই দূর থেকে হামলা চালিয়ে আসছিল লেবাননের সশস্ত্রগোষ্ঠী হিজবুল্লাহ ও ইয়েমেনের সশস্ত্র বিদ্রোহীগোষ্ঠী হুথি। এদেরকে অর্থ ও অস্ত্র সহায়তা দেওয়ার অভিযোগ আছে ইরানের বিরুদ্ধে। আর এর বদলা নিতে ইরানের মাটিতে হামাসের রাজনৈতিক শাখার নেতা ইসমাইল হানিয়া ও ইরানের রেভল্যুশনারি গার্ডস কর্পসের কমান্ডার বিগ্রেডিয়ার জেনারেল আব্বাস নিলফোরোইশান এবং লেবাননে হিজবুল্লাহর নেতা হাসান নাসরুল্লাহকে হত্যা করেছে ইসরায়েল। এসব নেতাকে হত্যার প্রতিবাদে এবং লেবাননে স্থল অভিযান শুরুর ঘোষণার পরই ১ অক্টোবর ইসরায়েলের সামরিক স্থাপনাগুলোকে লক্ষ্য করে ১৮০টি ক্ষেপণাস্ত্র হামলা করে ইরান। এতে আরও ক্রোধান্বিত আওয়াজ শোনা গেছে ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেঞ্জামিন নেতানিয়াহুর মুখ থেকে এবং বেজায় চটতে দেখা গেছে মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনকে। ওয়াশিংটনকে বলতে শোনা যাচ্ছে- ইরানের এ ধরনের স্পর্ধা এবং ইসরায়েলের অসহায়ত্ব যুক্তরাষ্ট্রকে মধ্যপ্রাচ্যে যুদ্ধে জড়াতে বাধ্য করছে।
কিন্তু সামাজিক মাধ্যমে জনমত এবং আন্তর্জাতিক অনলাইন সংবাদগুলোর পাঠকের মন্তব্য পরিলক্ষ করলে ভিন্ন দিক উন্মোচন হয়। অনেকের মতে, ‘ইরান সমর্থিত হিজবুল্লাহ সন্ত্রাসীরা ইসরায়েলে গোলা মারছে’- এমনটি না বলে বলা উচিত, ‘মার্কিন মদদে ইহুদিরাষ্ট্রবাদী কর্তৃপক্ষ যুক্তরাষ্ট্রের তৈরি বোমা মারছে গাজায়’। যুক্তরাষ্ট্রের তৈরি বোমা, ট্যাংক ও যুদ্ধবিমান এবং গোয়েন্দা তথ্য ব্যবহার করে ফিলিস্তিনে বর্বর গণহত্যা চালিয়ে যাচ্ছে ইসরায়েল এবং এখন লেবাননে আগ্রাসন শুরু করেছে। এমনকি ইরানের পারমাণবিক স্থাপনায় বড় ধরনের হামলার প্রস্তুতি নিচ্ছে তেল আবিব। আর তা হলে, গোটা মধ্যপ্রাচ্যই যুদ্ধক্ষেত্র হয়ে যেতে পারে।
গত এক বছরে গাজা উপত্যকায় ৪০ হাজারের বেশি স্থাপনা লক্ষ্য করে বোমা হামলা চালিয়েছে ইসরায়েল। এতে গাজার বড় অংশ ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়েছে এবং ফিলিস্তিন গণহত্যার অভিযোগ এনেছে ইসরায়েলের বিরুদ্ধে। এদিকে গাজা যুদ্ধে নিহত ইসরায়েলি সেনাদের একটি তালিকাও প্রকাশ করেছে দেশটির সামরিক বাহিনী। তালিকা অনুযায়ী এই যুদ্ধে ৭২৬ সেনা নিহত হয়েছে। তাদের মধ্যে ৩৮০ জনের মৃত্যু হয়েছে ৭ অক্টোবর হামাসের হামলার সময়। গাজায় স্থল অভিযান শুরুর পর মৃত্যু হয়েছে বাকি ৩৪৬ সেনার।
এরপর যুদ্ধ আরও ছড়িয়ে পড়েছে। হামাসের হামলার ১২ মাস পর এসে মধ্যপ্রাচ্য এখন ভয়াবহ ও আরও ধ্বংসাত্মক একটি যুদ্ধের দ্বারপ্রান্তে দাঁড়িয়েছে।