যেভাবে হামাস প্রধান সিনওয়ারকে হত্যা করেছে ইসরায়েল

অনলাইন ডেস্ক
প্রকাশ: ১৮ অক্টোবর ২০২৪, ১৯:১৩

ইসরায়েলি সেনাদের হামলায় নিহত হামাসের প্রধান ইয়াহিয়া সিনওয়ার। ছবি: সংগৃহীত
ফিলিস্তিনের গাজায় এক বছরের বেশি সময় ধরে হামাস প্রধান ইয়াহিয়া সিনওয়ারকে খুঁজছিল ইসরায়েল। দেশটির অভিযোগ ছিল, গত বছরের ৭ অক্টোবরের নজিরবিহীন হামলার পরিকল্পনা করার পরপরই গাজায় লুকিয়ে যান তিনি। ৬১ বছর বয়সী ইয়াহিয়া সিনওয়ার বেশিরভাগ সময় গাজা উপত্যকার নিচে সুড়ঙ্গের ভেতরে লুকিয়ে ছিলেন।
বলা হচ্ছিল, সেখানে তার সুরক্ষার জন্য কয়েকজন দেহরক্ষী এবং ইসরায়েল থেকে আটক করা কিছু জিম্মি ছিল যাদেরকে ‘মানব ঢাল’ হিসেবে ব্যবহার করা যায়। কিন্তু শেষ পর্যন্ত মনে হচ্ছে যখন তিনি দক্ষিণ গাজায় ইসরায়েলি টহলদারদের একটি দলের মুখোমুখি হন তখন তার সাথে খুবই কম সংখ্যক দেহরক্ষী ছিল। কোনো বন্দিও সেখানে পাওয়া যায়নি।
সিনওয়ার হত্যা নিয়ে যেসব তথ্য পাওয়া গেছে
ইসরায়েলের প্রতিরক্ষা বাহিনী বলেছে, তাদের ৮২৮তম বিসলামাক ব্রিগেডের একটি ইউনিট গত বুধবার (১৬ অক্টোবর) রাফাহ অঞ্চলের তাল আল-সুলতান এলাকায় টহল দিচ্ছিল। তারা তিনজন সশস্ত্র ব্যক্তি চিহ্নিত করে এবং তাদের সঙ্গে বন্দুকযুদ্ধে জড়িয়ে পড়ে। তাদের সবাই নিহত হয়। সেই সময় সংঘর্ষটি বিশেষ কিছু মনে হয়নি এবং সৈন্যরা গতকাল বৃহস্পতিবার (১৭ অক্টোবর) সকালের আগ পর্যন্ত ঘটনাস্থলে ফিরেও যায়নি।
গতকাল যখন মরদেহ পরীক্ষা করা হচ্ছিল তখন একজনের সাথে হামাসের নেতার অদ্ভুত ধরনের মিল লক্ষ্য করা যায়।
তবে আত্মঘাতী কোনো ফাঁদ থাকার ঝুঁকি বিবেচনায় দেহটি সেখানে রেখেই দেওয়া হয়েছিল। এর পরিবর্তে একটি আঙুলের অংশ কেটে নিয়ে পরীক্ষা করার জন্য ইসরায়েলে পাঠানো হয়। পরবর্তীতে তার দেহ বের করে ইসরায়েলে নিয়ে যাওয়া হয়।
আইডিএফের মুখপাত্র ড্যানিয়েল হ্যাগারি বলেছেন, তার বাহিনী ‘জানতো না তিনি সেখানে ছিলেন, কিন্তু আমরা কাজ চালিয়ে গেছি।’
তিনি বলেন, তার সৈন্যরা তিনজন পুরুষকে বাড়ি বাড়ি ছুটতে দেখেছিল এবং তারা নাগালের বাইরে চলে যাওয়ার আগেই তাদের সাথে সরাসরি যুদ্ধে জড়িয়ে পড়ে।
যিনি পরে সিনওয়ার হিসেবে চিহ্নিত হয়েছেন, ‘তিনি একাই একটি ভবনে দৌড়ে গিয়েছিলেন। সেখানে ড্রোনের মাধ্যমে চিহ্নিত করে হত্যা করা হয়।’
সিনওয়ার যেসব জিম্মিদের মানব ঢাল হিসেবে ব্যবহার করেছিল বলে ধারণা করা হয় তাদের কেউই সেখানে উপস্থিত ছিল না। তার সাথে এতটা ছোট একটা দলের উপস্থিতি থেকে ধারণা করা হচ্ছে হয় তিনি সবার দৃষ্টির অগোচরে চলাফেরার চেষ্টা করছিলেন, অথবা যারা তার সুরক্ষার জন্য ছিল তাদের বেশিরভাগ মানুষকে তিনি হারিয়েছেন।
ইসরায়েলের প্রতিরক্ষা মন্ত্রী ইয়োভ গ্যালান্ট বলেন, ‘সিনওয়ার মারা গেছে যখন তিনি হেরে গেছেন, পালিয়ে বেড়াচ্ছিলেন। তিনি একজন কমান্ডার হিসেবে মারা যাননি, বরং শুধু নিজের চিন্তা করা একজন মানুষ হিসেবে মৃত্যুবরণ করেছেন। এটা আমাদের সব শত্রুর জন্য একটি পরিষ্কার বার্তা।’
বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় সিনওয়ার হত্যার শেষ মুহূর্তগুলো ইসরায়েলের প্রকাশ করা ড্রোনের ফুটেজে দেখা গেছে।
ড্রোনটি একটি বিধ্বস্ত ভবনের দ্বিতীয় তলার খোলা জানালা দিয়ে উড়ে ভেতরে ঢুকে যায়। ভেতরে কিছুদূর গিয়ে থেমে যায়। সেখানে মাথা ও মুখমণ্ডল ঢাকা একজন ব্যক্তিকে ধ্বংসস্তূপের মাঝে পড়ে থাকা একটি সোফায় বসে থাকতে দেখা যায়। সোফাগুলোও ধুলায় ধূসর বর্ণ ধারণ করেছিল। ড্রোনের কারণেও কিছুটা ধুলা উড়ছিল।
মুখমণ্ডল ঢাকা যে ব্যক্তিকে সিনওয়ার হিসেবে উল্লেখ করা হচ্ছে তাকে দেখে আহত মনে হচ্ছিল। তার হাতে লাঠির মতো একটা কিছু দেখা যায় যেটা তিনি ড্রোনের দিকে ছুড়ে মারেন। এরপর ভিডিওটি শেষ হয়।
সিনওয়ারকে ‘নির্মূলের’ ঘোষণা
ইসরায়েল বৃহস্পতিবার প্রথমে ঘোষণা করে যে সিনওয়ার স্থানীয় সময় বিকেলবেলায় গাজায় নিহত হয়েছে কি না সে সম্ভাবনার তদন্ত করা হচ্ছে। এই ঘোষণার কয়েক মিনিটের মধ্যে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে পোস্ট করা ছবিতে একজন পুরুষের মৃতদেহের ছবি দেখা যায় সাথে হামাসের নেতার সাথে খুব মিল রয়েছে। তার মাথায় গুরুতর আঘাত ছিল এবং ছবিটি এতটা ভয়াবহ যে তা প্রকাশের উপযোগী না।
তবে কর্মকর্তারা সে সময় সতর্ক করেন যে নিহত তিনজনের মধ্যে কারও পরিচয় পুরোপুরি নিশ্চিত করা সম্ভব নয়।
এরপর খুব বেশি সময় না যেতেই ইসরায়েলি সূত্রগুলি বিবিসিকে জানায়, তারা সিনওয়ারকে হত্যা করেছে সে বিষয়ে তাদের ‘আত্মবিশ্বাস বাড়ছে’। যদিও তারা বলেছিল যে মৃত্যু নিশ্চিত করার আগে সমস্ত প্রয়োজনীয় পরীক্ষা-নিরীক্ষা করা দরকার।
পরীক্ষাগুলো করতে দীর্ঘ সময় লাগেনি। বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় ইসরায়েল সিনওয়ারকে ‘নির্মূল’ করার তথ্য নিশ্চিত করে।
ইসরায়েলি প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু বলেন, ‘অশুভ শক্তি’ একটি ‘আঘাতের সম্মুখীন’ হয়েছে, যদিও গাজার যুদ্ধ শেষ হয়নি বলে সতর্কও করেন তিনি।
‘চাপে ছিলেন’ সিনওয়ার
সিনওয়ার এক বছরেরও বেশি সময় ধরে পালিয়ে ছিলেন। তিনি সন্দেহাতীতভাবে ইসরায়েলি চাপ বেড়ে যাওয়ার বিষয়টি ধরতে পেরেছিলেন। বিশেষত যখন মোহাম্মদ দায়েফ ও ইসমাইল হানিয়ের মতো অন্য হামাস নেতাদের হত্যা এবং ৭ অক্টোবরের ঘটনার জন্য যে অবকাঠামো ব্যবহার করা হয়েছিল সেগুলো ধ্বংস করা হয়েছিল।
একটি বিবৃতিতে আইডিএফ বলেছে, দক্ষিণে সাম্প্রতিক সপ্তাহগুলিতে ‘আমাদের অভিযান ইয়াহিয়া সিনওয়ারের গতিপথ সীমিত করে ফেলেছিল। যেহেতু তাকে তাড়া করা হচ্ছিল এবং এর ফলশ্রুতিতে তাকে নির্মূল করা হয়েছে।’
সিনওয়ার প্রধান লক্ষ্য, কিন্তু শেষ নয়
সিনওয়ারকে হত্যা করা ইসরায়েলের একটি বড় উদ্দেশ্য ছিল, হামাসের ৭ অক্টোবরের হামলা থেকে যেটির শুরু। তবে তার মৃত্যুতে গাজার যুদ্ধ শেষ হবে না।
আজ শুক্রবার (১৮ অক্টোবর) হামাসের রাজনৈতিক ব্যুরোর সদস্য বাসেম নায়েম এক বিবৃতিতে বলেন, ‘মনে হচ্ছে ইসরায়েল বিশ্বাস করে আমাদের নেতাকে হত্যা করলেই আমাদের আন্দোলন কিংবা ফিলিস্তিনের মানুষের সংগ্রাম থেমে যাবে। কিন্তু সেটি শেষ করা যাবে না ‘
সিনওয়ারের নাম উল্লেখ কিংবা কিংবা তার মৃত্যুর বিষয়টি নিশ্চিত না করে নায়েম বলেন, প্রিয়জন হারানোটা খুবই বেদনাদায়ক।
নেতানিয়াহু বলছেন যে তিনি ‘প্রতিশোধ নিয়েছেন,’ যদিও তিনি জোর দিয়ে বলছেন যে হামাসের হাতে বন্দি কমপক্ষে ১০১ জিম্মির জীবন রক্ষার আগ পর্যন্ত যুদ্ধ অব্যাহত থাকবে।
‘প্রিয় বন্দি পরিবারগুলোর জন্য, আমি বলছি: এটি যুদ্ধের একটি গুরুত্বপূর্ণ মুহূর্ত। আমরা সকলের, আমাদের প্রিয়জনদের বাড়িতে ফিরিয়ে আনতে সম্পূর্ণ শক্তিতে লড়াই চালিয়ে যাবো,’ বলেন তিনি।
বন্দিদের পরিবারগুলো বলছে যে তারা আশা করছে একটা যুদ্ধবিরতিতে এখন পৌঁছানো যাবে যাতে করে বন্দিদের বাড়িতে ফিরিয়ে আনা যায়।-বিবিসি বাংলা