স্বৈরশাসনের মহাপতন, সিরিয়ার সামনে কঠিন পথ

অরুন্ধতী সুরঞ্জনা
প্রকাশ: ১২ ডিসেম্বর ২০২৪, ১০:৩২

বাশার যুগের যবনিকাপাত। ছবি: সংগৃহীত
মহাপতন। বাশার যুগের যবনিকাপাত। বৃহদার্থে বাশার আল আসাদ পরিবারেরও অবসান। নতুন করে শাণিত সশস্ত্র আন্দোলনে ১২ দিনেই সিরিয়ার শাসনকাঠি নিজেদের নিয়ন্ত্রণে নিয়েছে বিদ্রোহীরা। ৮ নভেম্বর পদত্যাগ করে দেশ ছেড়ে পালাতে বাধ্য হয়েছেন প্রেসিডেন্ট বাশার আল আসাদ। সিরিয়ার রাজধানী দামেস্ক থেকে রাশিয়ার রাজধানী মস্কোয় গেছেন তিনি। তাকে রাজনৈতিক আশ্রয় দিয়েছে রাশিয়া। বিদ্রোহী নেতা আবু মোহাম্মদ আল জোলানি দামেস্কে সশরীরে উপস্থিত হয়ে বলেছেন, ‘স্বৈরতন্ত্র হটিয়ে স্বাধীন হলো সিরিয়া। এই দেশের ভবিষ্যৎ এখন আমাদের হাতেই।’
প্রারম্ভে প্রভূত প্রশ্নের উদয় হয়। প্রত্যাশা ও প্রতিবন্ধকতা জেগে ওঠে একসঙ্গে। অটল আত্মবিশ্বাস যেমন থাকে, সঙ্গে উপেক্ষা করা যায় না এমন উদ্বেগও। সিরিয়া পড়েছে সেই দশায়। স্বৈরশাসনের পতন হয়েছে। নতুন ভোরের দেখা পেয়েছে জনতা। এত দিনের যন্ত্রণাদায়ী রাষ্ট্রযন্ত্র ভেঙে পড়েছে, পালিয়ে গেছেন জোরজবরদস্তি গদি আঁকড়ে থাকা শাসক আসাদ। নতুন করে দেশকে সাজানো ও সামনে বাড়ার সুযোগ অবারিত হয়েছে। কিন্তু গদি নড়িয়ে দেওয়া আর গদিতে আসীন হয়ে দেশ চালনা এক জিনিস নয়। এখন সিরিয়া চালাবে কে, কীভাবে- এই প্রশ্নই বড় হয়ে দেখা দিয়েছে।
মিডল ইস্ট আইকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে বাশারবিরোধীদের জোটের প্রধান হাদি আল বাহরা বলেছেন, সিরিয়ায় এখন অন্তর্বর্তী সরকার গঠন করার প্রচেষ্টায় জোর দেওয়া হচ্ছে। সাধারণ নির্বাচন দিতে এই সরকার কমপক্ষে ১৮ মাস সময় নেবে। নির্বাচন না হওয়া পর্যন্ত এই সরকারই দেশ পরিচালনার দায়িত্ব পালন করবে। এর আগে বাশারের আমলের প্রধানমন্ত্রী মোহাম্মদ গাজি আল জালালি জানিয়েছেন, নতুন সরকারের হাতে ক্ষমতা অর্পণের আগ পর্যন্ত তিনি দায়িত্ব পালন করবেন। তাকে সেই পর্যন্ত সময় দেওয়ার ব্যাপারে সম্মতি প্রকাশ করেছেন বিদ্রোহী নেতা জোলানি, যিনি হায়াত তাহরির আল শামের (এইচটিএস) প্রধান নেতা। জঙ্গিগোষ্ঠী ইসলামিক স্টেট (আইএস) ও আল-কায়েদার সঙ্গে এই বিদ্রোহী গোষ্ঠীর সম্পর্ক ছিল (এবং এখনো রয়েছে বলে অনেকের সন্দেহ)। ফলে সিরিয়ার ভবিষ্যৎ নিয়ে গণতান্ত্রিক বিশ্ব বিশেষ করে যুক্তরাষ্ট্র এবং এর পশ্চিমা ও মধ্যপ্রাচ্যের মিত্ররা উদ্বেগে রয়েছে। সিরিয়ায় অন্তর্ভুক্তিমূলক সরকার দেখতে চায় বলে জানিয়েছে তুরস্ক।
সিরিয়া ২০১১ সাল থেকে গৃহযুদ্ধে জর্জরিত। কিন্তু মাত্র ১২ দিনের ‘আচমকা ঝোড়ো হাওয়া’য় জোলানির নেতৃত্বে বিদ্রোহীরা সিরিয়ার গুরুত্বপূর্ণ বড় শহরগুলো নিয়ন্ত্রণে নিয়ে ৮ ডিসেম্বর রাজধানী দামেস্ক পর্যন্ত পৌঁছে যায়। ২৪ বছর পর পতন হয় আসাদের শাসনের। তিনি পদত্যাগ করে দেশত্যাগ করেন। ওই দিনই রাশিয়া জানায়, তিনি দামেস্ক থেকে মস্কোয় পৌঁছেছেন। তাকে রাশিয়া রাজনৈতিক আশ্রয় দিয়েছে। রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন তাকে ব্যক্তিগতভাবে মানবিক কারণে এই আশ্রয় দিচ্ছেন বলে দেশটির রাষ্ট্রীয় গণমাধ্যমে বলা হয়।
আসাদের আগে তার বাবা হাফিজ আল আসাদ মৃত্যুর আগ অব্দি টানা প্রায় ৩০ বছর সিরিয়া শাসন করেন। বাশারকে গত দুই যুগে সহযোগিতা করেছে রাশিয়া ও ইরান। বাশারের পতনকে পুতিন ও রাশিয়ার জন্য ‘মর্যাদার প্রশ্ন’ বলে মন্তব্য করেছে বিবিসি। ইরানও বড় সংকটে পড়েছে, কারণ এরই মধ্যে দেশটির আঞ্চলিক প্রধান শত্রু ইসরায়েল দাবি করেছে, বাশারের পতনে তাদের ভূমিকা ছিল অগ্রগণ্য। আবার বাশার দেশ ছেড়ে পালিয়ে যাওয়ার দিনেই সীমান্ত অতিক্রম করে সিরিয়ার ভূখণ্ডে ইসরায়েলি সেনা ট্যাংক ঢুকে পড়ে। পাশাপাশি ইসরায়েলের প্রধান মিত্র যুক্তরাষ্ট্র সিরিয়ায় আইএসের অনেক স্থাপনায় হামলার দাবি করেছে। তবে তেহরান দাবি করেছে, সিরিয়ার এই নতুন অধ্যায়ের নেতৃত্ব দেওয়া বিদ্রোহীদের সঙ্গে ইরান যোগাযোগ স্থাপন করেছে। দুই দেশের সম্পর্ক ভালো রাখার স্বার্থে নতুন সরকারের সঙ্গে তারা কাজ করতে আগ্রহী।
বাশারের পতনের পর সাধারণ জনতা বলেছে, ২০১১ সালে আরব বসন্তের সময় মানুষ যে স্বপ্ন দেখেছিল, তা পুনরুজ্জীবিত হয়েছে। তারা রাস্তায় নেমে উচ্ছ্বাস প্রকাশ করছে। স্থানীয় একজন বিবিসিকে বলেছেন, ‘প্রথমবারের মতো, প্রকৃত স্বাধীনতার অনুভূতি এসেছে আমাদের জীবনে। এটি এমন এক অনুভূতি, যা আমরা আগে কখনো পাইনি এবং এটি আমাদের অবাক করছে।’ ইউরোপিয়ান কমিশনের প্রেসিডেন্ট উরসুলা ভন ডার লিয়েন বলেছেন, বাশারের জঘন্য স্বৈরতন্ত্রের পতনের মধ্য দিয়ে সিরিয়ায় সুযোগ তৈরি হবে। তবে সম্ভাব্য ঝুঁকির কথাও তিনি মনে করিয়ে দিয়েছেন। একদিকে সিরিয়া ও মধ্যপ্রাচ্যে নতুন করে জঙ্গিবাদের উত্থানের আশঙ্কা; অন্যদিকে বিদ্রোহীদের মধ্যে মতের অমিলের কারণে সিরিয়ায় গৃহযুদ্ধের অবসান আরো পিছিয়ে যেতে পারে বলে সংশয় প্রকাশ করেছেন। এদিকে ১৯৭৪ সালের পর প্রথমবারের মতো সীমানা অতিক্রম করে সিরিয়ার ভূখণ্ডে ঢুকে পড়েছে ইসরায়েলি সেনাবাহিনীর ট্যাংক। এতে আঞ্চলিক উত্তেজনা বাড়ার আশঙ্কা করা হচ্ছে।
২০১১ সালের মার্চে বাশারবিরোধী ব্যাপক গণবিক্ষোভের মধ্য দিয়ে সিরিয়ায় অস্থিতিশীলতার শুরু। এরপর সেখানে যুক্ত হয়েছে সশস্ত্র একাধিক বিদ্রোহী গোষ্ঠী। পরবর্তী সময়ে সেসব বিদ্রোহ কঠোর হাতে দমন করে রাজধানীর নিয়ন্ত্রণ ধরে রাখেন বাশার। সব কিছুর শেষ থাকে। বাশারের ক্ষেত্রে মহাপতন ঘটল। তবে সিরিয়া এখনো একটি বিভক্ত দেশ, বছরের পর বছর ধরে চলা গৃহযুদ্ধের গভীর ক্ষত এখনো দগদগে।