
ফিলিস্তিনের কিশোরী আহমেদ তামিমি। ছবি: সংগৃহীত
ফিলিস্তিনি তরুণদের সঙ্গে বিশ্বের অন্যান্য দেশের তরুণদের ব্যাপক পার্থক্য আছে। কারণ তাদের জীবনটাই শুরু মাতৃভূমির জন্য লড়াই করতে করতে। তারা জন্মের পর বোমার শব্দে কেঁদে ওঠে। অথচ দিন দিন এই বোমার শব্দ তাদের খুব স্বাভাবিক ব্যাপার হয়ে ওঠে। আর বাস করে পৃথিবীর সবচেয়ে বৃহত্তম উন্মুক্ত জেলখানায়। সেখানে কারো চোখে ঘুম নেই, পেটে খাবার নেই, স্কুল নেই। নেই মাথা গোঁজার কোনো ঠাঁই। তবুও ফিলিস্তিনের তরুণরা বুক চেতিয়ে লড়াই করে প্রিয় পতাকাকে বুকে জড়িয়ে।
২০২২ সালের ৩১ ডিসেম্বরের ঘটনা। সেদিন বেতিনে বিদ্যালয় থেকে বাড়ি ফেরার পথে ১৪ বছর বয়সী স্কুলে পড়া মালাক আল খতিবকে ইসরায়েলি বাহিনী ধরে নিয়ে যায়। কারণ দিনের পর দিন অত্যাচার দেখে সে ফুঁসে উঠেছিল। তাই ইসরায়েলের সশস্ত্র সেনাদের ওপর বাধ্য হয়ে পাথর ছুড়ে হামলা করেছিল। তাকে দুই বছরের কারাদণ্ড ও দেড় হাজার ডলার জরিমানা করা হয়। কারাবন্দি এই কিশোরী পুরো ফিলিস্তিনের প্রতীক।
রামাল্লার কাছে বেতিন শহরে কিশোরী মালাকের জন্ম ও বেড়ে ওঠা। মালাকের মা খাওলা আল-খতিব সংবাদমাধ্যমকে বলেছিলেন, ‘১৪ বছরের মালাককে ডাণ্ডাবেড়ি পরিয়ে আদালতে হাজির করা হয়। এ দৃশ্য দেখে আমি নিজেকে সামলাতে পারিনি। কষ্টে বুকটা ফেটে গেছে। শীতের মধ্যেও তার গায়ে শীতের কাপড় ছিল না। আমি তার জন্য শীতের কাপড় নিয়ে গিয়েছিলাম। কিন্তু বিচারক এগুলো দিতে অনুমতি দেননি।’
ফিলিস্তিনের আরেক কিশোরী আহমেদ তামিমি। ইসরায়েলের কারাগারে বন্দিজীবন কাটাচ্ছে কোঁকড়া চুলের এই কিশোরী। সোশ্যাল মিডিয়ায় ছড়িয়ে পড়েছিল এই কিশোরীর একটি ভিডিও। সেখানে দেখা যায়, তামিমি দখলদার ইসরায়েলি সেনাদের দিকে তাকিয়ে আছে। তার চোখে ক্রোধের আগুন। ইসরায়েলি সেনারা তাকে সরে যেতে বললে সে সরেনি। তখন দুই সেনা তাকে ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করে। সে তখন ইসরায়েলি সেনার দুই গালে সজোরে থাপ্পড় মারতে শুরু করে। ১৬ বছরের তামিমির সেই ভিডিওতে ফিলিস্তিনিদের সাহস দেখেছিল বিশ্বের মানুষ। সেদিন তামিমি ও তার মাকে গ্রেপ্তার করে নিয়ে যায় ইসরায়েলি বাহিনী। পরে রিমান্ডে নিয়ে অত্যাচার করা হয়। তবুও মা ও মাতৃভূমিকে রক্ষায় কোনো আপস করেনি সে।
এর আগেও ইসরায়েলি সেনাদের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানিয়েছিল তামিমি। ২০১২ সালে ইসরায়েলি সেনার কাছ থেকে চাচাতো ভাইকে বাঁচানোর চেষ্টা করেছিল তামিমি। তখন তার বয়স ছিল মাত্র ১১ বছর। সে এক হাতে কামড় পর্যন্ত দিয়েছিল। এ জন্য তামিমিকে তুরস্কে ‘হানদালা সাহসিকতা পুরস্কার’ দেওয়া হয়।
মালাক ও তামিমির মতোই আরেকজন উইসেল শেখ খালিল। ভালো অঙ্ক করতে পারত, নাচেও বেশ দক্ষ ছিল। একদিন শান্ত স্বভাবের শেখ খালিল রাগে ফুঁসে উঠল। পরিবারের সবার চোখ ফাঁকি দিয়ে ১১ বছরের ছোট ভাইকে নিয়ে বিক্ষোভ শুরু করে। ইসরায়েলি সেনাদের গুলি ও কাঁদানে গ্যাস উপেক্ষা করে পৌঁছে যায় সীমান্তের কাছাকাছি। সেনাদের বর্বরতা দেখে ইসরায়েলের কাঁটাতারের বেড়া কেটে ফেলতে চেষ্টা করে। শেষ পর্যন্ত স্নাইপারের গুলিতে শহীদ হয় শেখ খালিল।
মানবাধিকার সংগঠন ডিফেন্স ফর চিলড্রেন ইন্টারন্যাশনাল প্যালেস্টাইনের (ডিসিআই প্যালেস্টাইন) হিসাব মতে, পাথর ছুড়ে মারার অভিযোগে প্রতি বছর পশ্চিম তীর থেকে ইসরায়েলি বাহিনী গড়ে হাজার খানেক শিশু-কিশোরকে আটক করে। ইসরায়েলের কারাগারে এখনো দুই শতাধিক ফিলিস্তিনি শিশু, কিশোর-কিশোরী বন্দি। ইসরায়েলে ১২ বছরের কম বয়সীদের শিশু বলা হয়। ফলে বিচার করার সময় মালাক শিশু হিসেবে বিবেচিত হয়নি। যদিও ইউনিসেফের হিসাবে, ১৮ বছর পর্যন্ত ছেলে বা মেয়ে শিশুর মর্যাদা পায়। অবশ্য ইসরায়েল এসব নিয়মের তোয়াক্কা করে না।
সেভ দ্য চিলড্রেনের ২০২২ সালের এক প্রতিবেদন অনুসারে, গাজায় প্রতি পাঁচজন শিশু-কিশোরের মধ্যে চারজনই বিষণ্ণতা ও ভয়ের মধ্যে বাস করছে। এখানকার অর্ধেকের বেশি শিশু-কিশোর আত্মহত্যার কথা ভাবে ও অন্য শিশুদের মৃত্যুর সাক্ষী হওয়ার ট্রমা নিয়ে বেঁচে থাকে। আর এই বেঁচে থাকার সংগ্রাম দেখে দেখে তারাও হয়ে ওঠে বোমার মতো শক্তিশালী। তাই ফিলিস্তিনি তারুণ্য মৃত্যুকে ভয় না পেয়ে গুলতি বা পাথর হাতে দাঁড়িয়ে যায় ট্যাংকের সামনে।
এভাবে ইসরায়েলের কিশোর-তরুণরা ইসরায়েলি বর্বরতার বিরুদ্ধে লড়াই করে আসছে। তাদের হাতে কোনো অস্ত্র নেই, তবে বুকে আছে দেশের প্রতি ভালোবাসা। কিন্তু কেউ জানে না, কবে তাদের এই লড়াই শেষ হবে। কবে দখলদার মুক্ত হবে স্বাধীন ফিলিস্তিন।