মার্কিন কমান্ডো অভিযানে নিহত কে এই আইএস নেতা?

ডেস্ক রিপোর্ট
প্রকাশ: ০৫ ফেব্রুয়ারি ২০২২, ১৪:৫২
আবু ইব্রাহিম আল-হাশিমি আল-কুরাইশি
সিরিয়ার ইদলিব প্রদেশে যুক্তরাষ্ট্রের বিশেষ বাহিনীর এক রাতভর অভিযানে ইসলামিক স্টেট (আইএস) নেতা আবু ইব্রাহিম আল-হাশিমি আল-কুরাইশি নিহত হয়েছেন বলে ঘোষণা করেছেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন।
আইএসের এই নেতা সম্পর্কে কী জানা যায়? তুরস্ক সীমান্তের কাছে আতমেহ এলাকায় একটি বাড়িতে সপরিবারে লুকিয়ে ছিলেন আল-কুরাইশি। গত বৃহস্পতিবার (৩ ফেব্রুয়ারি) রাতে মার্কিন কমান্ডোরা হেলিকপ্টারে করে এসে বাড়িটির ওপর হামলা চালালে তিনি বোমার বিস্ফোরণ ঘটান। এতে তিনি নিজে ও তার পরিবার সদস্যসহ ১৩ জন নিহত হন।
এই হামলার পরিকল্পনা হয়েছিল কয়েক মাস ধরে। প্রেসিডেন্ট বাইডেন অভিযান পরিচালনার চূড়ান্ত নির্দেশ দেবার পর হামলা শুরু হলে বাইডেন হোয়াইট হাউসে বসে তা সরাসরি দেখছিলেন।
আল-কুরাইশিকে বহুদিন ধরেই আইএসের ভবিষ্যৎ নেতা হিসেবে গড়ে তোলা হয়েছিল। তাকে একজন রহস্যময় লোক বলে মনে করা হতো এবং তাকে প্রকাশ্যে প্রায় দেখাই যেতো না। ইসলামিক স্টেট গোষ্ঠীর ভেতরে আল-কুরাইশিকে ডাকা হতো ‘হাজী আবদুল্লাহ কারদাশ’ বা ‘হাজি আবদুল্লাহ’ নামে।
কুরাইশিকে নিয়ে একটি তথ্যবহুল ভিডিও প্রতিবেদন তৈরি করেছেন বিবিসির আরবি বিভাগের ফেরাস কিলানি। তিনি ইরাকের বিভিন্ন জায়গায় ঘুরে অনেকের সঙ্গে কথা বলে আল-কুরাইশি সম্পর্কে বিস্তারিত তথ্য সংগ্রহ করেছেন।
আল-কুরাইশির জন্ম ১৯৭৬ সালে, ইরাকের দ্বিতীয় বৃহত্তম শহর মসুল থেকে ৩৫ কিলোমিটার দূরের আল-মেহালাবিয়ায়।
ইরাক সরকারের কাউন্টার-টেররিজম ইউনিটের নাম হচ্ছে ফ্যালকন ব্রিগেড। ইসলামিক স্টেটের ভেতরে নিজেদের গুপ্তচরদের ঢুকিয়ে দেবার কাজে এই ফ্যালকন ব্রিগেড ছিল সিদ্ধহস্ত। এর ফলে ইসলামী উগ্রপন্থীদের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে তাদের ভূমিকা ছিল অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। তাদের একজন এজেন্ট হচ্ছেন মেজর আহমেদ। এটা তার আসল নাম নয়, পরিচয় গোপন রাখার জন্য তাকে এই ছদ্মনাম দেয়া হয়েছে।
ইসলামিক স্টেটের সবশেষ নেতা সম্পর্কে বিস্তারিত জানেন এই মেজর আহমেদ। তিনি বলেন, হাজী আবদুল্লাহ বা আল-কুরাইশির আসল নাম আমির মোহাম্মদ সাঈদ আল-মওলা। আমির মোহাম্মদ সাঈদ আল-মওলার জন্ম আল-মেহালাবিয়ায়, তার বাবা সেখানকার একটি মসজিদের মুয়াজ্জিন ছিলেন। তার ছিল দুই স্ত্রী ও ১৭টি সন্তান।
তিনি আরও বলেন, বড় পরিবার ছিল তাদের ও স্থানীয় লোকেরা এখনো তাদের মনে রেখেছেন। কারণ তারা শিক্ষিত ছিল, লোকে তাদের সম্মান করতো। কিন্তু তা সত্ত্বেও আল-কুরাইশি স্থানীয় কিছু গোষ্ঠীর মাধ্যমে উগ্রপন্থায় দীক্ষিত হন।
এই আল-মেহলাবিয়া, তাল আবতা ও আল-হাজার এই তিনটি প্রত্যন্ত এলাকা মিলে একটা দ্বীপের মতো তৈরি হছে। এখানেই ২০০৩ সালের মার্কিন অভিযানের পর ইরাকী আল-কায়দার জন্ম হয়েছিল। তাদের এখানে বেশ বড় সমর্থনও ছিল। ইসলামিক স্টেটের সামরিক ও নিরাপত্তা বিষয়ক নেতাদের বেশির ভাগই এই এলাকাগুলো থেকে আসা- বিশেষ করে নিকটবর্তী তাল-আফার থেকে।
সাদ্দাম হোসেনের শাসনকালে আল-কুরাইশি কিছুকাল ইরাকের সেনাবাহিনীতে ছিলেন বলে জানা যায়। তাছাড়া তিনি মসুলের বিশ্ববিদ্যালয়েও ইসলাম বিষয়ে উচ্চশিক্ষা নিয়েছেন। মার্কিন নেতৃত্বাধীন বাহিনী যখন ২০০৩ সালে ইরাকে অভিযান চালায় তখনই আল-কুরাইশি ছোট ছোট কিছু জিহাদি গোষ্ঠীর সঙ্গে জড়িত ছিলেন। কিন্তু পরে তিনি এসব গোষ্ঠী ছেড়ে দিয়ে আল-কায়েদায় যোগ দেন।
মার্কিন অভিযানে ইরাকি শাসক সাদ্দাম হোসেন উৎখাত হবার কিছুকালের মধ্যেই দেশটিতে শুরু হয় ব্যাপক সহিংসতা। আর তখন হাজি আবদুল্লাহ তার ধর্মীয় শিক্ষা ও উগ্রপন্থী গোষ্ঠীগুলোর সঙ্গে দীর্ঘদিন ধরে জড়িত থাকার অভিজ্ঞতার কারণে খুব তাড়াতাড়িই একজন নেতৃস্থানীয় সদস্যে পরিণত হন।
এক পর্যায়ে ২০০৮ সালে তাকে গ্রেফতার করা হয় এবং তাকে পুকা কারাগারে আটকে রাখে। সেখানে মার্কিন সৈন্যরা কয়েক মাস ধরে আল-কুরাইশিকে জিজ্ঞাসাবাদ করে। তারা দাবি করেন, আল-কুরাইশি তাদেরকে আইএস সদস্যদের সম্পর্কে অনেক তথ্য দিয়েছিলেন।
২০১০ সালের শুরুতে আল-কুরাইশিকে ছেড়ে দেয়া হয়। এর অল্প কিছুদিনের মধ্যেই তিনি ইসলামিক স্টেটের প্রতিষ্ঠাতা নেতা আবু বকর আল-বাগদাদির সঙ্গে যোগ দেন। আল-বাগদাদির ঘনিষ্ঠজন হিসেবে তিনি নিনেভেহ প্রদেশে আইএসের একজন উর্ধ্বতন কর্মকর্তায় পরিণত হন।
আইএসের এক সিনিয়র নেতা বিবিসির আরবি বিভাগকে দেয়া এক সাক্ষাতকারে বলেছেন, তার সঙ্গে আল-কুরাইশি বা হাজি আবদুল্লাহর বেশ কয়েকবার সাক্ষাৎ হয়েছে। এই নেতাটির নাম বিবিসির আরবি বিভাগ প্রকাশ করেনি, কারণ আইএসের নেতৃত্ব এখনো জানে না যে তিনি বন্দি আছেন।
তিনি বলেন, কিছু কিছু বিষয়ে হাজি আবদুল্লাহ অত্যন্ত উগ্রপন্থী ও তিনি তার ঘনিষ্ঠ কয়েকজন ছাড়া আর কাউকে বিশ্বাস করেন না। আমি লক্ষ্য করেছিলাম যে হাজি আবদুল্লাহ ঠিক মেধাবী লোক নন এবং আল-বাগদাদির মতো বক্তৃতা দেবার ক্ষমতাও তার নেই। আল-বাগদাদি হাতে কোনও কাগজ না রেখেই বক্তৃতা দিতে পারতেন কিন্তু হাজি আবদুল্লাহ এটা পারবে বলে আমার মনে হয় না।
আইএসের উচ্চাভিলাষ বাড়তে থাকার সাথে সাথে আল-কুরাইশি বিচার মন্ত্রীর দায়িত্ব পান। তার দায়িত্ব ছিল মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা এবং লোকজনকে নিষ্ঠুর-বীভৎস পন্থায় শাস্তি দেয়ার কাজ তত্ত্বাবধান করা।
আইএস যখন ২০১৪ সালে সিঞ্জার শহরে ঢুকলো, তখন আল-কুরাইশির নিষ্ঠুরতা ও তিনি যে কত প্রভাবশালী তা স্পষ্ট হয়। সেখানে তারা ইয়াজিদি সংখ্যালঘু গোষ্ঠীর হাজার হাজার লোককে হত্যা করে। তবে ইয়াজিদি নারীদের নিয়ে কি করা হবে - এ প্রশ্নে আইএসের মধ্যে মতপার্থক্য দেখা দেয়।
ইসলামিক শরিয়া আইনকে তারা যেভাবে ব্যাখ্যা করে - সে অনুযায়ী তাদের কিছু নেতা চাইছিল - ইয়াজিদি মেয়েদের ক্রীতদাসীতে পরিণত করা হোক।
সেসময় আবু বকর আল-বাগদাদির একজন সহচর ছিলেন সালেম আল-জুবুরি, যিনি এখন ইরাকের কারাগারে বন্দি। তিনি বলেন, ইয়াজিদি নারীদের বন্দি করার ব্যাপারে একজন শেখ আবু আলি আল-আনবাবির মত ছিল, এটা নিষিদ্ধ করা হোক কারণ এর সুবিধার চাইতে অসুবিধা অনেক বেশি, আর শরিয়া আইন বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে তারা এখনো নতুন। কিন্তু শেখ আবদুল্লাহ ইয়াজিদি নারীদের ক্রীতদাসী করার ওপর জোর দেন। তার বক্তব্য ছিল - এটা যখন ধর্মে বলা আছে তাই তা করতেই হবে, কারণ সুন্নাহকে পুনরুজ্জীবিত করার জন্যই আইএস কাজ করছে।
আইএসের দুটি কমিটি ছিল, একটি ইরাকে আরেকটি সিরিয়ায়। ইরাকি কমিটি ইয়াজিদি নারীদের ক্রীতদাসী করতে অস্বীকার করে, কারণ তারা ইরাকি। তাদের নিজেদের স্ত্রী-পরিবারের ভয়ও তাদের ছিল। তাছাড়া ইরাকিরা খ্রিস্টানদের ক্রীতদাসী করার ব্যাপারটাও গ্রহণ করেনি।
অন্যদিকে সিরিয়ার কমিটি ছিল আল-বাগদাদির অধিকতর ঘনিষ্ঠ, কারণ আল-বাগদাদি তখন রাক্কাতেই থাকতেন। তখন একটা আপোষরফা হলো- সেটা হচ্ছে এই রকম যে শুধু ইয়াজিদি নারীদের ক্রীতদাসী করা হবে, খ্রিস্টানদের নয়।
মানবাধিকার গোষ্ঠীগুলো জানায়, আইএস সেসময় সাত হাজার নারী ও মেয়েশিশুকে ক্রীতদাসী করে।
আল-কুরাইশিকে হত্যার বেশ কিছু চেষ্টা হয়েছিল, তবে তার বেশিরভাগই ব্যর্থ হয়। একটি হামলায় আহত হয়ে তিনি তার একটি পা হারান। এ বিষয়ে
বন্দি আইএস সদস্য সালেম আল-জুবুরি বিবিসিকে জানান, সম্ভবত মার্কিন ড্রোনের হামলায় আল-কুরাইশি আহত হন। হাসপাতালে তার একটি পা কেটে বাদ দেয়া হয় এবং চার মাসেরও বেশি সময় তাকে চিকিৎসা নিতে হয়।
ব্যাপক যুদ্ধের পর ২০১৭ সালে ইরাকের মসুল শহর থেকে আইএসকে উৎখাত করা হয় এবং এখান থেকেই শুরু হয় আইএসের পতনের। আল-বাগদাদি বুঝেছিলেন যে আইএস তার নিয়ন্ত্রিত ভূখণ্ড হারাতে যাচ্ছে, সে কারণে তিনি ইসলামী খিলাফত ঘোষণার আগের যুগে আইএসকে ফিরিয়ে নিয়ে যাবার আদেশ তৈরি করছিলেন।
এরপর ২০১৭ সালের অক্টোবর মাসে আল-বাগদাদি ও আল-কুরাইশি সিরিয়ার আল-বুকামাল শহরে চলে আসেন। এখানেও তাদের ওপর একটি বিমান হামলা হয়, যা থেকে অল্পের জন্য প্রাণে বেঁচে যান তারা। এরপর আল-কুরাইশিকে প্রথম হাসপাতালে ও পরে ইদলিবে পাঠিয়ে দেয়া হয়। অব্যাহত হামলার ঝুঁকির মধ্যে আইএসের নেতারা শেষ পর্যন্ত আশ্রয় নেয় সিরিয়ার ছোট শহর বাঘুজে।
এখানেই ২০১৯ সালে সমাপ্তি ঘটে ইসলামিক স্টেটের খিলাফতের। হাজার হাজার যোদ্ধা ও তাদের পরিবার আত্মসমর্পণ করে।
কয়েক মাস পর উত্তর সিরিয়ার ইদলিবে আল-বাগদাদি তার গোপন বাসভবনে অন্য কয়েকজন নেতার সাথে বৈঠক করছেন এমন একটি ভিডিও বেরোয়। আল-বাগদাদি ছাড়া ভিডিওতে অন্য নেতাদের মুখ আইএস নিজেই ঝাপসা করে দেয়। তবে মনে করা হয় যে উপস্থিত এই নেতাদের মধ্যে আল-কুরাইশি একজন। এই সময়টায় তাকে সম্ভাব্য পরবর্তী নেতা হিসেবে গড়ে তোলা হচ্ছিল।
অবশেষে ২০১৯ সালে সেই অবধারিত ঘটনাটি ঘটে, মার্কিন এক হামলায় আবু-বকর আল-বাগদাদি নিহত হন। এর ফলে হাজি আবদুল্লাহ ওরফে আবু ইব্রাহিম আল-হাশিমি আল-কুরাইশির আইএস নেতা হবার পথ খুলে যায়।
ইদলিবের যে এলাকাটিতে আল-কুরাইশি তার পরিবার নিয়ে থাকতেন সেটি একটি দরিদ্র এলাকা, যেখানকার বেশির ভাগ বাসিন্দাই সিরিয়ার অন্য এলাকা থেকে গৃহযুদ্ধের কারণে পালিয়ে এসেছেন। জলপাইয়ের গাছে ঘেরা একটি অতিসাধারণ ভবনের চারতলায় থাকতেন আল-কুরাইশি ।
প্রায় ১১ মাস আগে এই বাড়িটির তিন তলায় ভাড়াটি হিসেবে থাকতে আসেন একজন ট্রাক চালক ও তার পরিবার। গত বছরের শেষ দিকে যুক্তরাষ্ট্র গোপনসূত্রে খবর পায় যে আল-কুরাইশি এই বাড়িটির ওপর তলায় থাকছেন।
বিবিসির বিশ্লেষক গর্ডন কোরেরা বলছেন, আইএস বা আল-কায়েদা সংশ্লিষ্ট লক্ষ্যবস্তুর ক্ষেত্রে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র প্রায়ই ড্রোন ব্যবহার করে। শুধু মাত্র হাই-ভ্যালু লক্ষ্যবস্তুর ক্ষেত্রে, কাউকে জীবিত ধরতে চাইলে বা ঘটনাস্থল থেকে গুরুত্বপূর্ণ গোয়েন্দা তথ্য সংগ্রহ করতে চাইলেই মাটিতে কমান্ডো নামিয়ে আক্রমণের পরিকল্পনা হয়ে থাকে - যেটা করা হয়েছিল ওসামা বিন লাদেন বা আল-বাগদাদির ক্ষেত্রে। কারণ এধরনের অভিযানে ঝুঁকি অনেক বেশি।
তবে আল-কুরাইশির নেতৃত্বে আইএস ইরাক ও সিরিয়ায় পুনরায় সংগঠিত হয়ে শক্তি বৃদ্ধির চেষ্টা করছে - সাম্প্রতিক কিছু ঘটনা থেকে এ আভাস যাচ্ছিল। এ প্রেক্ষাপটেই প্রেসিডেন্ট বাইডেন এ আক্রমণের ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নেন, এবং অভিযান চলার সময় তিনি হোয়াইট হাউসে বসে তা সরাসরি দেখছিলেন। -বিবিসি