
ছবি: এএফপি
১১ বছর আগে শুরু হওয়া সিরিয়ার গৃহযুদ্ধ আজও চলছে। সিরিয়ার অর্ধেকেরও বেশি জনগণকে যুদ্ধের কারণে উদ্বাস্তু হতে হয়েছে। এ যুদ্ধে নিহত হয়েছেন কয়েক লাখ মানুষ। এতে বিভিন্ন সময়ে আন্তর্জাতিক বিভিন্ন পক্ষ সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করে। সমরাস্ত্রের ঝনঝনানি এক স্বাভাবিক বাস্তবতায় পরিণত হয়। সবারই লাভ-লোকসান, জয়-পরাজয়ের হিসাব রয়েছে। তবে সব মিলিয়ে এই ১১ বছরের রক্তক্ষয়ী ধ্বংসযজ্ঞে পরাজিত হয়েছে মানবিকতা।
গত ১৫ মার্চ ছিল সিরিয়া যুদ্ধের বছরপূর্তি। ২০১১ সালের এই দিনে দেশটিতে যে সংকটের সূচনা, তার আজও সমাধান হয়নি। ইউক্রেনে রাশিয়ার সামরিক অভিযান নিয়ে যতটা গুরুত্ব দিচ্ছে পশ্চিমা বিশ্ব, তার সিকি ভাগও জোটেনি সিরিয়ার ভাগ্যে।
সিরিয়ায় গৃহযুদ্ধের শুরুটা হয়েছিল তরুণদের প্রতিবাদ ও বিক্ষোভ থেকে। মূলত তারা কর্মসংস্থানের দাবিকে কেন্দ্র করে প্রথম রাস্তায় নেমে পড়েছিলেন। পরে তা রূপ নেয় শাসনকাঠামো বদলের আন্দোলনে। ওই আন্দোলন দমনে ব্যাপক নিপীড়ন শুরু করেন দেশটির প্রেসিডেন্ট বাশার আল আসাদ। রক্তাক্ত হয় রাজপথ। অশান্তি ও সংঘাত ছড়ায় দেশজুড়ে। এরপর দেশটির সংঘাত রূপ নেয় গৃহযুদ্ধে। এতে একে একে জড়িয়ে পড়ে আঞ্চলিক শক্তি থেকে শুরু করে বৈশ্বিক পরাশক্তিগুলো। এক সময়ের সমৃদ্ধ দেশটি পরিণত হয় ধ্বংসস্তূপে। দেখা দেয় ইতিহাসের ভয়াবহতম মানবিক সংকটের।
২০২২ সালের ফেব্রুয়ারিতে জাতিসংঘ জানায়, সিরিয়ায় ১ কোটি ৪৬ লাখের বেশি মানুষের মানবিক সহায়তা প্রয়োজন ছিল। তাদের মধ্যে প্রায় ৫০ লাখ মানুষ চরম সংকটে ভুগছেন। দেশটিতে প্রতিদিন ১ কোটি ২০ লাখের বেশি মানুষ পর্যাপ্ত খাবার পায় না। প্রায় ৫ লাখ সিরীয় শিশু ভয়াবহ অপুষ্টিতে ভুগছে।
জাতিসংঘ আরও জানায়, ২০১১ সালের মার্চ থেকে ২০২১ সালের মার্চ পর্যন্ত এক দশকে যুদ্ধকবলিত সিরিয়ায় সামরিক-বেসামরিক মিলিয়ে নারী, শিশুসহ ৩ লাখ ৫০ হাজারের বেশি মানুষের প্রাণ গেছে। তবে প্রকৃত সংখ্যা এর চেয়ে অনেক বেশি।
যুক্তরাজ্যভিত্তিক মানবাধিকার পর্যবেক্ষক সংস্থা সিরিয়ান অবজারভেটরি ফর হিউম্যান রাইটসের হিসাবে, ২০২১ সালের জুন পর্যন্ত সিরিয়া যুদ্ধে নিহতের সংখ্যা ৪ লাখ ৯৪ হাজার ছাড়িয়ে গেছে। অন্যদিকে মানবাধিকার সংগঠন ভায়োলেশনস ডকুমেন্টেশন সেন্টার বলছে, চলতি বছরের ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত সিরিয়ায় নিহতের এ সংখ্যা ২ লাখ ৩৮ হাজার। এর মধ্যে ১ লাখ ৪৪ হাজারের বেশি বেসামরিক মানুষ।
যুদ্ধ শুরুর আগে সিরিয়ার জনসংখ্যা ছিল ২ কোটি ২০ লাখ। তাদের অর্ধেকের বেশি যুদ্ধের কারণে উদ্বাস্তু হয়েছে। প্রায় ৭০ লাখ মানুষ ঘরবাড়ি হারিয়ে প্রাণ বাঁচাতে সিরিয়ার এক শহর থেকে অন্যত্র চলে গেছেন। প্রায় ২০ লাখ অসহায় মানুষের ঠিকানা হয়েছে বিভিন্ন শরণার্থীশিবির। ন্যূনতম মৌলিক সেবা ছাড়াই তাদের মানবেতর জীবন কাটছে। আরও প্রায় ৬৮ লাখ সিরীয় প্রতিবেশী লেবানন, জর্ডান, তুরস্কসহ বিভিন্ন দেশে আশ্রয় নিয়েছেন। অনেকে শরণার্থী হিসেবে ইউরোপে আশ্রয় নিয়েছেন। এটি ছিল সাম্প্রতিক ইতিহাসে সবচেয়ে বড় শরণার্থী সংকট।
এ মানবিক সংকটের মধ্যেই দেখা দেয় করোনা মহামারি। করোনা মোকাবেলায় সিরিয়ায় মাত্র ৭ দশমিক ৪ শতাংশ মানুষকে দুই ডোজ টিকার আওতায় আনা সম্ভব হয়েছে। এ ছাড়া বাশার আল-আসাদ সরকারের বিরুদ্ধে কঠোর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছে যুক্তরাষ্ট্রসহ পশ্চিমা দেশগুলো। ২০২১ সালে সিরিয়ার মুদ্রার বিনিময় হারে ৮০ শতাংশ পতন দেখা গেছে। চলতি বছরের শুরুতে তা ১৪০ শতাংশে পৌঁছে গেছে। এসব কারণে যুদ্ধবিধ্বস্ত সিরিয়া মানবিক সংকট সামাল দিতে পারছে না।
অস্ত্রের ঝনঝনানির সঙ্গে রয়েছে কথিত শান্তি আলোচনা। তবে শান্তি যে আসন্ন তা বলা যাচ্ছে না। জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদ সিরিয়ায় শান্তি ফেরাতে ২০১২ সালে সই হওয়া জেনেভা সমঝোতা বাস্তবায়নের ওপর জোর দিতে বলেছে। ওই সমঝোতায় দেশটিতে পারস্পরিক সম্মতির ভিত্তিতে একটি অন্তর্বর্তীকালীন শাসনকাঠামো গড়ার কথা বলা হয়েছে।
জাতিসংঘের মধ্যস্থতায় চলছে ধারাবাহিক শান্তি আলোচনা। ৯ ধাপের আলোচনা শেষে কাঙ্ক্ষিত ফলাফল বের করে আনা যায়নি। বাশার আল-আসাদ তার রাজনৈতিক প্রতিপক্ষের সঙ্গে আলোচনায় বসতে, যে কোনো ধরনের সমঝোতায় আসতে নারাজ। কারণ ওই আলোচনার মূলে রয়েছে রাজনীতি ও ক্ষমতা থেকে আসাদের অপসারণ। তবে রাশিয়া, ইরান ও তুরস্ক আলাদাভাবে রাজনৈতিক আলোচনা এগিয়ে নিচ্ছে।
এ দিকে আসাদকে সহায়তার মধ্য দিয়ে মধ্যপ্রাচ্যে নিজের ভিত্তি পোক্ত করছে রাশিয়া। মধ্যপ্রাচ্যে রাশিয়ার সবচেয়ে ঘনিষ্ঠ মিত্র আসাদ। দেশটিতে রাশিয়ার একটি বিমান ও একটি নৌঘাঁটি রয়েছে। সিরিয়ার অন্যান্য গোষ্ঠীর সঙ্গে শান্তি আলোচনায় রাজি হলেও, মধ্যপ্রাচ্যে নিজের সামরিক শক্তি অটুট রাখতে রাশিয়া আসাদকে ক্ষমতায় রাখতে চায়। আসাদকে ক্ষমতায় টিকিয়ে রাখাটা ক্রিমিয়া দখলের পর রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের সবচেয়ে বড় জয় বলে মনে করা হচ্ছে। মধ্যপ্রাচ্যে এ জয়ের পর এবার ইউক্রেন মিশনে রয়েছেন তিনি।
তবে কলাম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক জেফরি ডি স্যাক্স বলেন, ‘মূলত চারটি কারণে মার্কিন নেতৃত্বাধীন জোট আসাদকে উচ্ছেদে ব্যর্থ হয়েছে। প্রথমত, শুধু আলাওয়াতিরাই (আসাদ যে গোত্র থেকে আগত) নয়, সুন্নি ইসলামপন্থীদের উত্থানের আশঙ্কায় সে দেশের খ্রিস্টান ও অন্যান্য সংখ্যালঘু গোষ্ঠীও আসাদকে অকুণ্ঠ সমর্থন দিয়েছে। দ্বিতীয়ত, মার্কিন নেতৃত্বাধীন জোট ইরান ও রাশিয়ার ব্যাপক প্রতিরোধের মুখে পড়েছে। তৃতীয়ত, আইএস থেকে যেসব ছোট ছোট গ্রুপ বিচ্ছিন্ন হয়ে গেছে, তাদের সামাল দিতে আসাদ উৎখাতে নিয়োজিত জোটকে আলাদাভাবে খরচ করতে হয়েছে। সর্বশেষ কারণ হলো- আসাদবিরোধী গোষ্ঠীগুলোর মধ্যে বড় ধরনের কোন্দল রয়েছে। তারা নিজেদের মধ্যে লড়াই করতে গিয়ে আসাদ উৎখাতে সম্মিলিত শক্তি প্রয়োগ করতে পারেনি।’
গত বছর মার্কিন প্রশাসন পরিবর্তনের পর থেকেই আরব দেশগুলো সিরিয়া প্রশ্নে নমনীয় অবস্থা নিতে শুরু করে। সংযুক্ত আরব আমিরাত, বাহরাইন, ওমান, দামেস্ক ও সৌদি আরব সিরিয়া সরকারের সঙ্গে সবচেয়ে ঘনিষ্ঠ কূটনৈতিক যোগাযোগ রক্ষা করে এসেছে। কুয়েত ও কাতার সরাসরি কোনো উদ্যোগের মধ্যে না থাকলেও, তারা সিরিয়ার সঙ্গে অন্য দেশের সম্পর্ক গড়ে তোলা নিয়ে কোনো বিপরীত প্রতিক্রিয়া দেখায়নি।
সম্প্রতি গৃহযুদ্ধ শুরুর পর প্রথম আরব রাষ্ট্র হিসেবে বাশার আল আসাদ রাষ্ট্রীয় সফর করেন আরব আমিরাতে। আসাদকে অভ্যর্থনা জানিয়েছেন আমিরাতের যুবরাজ মোহাম্মদ বিন জায়েদ। অথচ এই ব্যক্তিই গত ১১ বছরে আরব বিশ্বে সিরিয়াবিরোধী তৎপরতায় অগ্রণী ভূমিকা রেখেছিলেন।
এ সফরের অনেক তাৎপর্য রয়েছে। এর মধ্য দিয়ে আসাদ সরকারকে বৈধতা দিচ্ছে আরব রাষ্ট্রগুলো। সেই সঙ্গে আসাদবিরোধী অবস্থান থেকে সরে আসার সুস্পষ্ট ইঙ্গিত দেওয়া হচ্ছে। সিরিয়ার পুনরায় আরব লিগে যুক্ত হওয়ার বিষয়টিও আলোচনার শীর্ষেই রয়েছে। সেই সঙ্গে মধ্যপ্রাচ্যে মার্কিন প্রভাব হ্রাস এবং রুশ প্রভাব বৃদ্ধির ইঙ্গিতও দিচ্ছে আসাদের এই সফর। আর এতে রুশ-মার্কিন দুই পরাশক্তির দ্বন্দ্ব স্পষ্ট হচ্ছে। এতে সিরিয়ার অভ্যন্তরীণ, আঞ্চলিক বা বৈশ্বিক বিভিন্ন শক্তির অনেক হিসাব-নিকাশ চললেও মানবিকতা পরাজয়ের বৃত্তেই আবদ্ধ।