ইসরায়েলে হামলার ‘নায়ক’ এক পঙ্গু হামাস নেতা

চতুর্থ দিনে গড়িয়েছে হামাস-ইসরায়েল যুদ্ধ। গত শনিবার হামাস ইসরায়েলে হঠাৎ হামলা চালালে গাজায় পাল্টা হামলা শুরু ইসরায়েল। দুপক্ষের পাল্টাপাল্টি হামলায় যুদ্ধ পরিস্থিতি বিরাজ করছে। এসব হামলায় হতাহতের সংখ্যাও বাড়ছে হু হু করে। এই যুদ্ধে এ পর্যন্ত দুই দেশে নিহতের সংখ্যা ১৫০০ ছাড়িয়েছে। আহত হয়েছে ৬ হাজারের বেশি মানুষ।

ইসরায়েলে হামাসের এই হামলার পেছনে মূল কারিগর বিবেচনা করা হচ্ছে গোষ্ঠীটির সামরিক শাখা আল-ক্বাসাম ব্রিগেডের প্রধান মোহাম্মদ দায়েফকে। 

ফিলিস্তিনি পঙ্গু এই সমরনেতা গাজার একটি শরণার্থী শিবিরে জন্ম নেন। বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে যোগ দেন ইসরায়েলবিরোধী লড়াইয়ে। একপর্যায়ে এসে পরিণত হন আল-ক্বাসাম ব্রিগেডের প্রধান ব্যক্তি হিসেবে।

ছাত্র জীবন থেকেই সংগ্রামী

আল-ক্বাসাম ব্রিগেড প্রধানের শৈশব-কৈশোরের ব্যাপারে খুব একটা তথ্য পাওয়া যায় না। এমনকি তার পরিবার ও বাবা-মায়ের তথ্যও পাওয়া যায় না। ইসরায়েলি গোয়েন্দারা মনে করে, মোহাম্মদ দায়েফের আসল নাম মোহাম্মদ দিয়াব ইব্রাহিম আল-মাসরি। তার পরিবারের অনেক সদস্যই ১৯৫০-এর দশকে ইসরায়েলবিরোধী ফেদাইন যোদ্ধা ছিলেন, যারা বিভিন্ন অবৈধ ইসরায়েলি সেনাচৌকিতে আক্রমণ চালিয়েছিলেন।

মোহাম্মদ দায়েফের হামাস-সংশ্লিষ্টতার শুরু হয় তার বিশ্ববিদ্যালয় জীবনের প্রথম দিকে। তিনি যখন ইসলামিক ইউনিভার্সিটি অব গাজায় পড়ালেখা করছিলেন, তখন তিনি মুসলিম ব্রাদারহুডের আদর্শে অনুপ্রাণিত হন। পরে তিনি সক্রিয়ভাবে হামাসে যোগ দেন। ১৯৯০-এর দশকের শুরুর দিকে প্যালেস্টাইন লিবারেশন অর্গানাইজেশনের প্রধান ইয়াসির আরাফাত অসলো অ্যাকর্ডে স্বাক্ষর করলে মোহাম্মদ দায়েফসহ অন্যান্য হামাস নেতা ক্ষুব্ধ হন। কারণ এই চুক্তির কারণেই অনেক ফিলিস্তিনি ভূখণ্ড ইসরায়েলের দখলে চলে যায়।

সেই ঘটনার পরপরই হামাসের শীর্ষ সমরকৌশলবিদদের দুজন ইয়াহিয়া আয়াশ ও আদনান আল-ঘৌল আল-ক্বাসাম ব্রিগেড গঠন করেন। তাদের পরামর্শে মোহাম্মদ দায়েফ আল-ক্বাসাম ব্রিগেডে যোগ দেন। তারপর থেকে তিনি ইসরায়েলের অভ্যন্তরে বিভিন্ন হামলা পরিচালনা করেছেন।

সরাসরি সংঘাতে বেশি আগ্রহ

হামাসের শীর্ষস্থানীয় নেতা গাজি হামাদ মোহাম্মদ দায়েফের বিষয়ে বলেন, ‘তিনি খুবই দয়ালু।’ তিনি আরও জানান, দায়েফের নামের অর্থ হলো, যাযাবর সম্প্রদায়, যারা জীবন ধারণের জন্য ক্রমাগত জায়গা পরিবর্তন করে। মোহাম্মদ দায়েফও ক্রমাগত স্থান পরিবর্তন করেন। হামাদ বলেন, মোহাম্মদ দায়েফ খুবই সুরসিক কিন্তু তিনি তার লক্ষ্যে অটল। তিনি তার হামাসের শুরুর জীবন থেকে সামরিক দিকে মনোযোগী ছিলেন।

দায়েফ ১৯৭৩ সালে আরব-ইসরায়েল যুদ্ধে লড়েছেন ফিলিস্তিনের হয়ে। সেই সময় থেকেই তিনি তার লক্ষ্যের বিষয়ে নিশ্চিত হয়ে যান। নিজের লক্ষ্যের বিষয়ে আল-ক্বাসাম ব্রিগেডের এই নেতা বলেন, আমাদের জনগণের বিরুদ্ধে ক্রমাগত অপরাধ, দখলদারদের বেলেল্লাপনা ও আন্তর্জাতিক আইনবিধি অস্বীকার, দখলদারদের প্রতি যুক্তরাষ্ট্র ও পশ্চিমা সমর্থনের পরিপ্রেক্ষিতে আমরা এসব বন্ধ করার সিদ্ধান্ত নিয়েছি, যাতে শত্রু উপলব্ধি করতে পারে যে, তারা আর হিসাব না করে আনন্দ করতে পারবে না।

মোহাম্মদ দায়েফ ইসরায়েল-ফিলিস্তিন সংকট সমাধানের ক্ষেত্রে আন্তর্জাতিক সংলাপ-রাজনীতির পরিবর্তে তেল আবিবের সঙ্গে সরাসরি সংঘাতে যেতেই বেশি আগ্রহী। সেই ধারাবাহিকতায় দায়েফ ২০১০ সালে একটি নিবন্ধ লেখেন। সেখানে তিনি চলমান সংকটের পরিপ্রেক্ষিতে কীভাবে ইসরায়েলের সঙ্গে লড়তে চান, তা তুলে ধরেন। সেই নিবন্ধে তিনি বলেন, আল কুদস (জেরুজালেম), আল আকসা (মসজিদ), ভূমধ্যসাগরের তীর থেকে জর্ডান নদী পর্যন্ত সব শহর ও গ্রাম এবং এর উত্তর থেকে দক্ষিণ পর্যন্ত সব এলাকাই আমাদের থাকবে। আপনাদের এখানে (ইসরায়েল) এর এক ইঞ্চিরও অধিকার নেই।

হারিয়েছেন স্ত্রীসহ দুই শিশুসন্তান

মোহাম্মদ দায়েফ ২০০২ সালে আল-ক্বাসাম ব্রিগেডের প্রধান নিযুক্ত হন। ফিলিস্তিনি এই যোদ্ধা ইসরায়েলি বাহিনীর জন্য মূর্তিমান ত্রাস ছিলেন। ইসরায়েলি বাহিনী দায়েফের ওপর অন্তত ৭ দফা অতর্কিত হামলা চালায়। এসব হামলায় তার দুই শিশুসন্তান, স্ত্রী মারা যান। গুরুতর আহত হন তিনি। তার এক চোখ, এক পা ও এক হাত হারাতে হয় এসব হামলায়।

হামাসের প্রয়াত আধ্যাত্মিক নেতা শেখ আহমেদ ইয়াসিন মোহাম্মদও ইসরায়েলি হামলায় পঙ্গু হয়ে গিয়েছিলেন। তার পরও তিনি হুইলচেয়ার ব্যবহার করে হামাসের নেতৃত্ব দিয়েছেন। পরে ২০০৪ সালে শেখ ইয়াসিন ইসরায়েলি হামলায় নিহত হন। মোহাম্মদ দায়েফও শেখ ইয়াসিনের পদাঙ্ক অনুসরণ করে হুইলচেয়ারে বসেই আল-ক্বাসাম ব্রিগেডকে নেতৃত্ব দিচ্ছেন।

সূত্র- টিআরটি ওয়ার্ল্ড

সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2023 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh

// //