ঋণে জর্জরিত মিশরের অর্থনীতি ক্রমাগত ধসে পড়ছে। দেশটির ঋণ এখন মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) ৯০ শতাংশেরও বেশি। মিশরীয় পাউন্ড ক্রমাগত দাম হারাচ্ছে, বৈদেশিক মুদ্রার মজুদ ফুরিয়ে যাচ্ছে, সেই সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে মূল্যস্ফীতি। গাজা ও লেবাননে ইসরায়েলি আগ্রাসন দেশটির ভঙ্গুর অর্থনীতিকে আরও গভীর সংকটের মুখে ফেলছে।
পর্যটন খাতে হতাশা : মিশরের পিরামিড, জাদুঘর, রিসোর্ট ও স্মৃতিস্তম্ভগুলো দেখতে গোটা বিশ্বের দর্শনার্থীরা ভিড় জমান। পর্যটন খাত দেশটির জাতীয় আয়ের অন্যতম উৎস। কোভিড-১৯ মহামারি দেশটির পর্যটন খাতে ধস নামিয়েছিল। একটু একটু করে পুনরুদ্ধারের দিকে এগোচ্ছিল মিশর। ২০২২ সালেও প্রায় ৩০ লাখ মিশরীয় পর্যটন শিল্পে নিয়োজিত ছিলেন। গত বছর গাজায় ইসরায়েলি আগ্রাসন শুরু হওয়ার পর মিশরের পর্যটন খাতে ভয়াবহ আঘাত আসে। মিশরের পর্যটন রাজস্ব ২০২৩ সালের তুলনায় এ বছর প্রায় ৩০ শতাংশ হ্রাস পাবে বলে আশঙ্কা করছেন বিশেষজ্ঞরা। ফলে দেশটির বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভের প্রায় ১০ শতাংশ কমে যেতে পারে। সংকুচিত হবে জিডিপি তথা গোটা অর্থনীতি।
জর্জ ম্যাসন বিশ্ববিদ্যালয়ের সহকারী প্রভাষক আমর সালাহ মোহাম্মদ বলেন, ‘সিনাই উপদ্বীপের নিকটবর্তী হওয়ার কারণে পর্যটনে ধস নেমেছে। ২০২২-২৩ অর্থবছরেও এই খাত থেকে ১৩.৬৩ বিলিয়ন ডলার রাজস্ব এসেছে। যুদ্ধ চলতে থাকলে মিশরের মন্দা বাড়ার গুরুতর আশঙ্কা রয়েছে।’
আয় কমেছে সুয়েজ খাল থেকে : ইসরায়েলি আগ্রাসনের বিরুদ্ধে গত বছরের নভেম্বর মাস থেকে লোহিত সাগরে ইসরায়েল ও তার মিত্রদের বাণিজ্যিক জাহাজে হুথিরা ক্ষেপণাস্ত্র ও ড্রোন হামলা চালাচ্ছে। ফলে অনেক শিপিং কোম্পানি তাদের জাহাজ এশিয়ার সঙ্গে ইউরোপের সংযোগকারী সুয়েজ খালের মধ্য দিয়ে চলাচল করাচ্ছে না। এতে মিশর অর্থনৈতিক ক্ষতির মুখে পড়েছে। ২০২২-২৩ অর্থবছরে সুয়েজ খাল থেকে মিশর ৯৪০ কোটি ডলার রাজস্ব আয় করেছে। সুয়েজ খাল থেকে রাজস্ব আয় প্রায় ৫০ শতাংশ কমেছে।
বাড়ছে মূল্যস্ফীতি : এদিকে টানা পাঁচ মাস নিম্নমুখী থাকার পর আগস্টে মিশরের মূল্যস্ফীতি বেড়েছে। দেশটির রাষ্ট্রীয় পরিসংখ্যান সংস্থা সেন্ট্রাল এজেন্সি ফর পাবলিক মোবিলাইজেশন অ্যান্ড স্ট্যাটিসটিকসের তথ্যমতে- গত মাসে বার্ষিক মূল্যস্ফীতির হার ২৬.২ শতাংশে পৌঁছায়, যা জুলাইয়ে ছিল ২৫.৭ শতাংশ। বিনিয়োগ ব্যাংকিং প্রতিষ্ঠান নাইম হোল্ডিংসের বিশ্লেষণ অনুযায়ী গত বছরের আগস্টে মূল্যস্ফীতি ২.৪৭ শতাংশ কম থাকায় চলতি বছরের একই সময়ে ২৪.৮ শতাংশের পূর্বাভাস দেওয়া হয়। যদিও এ সময়ে ভোক্তা মূল্যসূচক ১.২৪ শতাংশ বৃদ্ধির পূর্বাভাস দেওয়া হয়েছিল।
পরিবহন খাতের খরচ বৃদ্ধি মূল্যস্ফীতি বৃদ্ধির পেছনে অবদান রেখেছে। মাসিক হিসাবে আগস্টে খরচ বেড়েছে ১০.৭ এবং বার্ষিক হিসাবে ২৯.৮ শতাংশ। জুলাইয়ে সরকার ডিজেলসহ জ্বালানি তেলের দাম বাড়ায়। ওই সময় বিশ্লেষকরা পরিবহন খরচ বৃদ্ধির পূর্বাভাস দিয়েছিলেন। জ্বালানি তেলের দাম বাড়ার সিদ্ধান্ত এমন সময় নেওয়া হয়, যখন দেশটির অব্যাহত ঋণ কর্মসূচি নিয়ে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের পর্যালোচনা করা হয়। খাদ্য ও পানীয়র দাম জুলাইয়ের তুলনায় আগস্টে ১.৮ শতাংশ বেড়েছে, যা বছরভিত্তিক হিসাবে রেকর্ড ২৮.১ শতাংশ। মাসিক হিসাবে পোশাক ও জুতার মূল্য ১.১ শতাংশ, আবাসন ও ইউটিলিটি দশমিক ৭, আসবাবপত্র ও গৃহস্থালি সরঞ্জামে ১.৭ এবং স্বাস্থ্যসেবার মূল্য ৩.৪ শতাংশ বেড়েছে।
সম্প্রতি সরকারের ভর্তুকি কমানোর কারণে হঠাৎ মূল্যস্ফীতি বেড়েছে। গত সপ্তাহে দেশটির বিদ্যুৎ ও জ্বালানি মন্ত্রণালয়ের বিবৃতিতে বলা হয়, জ্বালানি তেলের দাম ১৫ শতাংশ পর্যন্ত এবং বিদ্যুতের খরচ ১৫-৪০ শতাংশ বেড়েছে।
আর্থিক বিশ্লেষক মোহাম্মদ রাগাব জানান, মূল্যস্ফীতির ঊর্ধ্বগতির কারণে মিশরের কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ১৭ অক্টোবরের পরবর্তী বৈঠকে সুদহার সর্বোচ্চ ২৭.২৫ শতাংশে উন্নীত করার সম্ভাবনা রয়েছে। ফলে টানা চতুর্থবার সুদহার বাড়ানো হবে। অধিকাংশ অর্থনীতিবিদ পূর্বাভাস দিয়েছেন দেশটির সুদহার চলতি বছরের শেষ নাগাদ বা আগামী বছরের শুরুর দিকে কমবে।
দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতিতে সাধারণ মিশরীয়দের যে নাভিশ্বাস উঠে গেছে, মূল্যস্ফীতি উপাত্তে তা স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। ১০ কোটি ৪০ লাখ জনসংখ্যার দেশটির প্রায় ৩০ শতাংশই দরিদ্র কিংবা দারিদ্র্যসীমার আশপাশে অবস্থান করছে। ক্রমবর্ধমান মূল্যস্ফীতিতে প্রধান প্রভাবকের ভূমিকা পালন করছে খাদ্যপণ্যের উচ্চমূল্য।
সুদানে সংঘাত শুরু হওয়ার পর থেকে সাড়ে চার লাখ সুদানি শরণার্থী মিশরের দক্ষিণ সীমান্ত অতিক্রম করেছে, যা ইতোমধ্যে মিশরের সমস্যাজর্জরিত অর্থনীতিকে আরও চাপে ফেলেছে। এই পটভূমিতে সম্ভাব্য এই ধরনের পরিস্থিতি এড়াতে মিশর-গাজা সীমান্তের দুই মাইল পশ্চিমে একটি প্রাচীর নির্মাণ করেছে মিশর। দেশটি গাজার ফিলিস্তিনিদের শরণার্থী হিসেবে গ্রহণ করতে অস্বীকৃতি জানিয়েছে। ইতোমধ্যে গাজা-যুদ্ধ লেবাননে বিস্তৃত হয়েছে। ফলে মিশরের অর্থনীতিও নিকট ভবিষ্যতে ঘুরে দাঁড়ানোর কোনো সম্ভাবনা দেখছেন না বিশেষজ্ঞরা।
সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন
© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh