মধ্যপ্রাচ্যে শান্তি প্রতিষ্ঠার ভবিষ্যৎ কী

নিষ্ঠুর ও নারকীয়। অমানবিক ও দানবীয়। সিরিয়ার ক্ষমতাচ্যুত প্রেসিডেন্ট বাশার আল আসাদের দুই যুগের শাসনকে এভাবেই মূল্যায়ন করছে সবাই- বিশেষ করে ইসরায়েল এবং এর পশ্চিমা মিত্র যুক্তরাষ্ট্র। ২০১১ সাল থেকে চলমান গৃহযুদ্ধে বাশারের লৌহকঠিন শাসনকে অবশ্য বিশ্লেষকরা ‘সফল’ বলে অভিহিত করে আসছিলেন, কারণ তিনি সবপক্ষকে বেশ শক্তহাতেই দমন করতে পেরেছিলেন বলে প্রতীয়মান হচ্ছিল। সেই বাশার বিদ্রোহীদের মাত্র ১২ দিনের বিদ্যুৎগতির অগ্রাভিযানের মুখে পদত্যাগ করে দেশ ছেড়ে পালিয়েছেন। এতে সবাই বিস্মিত হয়েছে এবং এখন একটি প্রশ্ন বড় হয়ে দেখা দিয়েছে, সিরিয়া ও মধ্যপ্রাচ্যে শান্তি প্রতিষ্ঠার ভবিষ্যৎ আসলে কী? মোটাদাগে মধ্যপ্রাচ্যজুড়ে বিরাজ করছে উদ্বেগ, উৎকণ্ঠা ও অনিশ্চয়তা। 

সিরিয়ার প্রতিবেশী দেশগুলোর মধ্যে আসাদের পতনের ঘটনাপ্রবাহে সবচেয়ে বেশি প্রভাবিত হবে যেসব দেশ তাদের মধ্যে অন্যতম ইসরায়েল। সিরিয়ার সঙ্গে ইসরায়েলের সীমান্ত দাঁড়িয়ে আছে গোলান মালভূমিতে। ১৯৬৭ সালের ছয় দিনের যুদ্ধে এবং পরবর্তীকালে ১৯৭৩ সালের আরব-ইসরায়েল যুদ্ধে এই গোলান মালভূমির অধিকাংশই সিরিয়ার থেকে দখল করে নিয়েছিল ইহুদি রাষ্ট্রটি। এরপর থেকেই সিরিয়া ও ইসরায়েলের মধ্যে দ্বন্দ্বের প্রধান কেন্দ্রবিন্দু হিসেবে অবস্থান করছে গোলান মালভূমিতে ইসরায়েলের অবৈধ দখলদারিত্ব। পাশাপাশি লেবাননে ইসরায়েলের বিরুদ্ধে সংগ্রামরত ইরানপন্থি প্রতিরোধ গোষ্ঠী হিজবুল্লাহর সঙ্গে ইরানের শাসকগোষ্ঠীর যোগাযোগের মাধ্যমও সিরিয়া। সিরিয়ার ভূখণ্ড ব্যবহার করেই হিজবুল্লাহর জন্য প্রয়োজনীয় রসদসহ অন্যান্য সাহায্য প্রেরণ করে থাকে ইরান।

এই পরিস্থিতিতে বাশার আল আসাদের পতনের পরিপ্রেক্ষিতে সিরিয়ার ভবিষ্যৎ রাজনৈতিক পরিস্থিতি কোন দিকে যাবে স্বভাবতই তা নিয়ে উদ্বেগ রয়েছে ইসরায়েলের কূটনৈতিক ও রাজনৈতিক মহলে। বিশেষ করে বাশার-পরবর্তী সিরিয়ার রাজনৈতিক নেতৃত্বে কারা আসীন হবে তাদের মনোভাবের ওপর অনেকটাই নির্ভর করছে গোলান মালভূমি নিয়ে ইসরায়েলের সঙ্গে সিরিয়ার ভবিষ্যৎ বোঝাপড়া। এদিকে অধিকৃত গোলান মালভূমিতে ইহুদি বসতি আরো বাড়াতে চায় ইসরায়েল। দেশটির সরকার এ-সংক্রান্ত একটি পরিকল্পনায় অনুমোদন দিয়েছে।

বাশারবিরোধী বিদ্রোহী গোষ্ঠীগুলোর মধ্যে বেশির ভাগই ইসলামপন্থি এবং রক্ষণশীল মতাদর্শের হওয়ায় তাদের মধ্যে কেউ যদি সিরিয়ার ক্ষমতা গ্রহণ করে তবে স্বভাবতই তা ইসরায়েলের জন্য উদ্বেগজনক বলে মনে করছেন ইহুদি রাষ্ট্রটির বিশ্লেষক ও কূটনৈতিক মহল। তবে সিরিয়ার বিদ্রোহী গোষ্ঠীর প্রধান নেতা আহমেদ হুসাইন আল-শারা বলেছেন, দেশ এখন যুদ্ধক্লান্ত। সিরিয়া প্রতিবেশী কোনো দেশ কিংবা পশ্চিমা বিশ্বের জন্য মোটেও হুমকি নয়। তিনি সিরিয়ার ওপর আরোপ করা নিষেধাজ্ঞা তুলে নেওয়ারও দাবি জানিয়েছেন। আল-শারা কার্যত এখন সিরিয়ার প্রধান। এদিকে সিরিয়ায় শান্তিপূর্ণ ক্ষমতা হস্তান্তর প্রক্রিয়ায় সমর্থন দেওয়ার বিষয়ে একমত হয়েছে আরব লিগের আট দেশ।  

ইসরায়েলের হামলায় হিজবুল্লাহর সাম্প্রতিক সময়ে সংঘটিত ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি ও সিরিয়ার বাশার আল আসাদের পতনের বিষয়টি হজম করাটা ইরানের জন্য কঠিন হয়ে পড়বে। তারা এখন বোঝার চেষ্টা করছে নিজেদের ক্ষয়ক্ষতির মাত্রা। এই পরিস্থিতিতে ইরান তাদের পরমাণু কর্মসূচি নিয়ে এগিয়ে যাবে, নাকি পরমাণু কর্মসূচি বাদ দিয়ে মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের সঙ্গে চুক্তিতে পৌঁছাবে, যেন চার বছরের শাসনামলে ইসরায়েলের সম্ভাব্য হামলা থেকে নিজেকে রক্ষা করতে পারে তেহরানÑইসরায়েল মনে করছে এখন এই দুটির একটিকে বেছে নিতে হবে ইরানকে। পাশাপাশি আসাদের পতনের পর ইরানের পরমাণু কর্মসূচিকে আটকানোই ইসরায়েলের প্রধান কর্তব্য হবে। 

অন্যদিকে আসাদের পতনের পর তার ঘনিষ্ঠ মিত্র হিজবুল্লাহর ভবিষ্যৎ খুব একটা ভালো হবে না। হিজবুল্লাহ লেবাননে থেকে আসাদের পক্ষে তৎপরতা চালাবে কি না সে বিষয়টি এখনো পরিষ্কার নয়।

আসাদের পতনের পর জর্ডানের বাদশাহ আব্দুল্লাহর ক্ষমতার মসনদও ঝুঁকির মুখে পড়েছে। সিরিয়ার অস্থিরতা জর্ডানকে আন্দোলিত করলে তা ইসরায়েলের নিরাপত্তার ক্ষেত্রেও ঝুঁকি তৈরি করতে পারে। ইসরায়েলের প্রতিবেশীদের মধ্যে সবচেয়ে বড় সীমান্ত রয়েছে জর্ডানের সঙ্গে। একই সঙ্গে জর্ডানের বর্তমান শাসকগোষ্ঠীর সঙ্গে ইসরায়েলের ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক রয়েছে। ইসরায়েলের সঙ্গে থাকা সব প্রতিবেশীর সীমান্তের মধ্যে জর্ডানের সীমান্তই সবচেয়ে শান্তিপূর্ণ। ফলে সিরিয়ার অস্থিরতা জর্ডানেও ছড়ালে জর্ডান-সীমান্তও ইসরায়েলের সামরিক বাহিনীর জন্য নতুন মাথাব্যথার কারণ হয়ে দাঁড়াতে পারে। আসাদ-পরবর্তী সিরিয়ার পরিস্থিতিতে সৌদি আরবের তেমন কোনো ভূমিকা রাখার সুযোগ নেই। বাশারবিরোধী সুন্নি সশস্ত্র গোষ্ঠীগুলো বরং সাম্প্রতিক সাফল্যে উজ্জীবিত হয়ে সিরিয়ার প্রতিবেশী দেশগুলোর দিকেও নজর দিতে পারে, এতে সৌদি আরবসহ পুরো মধ্যপ্রাচ্য অস্থিতিশীল হয়ে পড়তে পারে।

সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2025 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh