গাজায় আরেকটি গণহত্যার বছর

২০২৩ সালের ৭ অক্টোবর থেকে গাজায় আগ্রাসন শুরু করে ইসরায়েল। ২০২৪ সালজুড়ে ইসরায়েলি বাহিনী আন্তর্জাতিক কোনো আইনের তোয়াক্কা না করে একের পর এক মানবাধিকার লঙ্ঘন ও গণহত্যা চালিয়ে গেছে। আর এর স্বীকৃতি দিয়ে পাশে থেকেছে পশ্চিমা দেশগুলো। 

২০২৪ সালের ২৮ ডিসেম্বর পর্যন্ত হিসাব অনুযায়ী, ৪৫ হাজার ৪৩৬ জন ফিলিস্তিনি নিহত এবং এক লাখ আট হাজার ৩৮ জন আহত হয়েছে। জাতিসংঘ জানিয়েছে, এই নিহত ফিলিস্তিনিদের ৭০ শতাংশই নারী ও শিশু। শিশুরা আগামী দিনে অধিকারের দাবিতে দাঁড়াবে আর এই নারীদের গর্ভেই প্রতিবাদী প্রজন্ম জন্ম নেবে, তাই নারী ও শিশুদের লক্ষ্য করে হামলা চালাচ্ছে ইসরায়েল।

জাতিসংঘ বিশেষজ্ঞরা গাজা ও পশ্চিম তীরে মানবাধিকার পর্যবেক্ষক, সাংবাদিক ও মানবিক ত্রাণকর্মীসহ শত শত ফিলিস্তিনি নারী ও কন্যাশিশুকে নির্বিচারে আটকে রাখার বিষয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন। অনেক আটক নারীর সঙ্গে অমানবিক আচরণ করা হয়েছে। তাদের ঋতুস্রাবের প্যাড, খাবার এমনকি প্রয়োজনীয় ওষুধ পর্যন্ত দেওয়া হয়নি। নারীকে ব্যাপক মারধর করা হয়েছে বলে জাতিসংঘের মানবাধিকারবিষয়ক হাইকমিশনারের অফিস (ওএইচসিএইচআর) জানিয়েছে। গাজায় আটক ফিলিস্তিনি নারীকে খাবার ছাড়াই বৃষ্টি ও ঠান্ডায় খাঁচায় আটকে রাখা হয়েছে বলে অভিযোগ রয়েছে।

বিশেষজ্ঞরা বিবৃতিতে বলেছেন, ‘আমরা বিশেষ করে এমন খবরে ব্যথিত যে, আটক ফিলিস্তিনি নারীরা বিভিন্ন ধরনের যৌন নিপীড়নের শিকার হয়েছেন। এর মধ্যে রয়েছে নারীকে নগ্ন করে ইসরায়েলি পুরুষ সেনা কর্মকর্তাদের দ্বারা তল্লাশি করা। অন্তত দুই ফিলিস্তিনি নারী বন্দিকে ধর্ষণ করা হয়েছে এবং অন্যদের ধর্ষণ ও যৌন সহিংসতার হুমকি দেওয়া হয়েছে বলে জানা গেছে।’ গাজায় ইসরায়েলি সেনাবাহিনী যেসব জায়গায় প্রবেশ করেছে, সেখানকার অসংখ্য ফিলিস্তিনি নারী ও শিশু নিখোঁজ হয়েছে।

ইসরায়েলি আগ্রাসন শুরুর পর গাজা শহরের মাগাজি শরণার্থী শিবির থেকে আগ্রাসী বাহিনীর উচ্ছেদের নোটিশ পেয়ে নাদা ও তার পরিবার মধ্য গাজার দেইর আল-বালাহতে পালিয়ে যেতে বাধ্য হন। তার বাড়ি বোমা হামলায় ধ্বংস করা হয়। নাদা বলেন, ‘আমি পরনের কাপড় ও বাচ্চাদের জন্য কিছু জামাকাপড় নিয়ে বেরিয়েছিলাম। কখনোই ভাবিনি যে, আমি এই পর্যায়ে পৌঁছাব। জীর্ণ জামাকাপড়ে তাঁবুর বাইরে যেতেও লজ্জা লাগে। এখন আমি ঘুমাতে বা বাইরে যেতে সব সময় বোরখা পরি।’

গত ৫ ডিসেম্বর ফিলিস্তিনিদের ওপর ইসরায়েল গণহত্যা চালিয়েছে বলে অভিযোগ করেছে লন্ডনভিত্তিক আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থা অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল। কয়েক মাসের তদন্ত ও ইসরায়েলি কর্মকর্তাদের বিবৃতি বিশ্লেষণ করে তৈরি করা এক প্রতিবেদনে এই অভিযোগ করা হয়। ১৯৪৮ সালের জেনোসাইড কনভেনশনে উল্লিখিত আইনি সংজ্ঞা অনুযায়ী গাজায় ইসরায়েলি কর্মকাণ্ডকে গণহত্যা বলে দাবি করেছে সংস্থাটি। ইহুদিদের ওপর নাৎসি জার্মানি গণহত্যা চালানোর প্রেক্ষাপটে ওই কনভেনশন গৃহীত হয়। কনভেনশনের সংজ্ঞা অনুযায়ী, জাতীয়তা, বর্ণ, গোত্র বা ধর্মের ভিত্তিতে কোনো গোষ্ঠীকে আংশিক বা সম্পূর্ণ ধ্বংস করার ‘উদ্দেশ্য’ থাকলে সেই হত্যাযজ্ঞকে গণহত্যা হিসেবে অভিহিত করা হয়। 

অ্যামনেস্টির প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, শতাধিক ইসরায়েলি কর্মকর্তার বক্তব্য পর্যালোচনা করে কনভেনশনে উল্লিখিত অন্তত তিনটি নিষিদ্ধ কাজ সংঘটিত হওয়ার প্রমাণ পেয়েছে তারা। এগুলো হলো হত্যাকাণ্ড, শারীরিক ও মানসিক ক্ষতি সাধন এবং একটি গোষ্ঠীর ধ্বংস নিশ্চিত করতে পারে এমন পরিস্থিতি সৃষ্টি করা।

ইসরায়েল সরকারের দাবি, তাদের অভিযান হামাসকে নির্মূল করতেই সীমাবদ্ধ। তবে অ্যামনেস্টি বলেছে, জাতিগত গোষ্ঠী হিসেবে ফিলিস্তিনিদের ধ্বংস করার উদ্দেশ্য স্পষ্টভাবে দেখা যায় ইসরায়েলি অভিযানে। অ্যামনেস্টির সেক্রেটারি জেনারেল অ্যাগনেস ক্যালামার্ড বলেছেন, ‘গাজায় গণহত্যা সংঘটিত হচ্ছে। ছয় মাসের নিবিড় গবেষণার পর আমরা এই অপরাধ সম্পর্কে নিশ্চিত হয়েছি।’ গাজায় গণহত্যা একটি জনগোষ্ঠীকে নিশ্চিহ্ন করে দেওয়ার আগে পঙ্গু করে দেওয়ার প্রয়াস। জনসংখ্যার নব্বই শতাংশের বেশি অন্তত একবার বাস্তুচ্যুত হয়েছে। 

আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতের (আইসিসি) প্রসিকিউটররা এরই মধ্যে গাজায় সংঘটিত যুদ্ধাপরাধ ও মানবতাবিরোধী অপরাধের তদন্ত চালিয়ে যাচ্ছে। অ্যামনেস্টি আদালতকে গণহত্যার অভিযোগও অন্তর্ভুক্ত করার আহ্বান জানিয়েছে।

সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2025 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh