গাজায় ২০২৩ সালের অক্টোবরে ইসরায়েলি আগ্রাসন শুরু হওয়ার পর থেকে দখলীকৃত পশ্চিম তীরেও দখলদার বাহিনী অভিযান চালাচ্ছে। পশ্চিম তীরের উত্তরে অবস্থিত জেনিন তখন থেকেই আরেক যুদ্ধক্ষেত্রে পরিণত হয়েছে। ইসরায়েলি আগ্রাসন শুরুর পেছনে হামাসকে দায়ী করেছিল পশ্চিম তীরে ক্ষমতাসীন ফিলিস্তিন কর্তৃপক্ষ (পিএ)।
তবে এই অভিযোগ বুমেরাং হয়েছে। হামাসের পক্ষে পশ্চিম তীরে এমন জনসমর্থন এর আগে কখনো দেখা যায়নি। এর বিপরীতে ফিলিস্তিন কর্তৃপক্ষে নেতৃত্বদানকারী ফাতাহ দলটির সমর্থন উল্লেখযোগ্য হারে কমেছে। ফিলিস্তিন কর্তৃপক্ষ বেশ কিছুদিন ধরেই পশ্চিম তীরে বিশেষ করে জেনিনে সশস্ত্র প্রতিরোধ যোদ্ধাদের বিরুদ্ধে অভিযান চালাচ্ছে, ফিলিস্তিনিদের হত্যা করছে। তারা এই যোদ্ধাদের ‘সন্ত্রাসী’ হিসেবে উল্লেখ করছে। এ যেন ইসরায়েলেরই প্রতিধ্বনি। আর এই কারণে সাধারণ ফিলিস্তিনিদের চোখে তারা ইসরায়েলের ‘পাহারাদার’ আর হামাস সদস্যরা প্রতিরোধ আন্দোলনের যোদ্ধা।
হামাসের উত্থান আর নতুন আখ্যান রচনার সময়কাল ২০০৬ সাল। তখন ফিলিস্তিনের পার্লামেন্ট নির্বাচনে ফাতাহ হেরে যাওয়ার পরও হামাসের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর না করে ধরে রাখে। সে সময় গাজায় নিজেদের সরকার পরিচালনা শুরু করে হামাস। এরপর বেশ কয়েকবার জাতীয় সরকার গঠনের উদ্যোগ নেওয়া হলেও তা শেষ পর্যন্ত কার্যকর হওয়া সম্ভব হয়নি ইসরায়েলপন্থি ফাতাহ নেতাদের কারণে।
এর মধ্যে বারবার গাজায় আগ্রাসন চালিয়ে আসছে ইসরায়েল। আরব দেশগুলো ইসরায়েলের পিছু পিছু হাঁটছিল আর আন্তর্জাতিক মহল ফিলিস্তিনিদের কথা যেন ভুলেই গিয়েছিল। এমন বাস্তবতায় ধ্বংসযজ্ঞকে সাথি করে বেঁচে থাকা অকুতোভয় ফিলিস্তিনি যোদ্ধারা ২০২৩ সালের ৭ অক্টোবর ইসরায়েলের ওপর হামলা চালায়। এরপর সর্বশক্তি নিয়োগ করে অবরুদ্ধ গাজায় গণহত্যা শুরু করে ইসরায়েল। আবাসিক ভবন, হাসপাতালসহ পুরো গাজাকে ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়। তবে এই আগ্রাসনে ফিলিস্তিনিদের কাছে হামাস যে নিজের সত্তায় জুড়ে গিয়েছিল।
পশ্চিম তীরে ইসরায়েলি আগ্রাসনের সঙ্গে সঙ্গে ফিলিস্তিনি কর্তৃপক্ষকেও ব্যবহার করা হচ্ছে প্রতিরোধ যোদ্ধাদের ধরতে বা হত্যা করতে। ডিসেম্বরের মাঝামাঝি থেকে শুরু হওয়া ফিলিস্তিন কর্তৃপক্ষের মারাত্মক অভিযানে জেনিনে অন্তত ১৬ জন নিহত হয়েছে। আর এই হামলার বিরুদ্ধে যারা প্রতিবাদ করছেন, তাদের লক্ষ্যবস্তু করা হচ্ছে। গত ২৯ ডিসেম্বর ফিলিস্তিনি কর্তৃপক্ষের নিরাপত্তা সংস্থার স্নাইপাররা গুলি করে তরুণ সাংবাদিক শাথা আল সাব্বাগকে হত্যা করেন। ২১ বছর বয়সী সাহসী এই সাংবাদিক জেনিনের সশস্ত্র গোষ্ঠীগুলোর বিরুদ্ধে ফিলিস্তিনি কর্তৃপক্ষের ভয়ানক অভিযানের ঘটনাগুলোর তথ্য-প্রমাণ জড়ো করেছিলেন। সংবাদমাধ্যম মিডল ইস্ট আইকে তার ভাই মুসাব আল-সাব্বাগ বলেন, ‘এটা পরিষ্কার যে আমার বোনের সঙ্গে তার শিশুসন্তানও ছিল। তা সত্ত্বেও আমার বোন যখন দরজা খুলে বাড়ির বাইরে বের হচ্ছিল, তখন স্নাইপার দিয়ে তার মাথা লক্ষ্য করে গুলি করা হয়।’
একদিকে গাজায় গণহত্যা চলছে, অন্যদিকে পশ্চিম তীরে ফিলিস্তিনিদের ওপর ইসরায়েলি বসতি স্থাপনকারীদের হামলা রেকর্ডসংখ্যক বেড়েছে। ২০২৩ সালের ৭ অক্টোবর থেকে প্রতিদিন গড়ে চারটি করে হামলার ঘটনা ঘটেছে। এর মধ্যে মারাত্মক হামলা, জোরপূর্বক বাস্তুচ্যুতি, সহিংস অভিযান এবং আন্তর্জাতিক আইন লঙ্ঘন করে ইসরায়েল তার সম্প্রসারণ পরিকল্পনা এগিয়ে নিচ্ছে। আবার মার্কিন অর্থায়নপুষ্ট ফিলিস্তিনি কর্তৃপক্ষ নিজের জনগণের বিরুদ্ধেই যুদ্ধ করে চলেছে।
জেনিনের প্রতিরোধকারী যোদ্ধাদের জোট জেনিন ব্যাটালিয়নকে ‘সন্ত্রাসী’ সংগঠন বলে উল্লেখ করেছে ইসরায়েল। একই ভাষ্য ফিলিস্তিন কর্তৃপক্ষের। তবে জেনিনের অধিবাসীরা এ ব্যাটালিয়নকে ইসরায়েলি দখলদারির বিরুদ্ধে প্রতিরোধ বলে মনে করেন। স্থানীয় অধিবাসী উম্মে আল-মোতাসিম বলেন, ‘ইসরায়েলি সেনারা যখন আমাদের শিবিরে অভিযান চালাতে আসেন, তখন ফিলিস্তিন কর্তৃপক্ষ যাদের সন্ত্রাসী বলছে, সেই তরুণরাই তাদের বিরুদ্ধে আমাদের পক্ষে রুখে দাঁড়ান।’ বিশেষজ্ঞদের মতে, নিজ জনগণের বিরুদ্ধে এমন ভয়াবহ অভিযান পরিচালনার পেছনে ফিলিস্তিন
কর্তৃপক্ষের অস্তিত্ব সংকটও জড়িত। ফিলিস্তিনের প্রেসিডেন্ট মাহমুদ আব্বাস হবু মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পকে বোঝাতে চাইছেন যে, তিনি ফিলিস্তিনসংক্রান্ত বিষয়গুলো পশ্চিমা ইচ্ছায় পরিচালনা করতে সক্ষম। এখন পর্যন্ত ইসরায়েলি কর্তৃপক্ষ এই দমন-পীড়নকে স্বাগত জানিয়েছে। ইসরায়েলের টেলিভিশন প্রতিবেদনে বলা হয়, ইসরায়েলি সেনাবাহিনী এই আক্রমণকে উৎসাহিত করেছে। এমনকি ফিলিস্তিন কর্তৃপক্ষ মিডিয়া ব্ল্যাকআউট করে হামলা চালাচ্ছে। পশ্চিম তীর থেকে আল-জাজিরার সম্প্রচার বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। আর এসবই ফিলিস্তিনিদের চোখে ইসরায়েলি দখলদার বাহিনীর ‘পাহারাদার’ চরিত্র।
সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন
© 2025 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh