গাজা ও মধ্যপ্রাচ্যের ভবিষ্যৎ কোনদিকে

দেড় বছরেরও বেশি সময় ধরে গাজায় একপেশে হামলা চালিয়ে আসছে ইসরায়েলি সেনারা। বিশ্ববাসীর উদ্বেগ যেন পাত্তাই দিচ্ছে না প্রধানমন্ত্রী বেঞ্জামিন নেতানিয়াহু নেতৃত্বাধীন সরকার। এদিকে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প তো চাইছেন গাজাকে খালি করে মার্কিন আবাসন পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করতে। এমন অবস্থায় প্রশ্ন থেকে যায়, গাজা ও মধ্যপ্রাচ্যের ভবিষ্যৎ তাহলে কোনোদিকে যাবে। 

নিজেদের জনগণের চাপে মিশর ও জর্ডান সরকার

ট্রাম্প চাইছেন, আরব বিশ্বের কোনো দেশ গাজার ফিলিস্তিনিদের স্থায়ীভাবে আশ্রয় দিক। যাতে তিনি সমুদ্রঘেঁষা এই উপত্যকায় আবাসন গড়ে তুলতে পারেন। তবে এখন পর্যন্ত কোনো আরব দেশ এ পরিকল্পনায় আগ্রহ দেখায়নি। বরং ইসরায়েল ও গাজা সীমান্তে ট্যাংক বহর মোতায়েন করেছে মিশর। যদিও দেশটির উদ্দেশ্য স্পষ্ট নয়। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে অনেকেই বলছেন, মিশরীয় জনগণকে শান্ত করতে দেশটির প্রেসিডেন্ট আবদেল ফাত্তাহ আল সিসি এমন উদ্যোগ নিয়েছেন। বাস্তবতা হলো, তিনি ইসরায়েলের সঙ্গে যুদ্ধে আগ্রহী নন। তবে মিশরীয় জনগণ ও অধস্তন সামরিক কর্মকর্তা ও সদস্যদের চাপ পরিস্থিতি যেকোনো সময় ঘুরিয়েও দিতে পারে। 

একই অবস্থা জর্ডানের ক্ষেত্রেও। দেশটির জনগণ সামরিক হস্তক্ষেপের দাবি জানাচ্ছে। সময় যত গড়াচ্ছে দুই দেশের সরকারই তাদের জনগণের থেকে চাপ অনুভব করছে। ফলে আঞ্চলিক যুদ্ধ শুরুর শঙ্কা বাড়ছে। 

হিজবুল্লাহকে কার্যত নির্মূল করেছে ইসরায়েল তবে লেবানন থেকে ইসরায়েলকে প্রতিরোধ করার সম্ভাবনা ক্ষীণ হয়ে এসেছে। কারণ গাজায় যুদ্ধ শুরুর পর একের পর এক হামলা চালিয়ে লেবাননের ইরানপন্থি শিয়া সশস্ত্র গোষ্ঠী হিজবুল্লাহর নেতা হাসান নাসরুল্লাহসহ প্রায় সব জ্যেষ্ঠ নেতাকে হত্যা করেছে ইসরায়েলি প্রতিরক্ষা বাহিনী (আইডিএফ)। ইসরায়েল সীমান্ত থেকেও গোষ্ঠীটির যোদ্ধারা সরে এসেছে। সেখানে মোতায়েন করা হয়েছে, লেবাননের নিজস্ব সেনা। 

হিজবুল্লাহ দুর্বল হয়ে যাওয়ায় এর প্রভাব পড়ে সিরিয়াতেও। দেশটির সাবেক প্রেসিডেন্ট বাশার আল আসাদের অবস্থান দুর্বল হয়ে পড়ে। ফলে আসাদকে হটিয়ে ক্ষমতায় আসে ইসলামপন্থি নেতা আহমেদ আল শারা। সঙ্গে সঙ্গেই গোলান মালভূমি দিয়ে সিরিয়ার ভূখণ্ডে প্রবেশ করে ইসরায়েলি সেনারা। এরপরই কার্যত দেশটি থেকে ইসরায়েলের ওপর রকেট হামলা চালানো বন্ধ হয়ে যায়। ইরানের বিপ্লবী রক্ষী বাহিনী আইআরজিসির সদস্যদেরও সেখান থেকে সরে আসতে হয়। ফলে সিরিয়া থেকেও ইসরায়েলের জন্য তেমন আর কোনো হুমকি রইল না। 

নিশ্চুপ সৌদি, আমিরাতের মতো আরব দেশ মিশর, জর্ডান ও কাতার বাদে আরব বিশ্বের বাকি দেশগুলোকে গাজা ইস্যু নিয়ে ইসরায়েলকে খুব একটা চাপ দিতে দেখা যাচ্ছে না। সৌদি আরবের কার্যত শাসক যুবরাজ মুহাম্মদ বিন সালমান গাজায় ইসরায়েলি হামলার নিন্দা জানিয়েছেন। তবে সমালোচকরা বলছেন, ট্রাম্পের সঙ্গে তার সম্পর্ক বেশ ভালো। ইসরায়েলকে বাগে আনতে তিনি এই সম্পর্কটা কাজে লাগাতে পারতেন। কিন্তু তাকে ইউক্রেন ও রাশিয়ার যুদ্ধ থামানোর চেষ্টার বিষয়ে বেশি আগ্রহী মনে হচ্ছে। 

একই অবস্থা মধ্যপ্রাচ্যের অন্যতম সম্পদশালী দেশ সংযুক্ত আরব আমিরাতের ক্ষেত্রেও। সম্প্রতি দেশটির পররাষ্ট্রমন্ত্রী ইসরায়েলের পররাষ্ট্রমন্ত্রীর সঙ্গে সাক্ষাৎ করেছেন। যুদ্ধবিরতি নিয়ে আমিরাতকে কখনোই সোচ্চার হতে দেখা যায়নি। উপসাগরীয় অঞ্চলের একমাত্র দেশ হিসেবে তারা ইসরায়েলের সঙ্গে সরাসরি সম্পর্ক রাখছে। 

ইয়েমেনের সশস্ত্র গোষ্ঠী হুতির ভূমিকা

গাজায় যুদ্ধ শুরুর পর থেকেই এর সঙ্গে জড়িয়ে যায় ইরানপন্থি লেবাননের সশস্ত্র সংগঠন হিজবুল্লাহ ও ইয়েমেনের শিয়া সশস্ত্র গোষ্ঠী হুতিরা। হিজবুল্লাহর একের পর এক রকেট হামলায় দক্ষিণ ইসরায়েল থেকে হাজার হাজার বাসিন্দাকে সরিয়ে নিতে বাধ্য হয় তেল আবিব। একই সঙ্গে লোহিত সাগরে ইসরায়েলের সঙ্গে সম্পর্কিত জাহাজগুলোর জন্য পণ্য বহন কঠিন করে দেয় হুতিরা। 

তবে ইসরায়েলি সেনারা নির্দয়ভাবে হামলা চালিয়ে হিজবুল্লাহকে প্রায় নিয়ন্ত্রণে নিয়ে এসেছে। এখন হুতিদের দমনে এগিয়ে এসেছে যুক্তরাষ্ট্র। এরই মধ্যে দেশটি গত দুই সপ্তাহেরও বেশি সময় ধরে ইয়েমেনে হুতি অবস্থান লক্ষ্য করে বোমা হামলা চালাচ্ছে। কমপক্ষে ৭০ জন ইয়েমেনি এরই মধ্যে নিহত হয়েছেন। ফলে নতুন করে হুতিদেরও আর জোরালো হামলা চালাতে দেখা যাচ্ছে না। 

ইরানকে এবার শায়েস্তা করতে চায় যুক্তরাষ্ট্র

গাজা যুদ্ধকে কেন্দ্র করে যে পরিবর্তিত পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছে, তা গত ২৫ বছরে সবচেয়ে দুর্বল অবস্থানে ঠেলে দিয়েছে ইরানকে। তাদের সমর্থিত বাহিনী হিজবুল্লাহ এরই মধ্যে কোণঠাসা। হুতিকে কেন্দ্র করে হামলা চালিয়ে যাচ্ছে যুক্তরাষ্ট্র। এদিকে মধ্যপ্রাচ্যে দেশটির প্রধান মিত্র বাশার আল আসাদ পলাতক। কার্যত সিরিয়ার ওপর তাদের আর কোনো নিয়ন্ত্রণ নেই। পাশাপাশি বাণিজ্যিক নিষেধাজ্ঞা ও অভ্যন্তরীণ বিভিন্ন ইস্যুতে টালমাটাল অবস্থায় দেশটির সরকার। 

ইউক্রেনে যুদ্ধ নিয়ে ব্যস্ত থাকায় রাশিয়াই বা মিত্র ইরানের বিপদে কতটুকু এগিয়ে আসতে পারে, তা নিয়েও প্রশ্ন দেখা দিয়েছে। এমন পরিস্থিতিতে যুক্তরাষ্ট্র বলছে, হয় পরমাণু কর্মসূচি ত্যাগ করতে হবে, নয়তো এমন বোমা হামলা চালানো হবে, যা ইরান কোনো দিন দেখেনি। 

ইরান সাফ জানিয়ে দিয়েছে, যেকোনো হামলার কার্যকর জবাব দেওয়া হবে। দেশটির সর্বোচ্চ নেতা আয়াতুল্লাহ আলি খামেনি সশস্ত্র বাহিনীকে সর্বোচ্চ সতর্কতাবস্থায় থাকার নির্দেশ দিয়েছেন। সমর বিশ্লেষকরা বড় আঞ্চলিক যুদ্ধের আশঙ্কা করছেন। শঙ্কা রয়েছে, গাজায় ইসরায়েলি সামরিক অভিযান শেষে এসে ইরান ও যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে যুদ্ধ শুরু হওয়ার কারণ হয়ে উঠতে পারে।

সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2025 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh