Logo
×

Follow Us

শোকাবহ আগস্ট

জাতীয় শোকদিবস ও বিপ্রতীপ ভাবনা

Icon

রফিকুর রশীদ

প্রকাশ: ০৩ আগস্ট ২০২৩, ১২:৩৪

জাতীয় শোকদিবস ও বিপ্রতীপ ভাবনা

ফাইল ছবি।

জাতীয় শোকদিবস সামনে রেখে কেন যে আমার মনে পড়ছে ‘সোনার পাথরবাটি’ কিংবা ‘কাঁঠালের আমসত্ত্ব’ প্রবচন দুটির কথা, সেই হিসেব মেলানো ভার। এমন শোকাচ্ছন্ন দিনে পঁচাত্তরের পনেরোই আগস্ট বঙ্গবন্ধুসহ আরও যারা শহীদ হয়েছেন, তাদের এই মর্মান্তিক মহাপ্রয়াণে গোটা জাতি গভীর শ্রদ্ধা ও সমবেদনায় স্মরণ করছে সেদিনের সকল শহীদকে, সেদিনের পৈশাচিক উন্মত্ততা ও বর্বরতার প্রতি সবাই ঘৃণা ব্যক্ত করছে; আমিও এ দলের বাইরে নই। তবু আজ আমার মনে খানিকটা বিপ্রতীপ ভাবনার উদয় কেন হচ্ছে, কে জানে!

আমি জানি, খুব ভালো করেই জানি- বঙ্গবন্ধুর এই বাংলাদেশের এক বিরাটসংখ্যক অধিবাসী শোকদিবস পালন করেন না, এর মর্ম তারা অনুধাবন করেন না, অন্তরে এই ভাবনা লালনও করেন না। এত বড় পৈশাচিক হত্যাকা-ের নিন্দা বা প্রতিবাদ করা দূরে থাক, দুর্বুদ্ধিপ্রণোদিত এবং ঈর্ষাপ্রসূত খোঁড়া যুক্তি দাঁড় করিয়ে তারা এই হত্যাকাণ্ডকে ন্যায্য প্রমাণ করতেও সচেষ্ট হন। এরা মোটেই বর্ণচোরা নন, জাতীয় রাজনীতিতে তাদের অবস্থান অত্যন্ত স্বচ্ছ। কাজেই তাদের কাছে কীইবা আশা করা যায় জাতীয় শোকদিবসে! 

তেইশ বছরের লড়াই সংগ্রাম এবং একাত্তরের মহান মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশে যে নতুন রাজনীতির সূচনা হয়, ঠিক তার উল্টো রাজনীতির জন্মদিন তো ওই পনেরোই আগস্টই বটে। শোকদিবস পালন না করুক, এই শোকাবহ দিনটির প্রতি সমীহ দেখানোর শিষ্টতাটুকুও তাদের কাছে প্রত্যাশা করা যায় না। এদের কথা থাক। তাদের এই অপারগতার জন্য বড়জোর করুণা প্রকাশ করা যায়। এর বেশি কিছু নয়।

আমরা যারা পঁচাত্তরের পর থেকে কখনো প্রকাশ্যে কখনো অপ্রকাশ্যে, অনুকূল কিংবা প্রতিকূল পরিবেশেও এই পনেরোই আগস্টে শোকদিবস পালন করে চলেছি, তাদের অবস্থান নিয়েই আজকের এই দিনে দুকথা বলাটা (ঝুঁকিপূর্ণ হলেও) খুব জরুরি। কাঁঠালের আমসত্ত্ব লুকিয়ে আছে এখানেই।

আগস্ট-ট্র্যাজেডি যারা ঘটিয়েছে তারা দেশের রাষ্ট্রপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এবং তার উত্তরাধিকারীদের শারীরিকভাবে হত্যা করেই নিরস্ত হয়নি, সদ্যস্বাধীন বাংলাদেশের গতিমুখটাই ঘুরিয়ে দিতে চেয়েছে, এ জন্য যা যা করণীয় তার সবই করেছে নিপুণ এবং নির্মমভাবে।

তিরিশ লাখ শহীদের রক্তে ধোয়া সংবিধান স্থগিত করা হয়েছে। প্রতিবাদ দূরে থাক, ঘরের বাইরে বেরুনো নিষিদ্ধ করা হয়েছে। আওয়ামী লীগের হাজার হাজার নেতাকর্মী নির্বিচারে গ্রেপ্তার হয়েছে। জাতীয় চার নেতাকে জেলখানার ভেতরে হত্যা করা হয়েছে। সর্বোপরি বঙ্গবন্ধু হত্যা এবং জেলহত্যার বিচারের পথও বন্ধ করা হয়েছে। জাতীয় জাগরণ এবং মুক্তিযুদ্ধের অবিস্মরণীয় স্লোগান জয়বাংলা নিষিদ্ধ, ফিরে এলো জিন্দাবাদ, বাংলাদেশ বেতার হয়ে গেল রেডিও বাংলাদেশ। এই রকম আরও কত কী! সব আয়োজনের একটি মাত্র উদ্দেশ্য। বাংলাদেশের মানুষের দীর্ঘকালের লড়াই সংগ্রামের গৌরবোজ্জ্বল ইতিহাস মুছে দেওয়া। বাঙালির আপসহীন নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব সাম্প্রদায়িক রাষ্ট্র পাকিস্তানের পেটের ভেতর থেকে যে অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশের অভ্যুদয় ঘটিয়েছিলেন, চিরকালের সেই অসাম্প্রদায়িক ঐতিহ্য থেকে বাঙালিকে সরিয়ে দেওয়া, সমাজতন্ত্র অভিমুখী অর্থনৈতিক অভিযাত্রা স্তব্ধ করে দেওয়া, সর্বজনীন গণতান্ত্রিক ব্যবস্থাকে হ্যাঁ-না এর বাক্সে বন্দি করা- এই সব কিছু মিলিয়ে মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে অর্জিত সব কিছু বর্জন করে বঙ্গবন্ধুর স্বপ্ন ও আদর্শ বাতিল করা। শারীরিকভাবে বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যার চেয়েও আদর্শিকভাবে ধ্বংস করা তাদের কাছে মোটেই কম জরুরি ছিল না। ঘাতকচক্র বাঙালির চেতনা থেকে এবং বাংলাদেশের হৃদয় থেকে বঙ্গবন্ধুর নাম-নিশানা সমূলে উৎপাটনের চেষ্টা করেছে।

দীর্ঘ একুশ বছর পর বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনার সুযোগ্য নেতৃত্বে বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের সোনার বাংলা গড়ে তোলার এবং দুঃখী মানুষের মুখে হাসি ফোটাবার নতুন লড়াই শুরু হয়। এরই মাঝে দেশের নানামুখী উন্নয়ন দৃশ্যমান হয়ে উঠেছে এবং সচেতন বিশ্বের দৃষ্টি আকর্ষণে সক্ষমও হয়েছে। তবু প্রশ্ন থেকে যায়- পঁচাত্তরের পনেরোই আগস্ট পর্যন্ত বঙ্গবন্ধু তার বাংলাদেশকে যে চারিত্র্যে এবং মর্যাদায় দাঁড় করিয়ে গিয়েছিলেন, স্বাধীনতার অর্ধ শতাব্দী পেরিয়ে যাবার পরও আমরা কি সেখানে পৌঁছতে পেরেছি? আমরা কি পেরেছি বাহাত্তরের সংবিধানে ফিরে যেতে? পেরেছি কুদরত ই খুদা শিক্ষা কমিশনের সুপারিশের আলোকে শিক্ষানীতি গ্রহণ করতে? সংবিধানে ধর্মনিরপেক্ষতা রেখেও স্বৈরাচারী এক শাসকের চাপিয়ে দেওয়া রাষ্ট্রধর্ম বহন করে চলেছি আমরা নির্বিকারে। এখান থেকে বেরিয়ে আসার কোনো আকাক্সক্ষাও প্রতিফলিত হয় না কারও কর্মসূচিতে। বরং রাষ্ট্রীয় আশকারা পেয়ে মাদ্রাসা শিক্ষা এবং ধর্মভিত্তিক রাজনীতি দিনে দিনে রমরমা হয়ে উঠছে, এ কথা অস্বীকার করার উপায় নেই। আর তারই সূত্র ধরে সাম্প্রদায়িক অসহিষ্ণুতা ও অবিশ্বাস বেড়েই চলেছে। এমনটি কি কখনো চেয়েছিলেন বঙ্গবন্ধু? আমরা যারা বঙ্গবন্ধুর স্বপ্ন ও আদর্শ নিয়ে গর্ব করি, এ ক্ষেত্রে তাদের কি কিছুই করণীয় নেই? জাতীয় শোকদিবস পালনের নামে পাড়ায় মহল্লায় কাঙালিভোজ আর মিলাদ মাহফিল করে সত্যিই কি বাঙালির শ্রেষ্ঠ নেতা বঙ্গবন্ধুর আত্মার শান্তি প্রত্যাশা করা যায়? এখানে এসে আমার মনে পড়ে যায় সোনার পাথরবাটি অথবা কাঁঠালের আমসত্ত্বের কথা। এমন অন্তঃসারশূন্য বৈপরীত্য দিয়ে বঙ্গবন্ধুর প্রতি সত্যিকারের শ্রদ্ধা জানানো যায় বলে আমার মনে হয় না।

বঙ্গবন্ধু আজীবন জনমতের মূল্য দিয়েছেন। এ দেশের গণমানুষের মুক্তির আকাক্সক্ষা বাস্তবায়নে তিনি নিজেকে উৎসর্গ করেছেন এবং স্বাধীন বাংলাদেশ উপহার দিয়েছেন। সেই রাষ্ট্র কোন আদর্শ ও লক্ষ্য নিয়ে পরিচালিত হবে তার পথনির্দেশও দিয়েছেন সদ্য স্বাধীন দেশের প্রথম সংবিধানে। শোকদিবসে প্রকৃত শ্রদ্ধা জানাতে হলে তার আদর্শ অনুসরণ করে অসমাপ্ত কাজ বাস্তবায়নের মাধ্যমে সোনার বাংলা গড়ে তুলতে হবে। সে ক্ষেত্রে বঙ্গবন্ধুপ্রণীত সংবিধানই হতে পারে চালিকাশক্তি। প্রবল প্রতিকূলতা পাড়ি দিয়ে মুক্তিযুদ্ধ শেষে বঙ্গবন্ধু যে অসামান্য সংবিধান উপহার দিয়েছেন, আজকের এই অনুকূল পরিবেশে সেই সংবিধান বাস্তবায়নের পক্ষে জনমত গড়ে তুলতে পারলে বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনার নেতৃত্বেই বঙ্গবন্ধুর স্বপ্ন পূরণ সম্ভব হবে। তাহলেই শোকদিবসে বঙ্গবন্ধুকে যথার্থ সম্মান জানানো হবে। নইলে ‘সোনার পাথারবাটি’তে আটকে যাবে শোকদিবসের সব আয়োজন।


Logo

সম্পাদক ও প্রকাশক: ইলিয়াস উদ্দিন পলাশ

বার্তা ও বাণিজ্যিক কার্যালয়: ফেয়ার দিয়া ১১/৮/ই, ফ্রি স্কুল স্ট্রিট (লেভেল-৮), বক্স কালভার্ট রোড, পান্থপথ, ঢাকা ১২০৫