বঙ্গবন্ধু হত্যার খবরে হতভম্ব হয়ে পড়ে টুঙ্গিপাড়াবাসী

ডেস্ক রিপোর্ট
প্রকাশ: ২৮ আগস্ট ২০২১, ১০:০৪

টুঙ্গিপাড়ায় বঙ্গবন্ধুর সমাধিস্থল। ফাইল ছবি
১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট সকালে ওয়্যারলেসের মাধ্যমে প্রথমে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে হত্যার খবর জানানো হয়। বারবার ওয়্যারলেসে বলা হয়, স্বৈরশাসক সরকারের পতন হয়েছে।
বঙ্গবন্ধুকে হত্যার খবর টুঙ্গিপাড়ায় ছড়িয়ে পড়লে হতভম্ব হয়ে পরেন টুঙ্গিপাড়াবাসী। কেউ যেন বিশ্বাসই করছিলেন না। এমন কথাই জানান বঙ্গবন্ধুর দাফনকারী কয়েকজন। বঙ্গবন্ধুকে যে ১৮ জন দাফন করছেন তার মধ্যে অন্যতম কাজী ইদ্রিস আলী (৭১) ও আইয়ুব আলী মিস্ত্রী (৫৫)।
গোপালগঞ্জ জেলার টুঙ্গিপাড়া ছিল অপরিচিত একটি গ্রাম। বনেদী পরিবারের বসবাস ছিল হাতে গোনা মাত্র দু-একটি। তার মধ্যে একটি বনেদী পরিবারের নাম শেখ পরিবার। এই পরিবারের উত্তরসূরী শেখ হামিদ। শেখ হামিদের একমাত্র ছেলে শেখ লুৎফর রহমান। ১৯২০ সালের ১৭ মার্চ শেখ লুৎফর রহমান ও তার স্ত্রী শেখ সায়রা খাতুনের ঘরে জন্ম নেন এক শিশু। মা-বাবা নাম রাখেন খোকা। আদরের এই খোকাই হলেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, পরবর্তীতে জাতির পিতা এবং সমগ্র বাঙালির প্রিয় মানুষ ও মুক্তিদাতা।
সেই থেকে গোপালগঞ্জ একটি ঐতিহাসিক জনপদ। রাজনৈতিক গুরুত্বে ও লোকজ-সাংস্কৃতিক সমাবেশে গোপালগঞ্জ হচ্ছে ইতিহাসের এক গুরুত্বপূর্ণ স্থান। মধুমতি বিধৌত এ জনপদের রয়েছে সুপ্রাচীন ঐতিহ্য। গোপালগঞ্জের টুঙ্গিপাড়া এখন ইতিহাসের এক অম্লান পাদপিট। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার জন্মস্থানও টুঙ্গিপাড়ায়। এখানে রয়েছে জাতির পিতার সমাধি সৌধ ও কমপ্লেক্স। এটি একটি দর্শনীয় ও পর্যটন কেন্দ্র হিসেবে এরমধ্যে দেশবাসীর কাছে পরিগণিত হয়েছে। প্রতিদিন হাজার হাজার দর্শনার্থী আসেন এখানে। ঘুরে ঘুরে দেখেন জাতির পিতার সমাধি ও আশপাশ এলাকা।
১৯৭১ সালে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ডাকে স্বাধীনতা যুদ্ধ করে বীর বাঙালি। ৯ মাসের রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ শেষে পাক হানাদারের কাছ থেকে লাল-সবুজের পতাকা ছিনিয়ে আনে। যুদ্ধ বিধস্ত বাংলাদেশে যখন পুনঃগঠনের কাজ শুরুর করেন, ঠিক সে সময়ে ৭৫ এর ১৫ আগস্টে জাতির পিতাকে সপরিবারে হত্যা করে বিপথগামী একদল সেনা সদস্য। এরপর তার লাশ নিয়ে আসা হয় গোপলগঞ্জের টুঙ্গিপাড়ায়। দাফন করা হয় মা-বাবার কবরের পাশে।
বঙ্গবন্ধুর লাশ দাফনকারী কাজী ইদ্রিস আলী বলেন, ‘একটি হেলিকপ্টারে করে বঙ্গবন্ধুর লাশ নিয়ে আসে সেনাবাহিনী। বঙ্গবন্ধুকে আনার পর টুঙ্গিপাড়ার পরিস্থিতি ছিল থমথমে। অনেক প্রভাবশালী লোকজন ভয়ে এলাকা ছেড়ে পালিয়ে গিয়েছিল। পুরো এলাকায় আতঙ্ক ও ভীতি ছড়িয়ে পরে। এরপর থানার এক পুলিশ কর্মকর্তা দাফনের জন্য তাকেসহ ১৮ জনকে নিয়ে যান। পরে হেলিকপ্টার থেকে খোলা মাঠে (বর্তমানে সমাধি সৌধ কমপ্লেক্স) বঙ্গবন্ধুর লাশবাহী কফিন নামানো হয়। এসময় তারা তখনই লাশ দাফনের কথা বলেন। তখন কফিন খোলার জন্য মিস্ত্রি আব্দুল হামিদকে ডাকা হলেও তিনি বাড়িতে না থাকায় দায়িত্ব পরে তার ছেলে শেখ আইয়ূব আলীর ওপর। আইয়ূব আলীর এসে কফিন খোলেন। কফিনে বঙ্গবন্ধুর লাশ ছিল সাদা কাপড় দিয়ে ঢাকা। কাপড় সড়িয়ে দেখা যায় চশমাটি ছিল ডান পাশে ভাঙ্গা অবস্থায়। গুলিতে বুক ঝাঁঝড়া ঝাঁঝরা হয়েছিল।’
তিনি বলেন, ‘পাশের একটি পুকুর থেকে পানি এনে রক্ত ধোয়া হয়। দ্রুত দাফন করা কথা বললেও গোসল না করিয়ে ও জানাজা না পড়িয়ে দাফন করতে অস্বীকার করেন মৌলভী সাহেব। তখন তারা দ্রুত করার কথা বলেন। পরে পাশের একটি দোকান থেকে ৫৭০ সাবান এনে গোসল করানো হয়। এরপর রিলিফের একটি সাদা কাপড় দিয়ে পড়ানো হয় কাফন। বঙ্গবন্ধুর জানাজাতে অংশ নেন মাত্র ৩০ জন। বঙ্গবন্ধুকে যখন হত্যা করা হয় ও দাফন করা হয় তখন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ছিলেন বিদেশে। এখন মনে পড়লে এখন কষ্ট পাই।’
বঙ্গবন্ধুর লাশবহনকারী কফিন খোলেন আইয়ুব আলী মিস্ত্রী (৫৫)। তিনি বলেন, ‘বঙ্গবন্ধুর লাশ টুঙ্গিপাড়া আনার পর কফিন খোলার জন্য আমার বাবাকে ডাকা হয়। কিন্তু বাবা বাড়ি না থাকায় সেই দায়িত্ব পরে আমার ওপর। বঙ্গবন্ধুর কফিনের কাছে গিয়ে বঙ্গবন্ধুর কফিনের কাছে কয়েকজন দাঁড়িয়ে আছেন। পরে আমি হাতুর ও ছেনি দিয়ে কফিনটি খুলি। দেখি বঙ্গবন্ধুর বুকের ওপর একটি সাদা কাপড়। পরে বঙ্গবন্ধুর লাশ কফিন থেকে নিচে নামলে দেখি বঙ্গবন্ধু একটি পাঞ্জাবি গায়ে আর সাদা একটি লুঙ্গি পরা। বঙ্গবন্ধুর বুকে ও হাতে গুলি। মাত্র ৩০ থেকে ৩৫ জন লোক নিয়ে বঙ্গবন্ধুর জানাজা হয়।’
শেখ পরিবারের সদস্য ও টুঙ্গিপাড়ার পৌরসভার মেয়র শেখ তোজাম্মেল হক টুটুল জানান, বঙ্গবন্ধু সব সময় ছিলেন হাস্যজ্জ্বল। পরের কষ্ট সহ্য করতে পারতেন না। একজন দেশ প্রেমিক, দেশের স্থাপতিকে হত্যা করা হয়েছে।