
নিম অন্নপূর্ণা চলচ্চিত্রের একটি দৃশ্য
বুদ্ধদেব দাশগুপ্তর হাতে বাস্তবিকই চলচ্চিত্র হয়েছে, ‘নিম অন্নপূর্ণা’। কমলকুমার মজুমদারের গল্পের ভীষণ অথচ বাস্তব বস্তু তিনি দেখিয়েছেন নিরেট সিনেমার শর্তে। দারিদ্র্যের সাংঘাতিক চেহারা দেখাতে গিয়ে পরিচালক একটু-আধটু স্বস্তির মুহূর্তও একেবারে ঘুষ দিতে চাননি। এক্ষেত্রে তিনি কঠোর এবং আপোষহীন। হয়তো এই ছবি দেখার স্বার্থকতা তাঁরাই বেশি অনুভব করবেন যাঁদের কাছে সৎ সিনেমা সতত আদরণীয় এবং যাঁরা খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে সিনেমার কাজটুকুকেই প্রধান করে দেখেন। না হলে অভুক্তের কষ্টও কিছুটা ন্যায্য লোভ এবং দু’মুঠো চালের জন্য হন্যে হয়ে ঘুরে বেড়ানোর মধ্যে নতুন দেখবার আর কী আছে? নিম অন্নপূর্ণায় তাও রয়েছে।
এই ছবির অন্নপূর্ণা, অভাবের সংসারের কর্ত্রী, বুড়ো ভিখারির ঝুলি থেকে জোগাড় করা চাল দিয়ে স্বামী-কন্যাদের ক্ষুধা মেটাতে পারলেও নিজে সেটা গিলতে পারল না। সেটা তার গলা দিয়ে বমি হয়ে বেরিয়ে আসে। নায়িকার মনে ও শরীরে গরম ভাতের এই তীক্ষ্ণ প্রতিক্রিয়া (নাকি বিষক্রিয়া) দেখিয়ে পরিচালক মূল গল্পবস্তুকে শিল্পশর্তাধীন অস্পষ্টতা ও বুদ্ধিদীপ্ত ব্যঞ্জনায় উপস্থিত করেছেন। গল্পের কিংবা পরিচালকের অন্নপূর্ণা ভিখারির ঝুলি ভরে দিতে পারেনি। ভিখারি মরে যাবার পর তার থলে সরিয়ে নিয়েছে। আগেই সেটা সে চুরি করার ইচ্ছেয় ছিল কিংবা কেড়ে নিতে চেয়েছিল। ধস্তাধস্তিতে বুড়ো মারা যেতেই বুঝি অপরাধবোধে আক্রান্ত হন মহিলা।
গল্পটা নিয়ে বুদ্ধদেব নাটক তৈরি করতে পারতেন; কিন্তু তিনি সে প্রলোভনের রাশ টেনে ধরেছেন, অথচ একটা দুঃখের অনুভূতি তিনি সঞ্চার করে দিয়েছেন অতি সহজেই। তিনি আগেই বদ্ধপরিকর ছিলেন কোনোরকম ভাবালুতার প্রশ্রয় দেবেন না। সেটা বিন্দুবিসর্গও নেই। তবুও যেন অতীতের সুখ ও স্বপ্নের কিছুটা আভাস নায়িকার দীর্ঘশ্বাসে মিশে থাকে। পাশের ঘরে ‘যদি আপনার মনে মাধুরী’ বেসুরো গান শুনে তার অতীত বুঝি উঁকি দিয়ে যায়। শুধু ক্লেশ আর কষ্ট নয়, তার মাঝখানে বিফল স্বপ্ন ও অপূর্ণ সাধের ঝিলিক দেখা দিয়েই আবার মিলিয়ে গেছে। ছোট মেয়েটি কালো চশমা পরা লোকটির সঙ্গ অনুভব করে তার কল্পনায়। তার গায়ে খাবারের গন্ধ। নির্মম পরিবেশে, ভাতের গন্ধ খুঁজে বেড়ায় সকলে। কমনীয়তাকে প্রশ্রয় না দিয়ে কঠিন বাস্তবে ফিরে আসেন পরিচালক সঙ্গে সঙ্গে। তবু শুধু তাদের দারিদ্র্য নয়, পুরো মানুষগুলোকেই দেখাতে চেয়েছেন পরিচালক। এইখানেই নিম অন্নপূর্ণা একটা হিউম্যান ডকুমেন্টে রূপ নিয়েছে।
অন্যদিকে অতি সুঠাম ও সুসামঞ্জস্য চিত্রনাট্যে, যেখানে কোনো দৃশ্যই অবান্তর বা অর্থহীন মনে হয় না, বিশেষ করে পরিবেশের চিত্রটি নিখুঁতভাবে দেখিয়েছেন পরিচালক। সেই সঙ্গে সেখানকার জীবন অধরা ও লোকজনের স্বভাব-চরিত্রের ছবিও ক্ষুদ্র আঁচড়ে এঁকে দিয়েছেন। আবার নোংরা পরিবেশ থেকে কখনো-সখনো সরে গিয়ে ছবির ক্যামেরা ভিজ্যুয়াল সৌন্দর্যও খুঁজে নিয়েছে।
এই গল্পের স্বভাব ও বক্তব্য অনুযায়ী প্রত্যেক শিল্পীই-মণিদীপা রায়, সুনীল মুখোপাধ্যায়, জয়িতা সরকার, ভাস্বতী দাশগুপ্ত, মনোজিৎ লাহিড়ী- বাস্তব চরিত্র হয়ে উঠেছেন। অভাবের সংসারে মণিদীপার স্বাস্থ্য একটু ভালো দেখালেও অভিনয়ের গুণে সেটা চাপা পড়ে। পরিচালনায় যে সংযম ও পরিমিতিবোধ- সেটা শিল্পীদেরও স্পর্শ করেছে, সংগীতকেও। ছবিটি দেখে কখনো মনে হয় না পরিচালক কিছু বলবার জন্য অস্থির হয়ে উঠেছেন। অথচ বক্তব্য সাবলীল হয়ে উঠেছে দৃশ্য থেকে দৃশ্যান্তরে। ব্যঙ্গ অতি সূক্ষ্ম হয়ে উঠেছে নেপথ্যে ‘সারা জঁহা সে আচ্ছা’ গানের সুরে। শিল্পগুণে ‘নিম অন্নপূর্ণা’ আজ একালেরও নতুন ধারার ছবির তালিকায় ওপরের দিকে বিশিষ্ট সংযোজন হয়ে রয়েছে। নিম অন্নপূর্ণা- এখনো সে নতুন, যেন আজকের।