চলচ্চিত্র শিল্পের ইতিহাসে প্রথম ক্ল্যাসিক রূপে চিহ্নিত হয়ে আছে ১৯১৪ সালে তৈরি ছবি ডেভিড ওয়ার্ক গ্রিফিথের ‘বার্থ অব এ নেশন’। লোকজনের ধারণায় সিনেমা তখন এক মজার খেলা। কিছু অতিউৎসাহী যন্ত্রবিদের খামখেয়ালি পরীক্ষা-নিরীক্ষার মাধ্যম। কয়েক মুহূর্তের ক্ষণস্থায়ী আনন্দ উপভোগ করতে সিনেমা দেখতো মানুষ। সেলুলয়েডের বুকে একইসাথে চিন্তার উপাদান এবং শৈলীর সৌষ্ঠব তখনো অজ্ঞাত। এরই মধ্যে ফ্রান্সে ডর্জে মেলিয়ে বিচিত্র কারিগরি কৌশলে গড়ে তুলেছিলেন চমকপ্রদ এক রূপের জগৎ, যেখানে প্রতি মুহূর্তে বিস্ময়ের ছটা। আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্রে ছিলেন এডউইন পোর্টার। নানা বাস্তব উপাখ্যানকে নাটকীয় ভঙ্গিতে রূপায়িত করতেন তিনি।
চলচ্চিত্র-ব্যাকরণের প্রথম সুসংবদ্ধ রূপটি পোর্টারই দিয়েছিলেন। একটি দৃশ্যের বিভিন্ন অংশের গুরুত্ব অনুযায়ী ‘ক্লোজ শট’, বা ‘লং শট’-এর ব্যবহার অথবা ‘প্যানিং’ নামক ক্যামেরা ঘোরানের কৌশল তারই উদ্ভাবন। আবার সম্পাদনার সাহায্যে বিভিন্ন খণ্ডদৃশ্য বা শটকে একটি সুসংহত বক্তব্যে গ্রথিত করার কাজেও পথিকৃৎ পোর্টার। তবে এই দু’জনের উদ্ভাবনী ক্ষমতা ও দক্ষতা যতই থাকুক, কল্পনার বিস্তার এঁদের ছিল না। সিনেমায় দৃশ্যগত আবেদনের বাইরে এমন কোনো সূক্ষ্ম সংবেদন তৈরিতে সফল হননি তারা। যাতে দর্শকের বোধ, অনুভূতি ও কল্পনার রাজ্যে ওঠে তীব্র আলোড়ন। অনাস্বাদিত সেই গভীরতা সিনেমায় প্রথম নিয়ে এলেন গ্রিফিথ, তার ‘বার্থ অব এ নেশন’ ছবিতে। এখানে পরিচালকের উদ্ভাবনী ক্ষমতার সাথে পাল্লা দিয়েছে তার মনন। পোর্টারকে যদি বলি সিনেমার প্রথম বৈয়াকরণ, গ্রিফিথ তাহলে সিনেমার জগতে প্রথম সাহিত্যিক। মেলিয়ে-পোর্টার উদ্ভাবক, গ্রিফিথ স্রোষ্টা।
‘বার্থ অব এ নেশন’ গ্রিফিথের প্রথম ছবি নয়। ১৯০৮ সাল থেকে ১৯১২ সাল পর্যন্ত পাঁচ বছরে প্রায় সাড়ে চারশ’ ছবি করেছিলেন তিনি। সেইসব ছবিতে আঙ্গিক নিয়ে কত যে পরীক্ষা-নিরীক্ষা চালিয়েছিলেন, ইয়ত্তা নেই তার। এটা তার শিক্ষানবিসের সময় ছিল। তখন এক কোম্পানি মালিকের কর্মচারী হিসেবে কাজ করতে হয়েছে তাকে। দাসত্ব থেকে মুক্তি নিয়ে স্বাধীন প্রযোজনায় গ্রিফিথ আত্মনিয়োগ করলেন এই ‘বার্থ অব এ নেশন’ ছবিতেই। নিজের আবেগ ও মননের সবটুকুই দিলেন উজাড় করে। ছবির নির্মাণ ও সংগঠনের সমস্ত দিক নিয়ন্ত্রণ করেছেন গ্রিফিথ স্বয়ং। এমনকি ছবির জন্য প্রয়োজনীয় সেট তৈরির কাজটিও তিনি ব্যক্তিগত তত্ত্বাবধানে সম্পন্ন করেছিলেন। শুটিং চলেছিল চার মাস। এর মধ্যে প্রথম ছ-সপ্তাহ অভিনেতাদের মহলা করিয়েছিলেন গ্রিফিথ। ছবিতে অসংখ্য চরিত্র। একই অভিনেতাকে দিয়ে অনেকগুলো চরিত্র অভিনয় করিয়ে গ্রিফিথ লোকসমস্যার সমাধান করেছিলেন।
ছবির পটভূমি ১৮৬১-৬৫ সালব্যাপী আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্রের গৃহযুদ্ধ। রাষ্ট্রপতি আব্রাহাম লিঙ্কনের নেতৃত্বে ঐক্যপন্থি উত্তরাঞ্চল ও জেফারসন ডেভিসের নেতৃত্বে বিচ্ছিন্নতাকামী দক্ষিণাঞ্চলের এই সংঘর্ষে দক্ষিণাঞ্চল পরাজিত হয়েছিল। বিজিত পক্ষের এক শ্বেতকায় জমিদার পরিবার এবং সেই পরিবার-সংশ্লিষ্ট দুই জোড়া প্রেমিকের জীবনে এই রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষের প্রতিক্রিয়া নিয়েই গড়ে উঠেছে ছবির আখ্যানভাগ। এরই পাশাপাশি গ্রিফিথ অকপটে প্রকাশ করেছেন মার্কিন জাতীয়তাবাদের স্বরূপ বিষয়ে তার নিজস্ব ধ্যান-ধারণা।
প্রাসঙ্গিক বোধেই তাই ছবিতে এসেছে লিঙ্কন-হত্যা, দক্ষিণের তুলো-কেন্দ্রিক সামন্ত-অর্থনীতি, উত্তরের পুঁজিবাদী বিকাশ, দাস-মজুর ও ‘স্বাধীন’-মজুরদের তুলনা, গণতান্ত্রিক রাজনীতির প্রক্রিয়া, চরমপন্থি ‘ক্লু ক্ল্যাস্ক ক্ল্যান’-এর অভ্যুত্থান প্রভৃতি বিষয়। বিষয়ের এই বিস্তার একমাত্র কথাসাহিত্যের সাথেই তুলনীয় আর সেই তুলনায় ও উপন্যাসের কথাই মনে আসে উপমান হিসেবে। মূল অবলম্বনও ছিল একটি উপন্যাস- টমাস ডিকসনের ‘দ্য ক্ল্যানসমেন’। ছবির নামও প্রথমে ছিল ‘দ্য ক্ল্যানসমেন’। পরে গ্রিফিথ সে-নাম বদলে দিয়েছিলেন।
সাহসী ছিলেন গ্রিফিথ। সমসাময়িক রীতি যেখানে পাঁচ বা ছয় রিলের ছবি তোলা, ‘বার্থ অব এ নেশন’কে গ্রিফিথ করলেন বারো রিলের ছবি। ছবির সময় গিয়ে দাঁড়াল প্রায় পৌনে তিন ঘণ্টায়। ছবি তৈরি করতে লেগেছিল এক লক্ষ ডলারের বেশি অর্থ- সে যুগে এক অভাবনীয় অঙ্ক; কিন্তু এই বিরাট ঝুঁকির সার্থকতা বিষয়ে সমস্ত সন্দেহকে অমূলক প্রমাণ করে কয়েক মাসের মধ্যেই এ ছবি থেকে আয় হয়েছিল এক কোটি আশি লাখ ডলার। কোনো লিখিত চিত্রনাট্য বা সুপরিকল্পিত শুটিং-স্ক্রিপ্ট ছাড়াই এ-ছবির কাজ হয়েছিল। অবশ্য এটাই ছিল হলিউডের সমসাময়িক রীতি। তাৎক্ষণিক বক্তব্য প্রকাশের তাগিদটাই যেখানে মুখ্য সেখানে বিস্তারিত পূর্ব-পরিকল্পনার দরকারই বা কী? কিন্তু ‘বার্থ অব এ নেশন’-এর ক্ষেত্রে ব্যাপারটা তো তা নয়। এখানে আছে একটা নির্দিষ্ট বক্তব্য, ব্যাপক পটভূমি এবং অসংখ্য খুঁটিনাটি বিষয়। তবু কোনো পূর্ব-প্রস্তুতির প্রয়োজন বোধ করেননি গ্রিফিথ।
পরিচালকের ব্যক্তিগত তত্ত্বাবধানে সম্পাদনার কাজ শেষ হওয়ার পর দেখা গেল, ছবিতে মোট এক হাজার ৩৭৫টি শট ব্যবহার করা হয়েছে। মনে হয় অন্যূন দুই হাজার শট নিয়েছিলেন গ্রিফিথ তার সমগ্র শুটিং পর্বে। তদানীন্তন হলিউড প্রথার পরিপ্রেক্ষিতে এ এক বিপ্লব। চলচ্চিত্র-ক্যামেরার গতিশীলতাকে কীভাবে তিনি কাজে লাগিয়েছিলেন, এর থেকেই তা স্পষ্ট হয়ে ওঠে। সেই প্রথম যুগের ক্যামেরা এবং আনুষঙ্গিক যন্ত্রপাতি শুধু যে ভারিই ছিল তা নয়, তাদের সুযোগ-সুবিধায়ও ছিল সীমাবদ্ধ। গ্রিফিথের সমসাময়িক পরিচালকদের প্রায় সবারই তাদের ছবির প্রতিটি শটকে যথাসম্ভব দীর্ঘস্থায়ী করার চেষ্টা করতেন, যাতে একটি শর্টের মধ্যেই কোনো ঘটনার পুরোটা ধরে রাখা যায়। ফলে পাঁচ, ছয়, এমন কি দশ মিনিটের শটও সে-যুগের ছবিতে খুব সাধারণ ঘঁনা; কিন্তু ‘বার্থ অব এ নেশন’-এ প্রতিটি শটের স্থায়িত্ব গড়ে সাত সেকেন্ড। এটা অবশ্য নিছক পাটিগণিতের হিসাব। পৌনে তিন ঘণ্টার ছবি মানে নয় হাজার ৯০০ সেকেন্ডের ব্যাপার। সেকেন্ডের সংখ্যাকে ব্যবহৃত শটের সংখ্যা দিয়ে ভাগ করলেই পেয়ে যাই প্রতিটি শটের গড় স্থায়িত্ব; কিন্তু ছবির প্রতিটি শটই সাত সেকেন্ডের মতো স্থায়ী হয়েছিল, এরকম ভাবা ভুল হবে।
এদেরই মধ্যে কোনো-কোনোটা নিশ্চয়ই ছিল আরো অনেক কম সময়ের শট, আবার কোনোটা একটু বেশি সময়ের। তবে সাধারণভাবে যে ছোট ছোট শট নিয়েই গ্রিফিথ কাজ করেছিলেন, অংকের হিসেব থেকে তা পরিষ্কার হয়। ঘটনার ক্রিয়াকে বিশেষ একটি ভাবের বাহক করার ওপরেই গ্রিফিথ গুরুত্ব আরোপ করেছিলেন। একটি ঘটনার সবটুকু দেখানোর কোনো তাগিদই তার ছিল না। অনাবশ্যক বাহুল্য বর্জন করে ঘটনার অপরিহার্য ও ইঙ্গিতবাহী কয়েকটি টুকরো তিনি বেছে নিয়েছিলেন। প্রতিটি দৃশ্যের অলঙ্করণ ও বিন্যাসে ছিলেন অসাধারণ মনোযোগী। ফলে কোনো ক্রিয়ার অংশবিশেষ রূপায়িত হলেও প্রতিটি দৃশ্যেই এলো কোনো না কোনো ব্যঞ্জনা। অল্প কথায় বলা হলো অনেক কিছু। শটের মধ্যে এই সংহতি (Compression) চলচ্চিত্র ভাষায় এনে দিল অভূতপূর্ব স্বচ্ছতা।
ছোট ছোট শটের সংহতিকে গ্রিফিথ লাগালেন ভাববিস্তারের কাজে। ছবিতে দৃশ্য পরম্পরায় একটা সাংগীতিক বিন্যাস, একটা সুন্দর ছন্দ তিনি তৈরি করলেন। এই সম্পাদন রীতি গ্রিফিথ ব্যবহার করেছিলেন বিষয়বস্তুরই বিশেষ প্রয়োজনে। দৃশ্যগুলো যাতে নিছক সাংবাদিকের বর্ণনা না হয়ে যায় সেদিকেও লক্ষ্য ছিল তার। দৃশ্যবিন্যাসের এই ভঙ্গিটি বিপ্লবোত্তর রাশিয়ার বিশিষ্ট চলচ্চিত্রকারদের অনুপ্রেরণা জুগিয়েছিল। কুলেশেভ, আইজেনস্টাইন, পুদোভকিনের হাতে যে মন্তাজ পদ্ধতির পূর্ণবিকাশ, ‘বার্থ অব এ নেশন’ সম্পাদনার সময়েই তার বীজ রোপণ করেছিলেন গ্রিফিথ। আর দৃশ্য পরম্পরায় সাংগীতিক ছন্দ তৈরি করেই তিনি ক্ষান্ত হননি। সুরকার জোসেফ কার্ল ব্রাইলের সহযোগিতায় ছবির সাথে অর্কেষ্ট্রায় বাজানোর জন্য আবহসংগীতের একটি খসড়া তৈরি করে বিভিন্ন সিনেমা হলে তিনি পাঠিয়ে দিয়েছিলেন।
বিষয় : হিরণ নূর চলচ্চিত্র বার্থ অব এ নেশন
© 2022 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh