Logo
×

Follow Us

সংগীত

বাংলা সিনেমার গান ও সাম্প্রতিক প্রবণতা

Icon

সাইম রানা

প্রকাশ: ২৭ ডিসেম্বর ২০২৩, ১০:৪২

বাংলা সিনেমার গান ও সাম্প্রতিক প্রবণতা

বাংলা সিনেমার নিজস্ব ভাষা ও দক্ষতার দুর্বলতা ঢাকতে সংগীতের আশ্রয় এখনো অবিরল। ছবি: সাম্প্রতিক দেশকাল

সিনেমায় সংগীতের অনিবার্যতা নিয়ে যতই দ্বন্দ্ব থাকুক, ব্যবহারের দিক থেকে তা এড়িয়ে যাওয়ার উপায় অন্তত বাংলা সিনেমায় কখনোই লক্ষ করা যায়নি। বরং প্রযুক্তির বিস্তার সংগীতকে আরও এতটা জড়িয়ে রেখেছে যে অন্ততপক্ষে বাণিজ্যিক কারণে সংগীতের প্রতি বেশি নির্ভরশীল হয়ে পড়েছে। সংগীতও তার চরিত্রকে ধীরে ধীরে পাল্টে ফেলে দৃশ্যানুকূল ভাষায় বিনির্মিত হতে দেখা গেছে। শতবর্ষের শিল্প আন্দোলনের অভিযোজনকালে প্রতিটি শিল্পমাধ্যমই কম-বেশি নিজ ভাষায় আকর হয়ে ওঠার পাশাপাশি অন্যশিল্পের প্রতি উদ্দীপিত হয়ে ওঠার ঘটনাবলি বিদ্যমান। সে কারণে সিনেমাও তার নিজ ভাষার পরিচর্যায় সংগীতকে উদ্দীপিত শক্তি হিসেবে অবশেষে বরণ করে নিয়েছে, সিনেমা নির্মাণের সূচনাকালে যা ধারকৃত মনে হতো অথবা দুর্বলতা ঢাকবার আবরণ হিসেবে ব্যবহৃত হতো।

অবশ্য বাংলা সিনেমার নিজস্ব ভাষা ও দক্ষতার দুর্বলতা ঢাকতে সংগীতের আশ্রয় এখনো অবিরল। অথবা বলা যায়, নির্মাণের দুর্বলতা কাটিয়ে তোলার চেষ্টা, না আবহমান বাংলার মেলোড্রামার ঐতিহ্যকে সহজাত করে নিজস্ব একটি ধারা হিসেবে আত্মপ্রচারই মুখ্য উদ্দেশ্য তা বিশ্লেষণের সময় এখনো আসেনি। ফলে অন্য দুনিয়ার সিনেমার সঙ্গে বাংলার সিনেমায় গীতি-প্রাবল্য নিয়ে তুলনামূলক বিতর্কে যাওয়া অবান্তর হবে। 

বাংলায় যা হয়ে এসেছে তা মূলত মঞ্চনির্ভর যাত্রাগান কিংবা পালাগান, কীর্তন কিংবা গীতিনাট্যের সিনেম্যাটিক ভার্সন হিসেবেও কারণ দর্শানো যেতে পারে। সূচনালগ্নে যারা কাজ করতে শুরু করেন, বিশেষ করে তাদের অভিনয়, নির্দেশনা, পোশাক, সেট ও গল্পনির্মাণ যাত্রা-অভিজ্ঞ সুধিজনের হাতেই ন্যস্ত ছিল। তারা নাট্যমঞ্চের বিষয়ানুষঙ্গকে মূলত সিনেমার কাহিনিচিত্র হিসেবে নির্বাচিত করে এসেছে। সেখানে পৌরাণিক গল্প-গাথার আধিক্য থাকত, সামাজিক ঘটনাপ্রবাহ, যা এখনো ইউরোপের নাট্যমঞ্চে প্রাপ্তিসাধ্য। কিন্তু বাংলায় হাজার বছরের উš§ুক্ত মঞ্চনির্ভর নাট্যপ্রবাহ শুকিয়ে যেতে শুরু করলে, সেই শুষ্ক চরে সিনেমাকে আশ্রয় দেওয়ার সমীকরণই মূলত গানের প্রাচুর্যনির্ভর নির্মাণকলার জন্ম দিয়েছে। 

ইউরোপ-আমেরিকায় সিনেমার বিকাশের কারণে অপেরা ও তৎসংশ্লিষ্ট লোকবলের গতিপথ বদলে যায়নি, বরং উভয় প্ল্যাটফর্মে স্বতন্ত্র দক্ষ শিল্পী-কুশলী প্রতিযোগিতামুখী বাজার সৃষ্টি করতে পেরেছে। অর্থাৎ অপেরা বা নাট্যমঞ্চের জন্য আঞ্চলিক বাজার এবং ফিল্মের জন্য বিশ্ববাজার তাদের পথকে প্রলম্বিত ও প্রশস্ত করেছে। এতদঞ্চলের অর্থনীতিতে সেই ধরনের পরিকল্পিত শিল্পবাজার নির্মাণ করা সম্ভব হয়নি বলেই, প্রাণ উজাড় করে দেওয়া শিল্প-নিষ্ঠার মানুষেরা পৃষ্ঠপোষকতাহীন, দারিদ্র্য ও সামাজিক অবমূল্যায়নের ফলে উত্তরাধিকারের নিকট আকর্ষণ স্থাপন করতে পারেনি। উদাহরণস্বরূপ, ১৯৭০ সালে অগ্রদূত-এর পরিচালনায় ‘মঞ্জরী অপেরা’ নামে একটি সিনেমায় একাগ্রচিত্ত যাত্রাশিল্পীদের সামাজিক মর্যাদাগত দিক ও অবক্ষয়ের কারণ চিত্রিত হয়েছে। কেন অপেরাটিক সিনেমার ধারা টিকে থাকতে পারেনি তার উত্তরও মেলানো হয়েছে। 

‘অবুঝ মন’ ছবিতে ‘শুধু গান গেয়ে পরিচয়’ গানের একটি দৃশ্যে রাজ্জাক ও শাবানা

শিল্পকে প্রতিনিয়ত উৎকর্ষের ভেতর দিয়ে বাঁচিয়ে রাখতে হলে অবশ্যই মর্যাদাশীল অবস্থান থেকে দেখতে হবে এবং তা উত্তরাধিকারের কাছে তার অভিজ্ঞতা ও দক্ষতার শেষ ডিসকোর্সকে বুঝিয়ে দিতে হবে, অথবা প্রাতিষ্ঠানিক পরিচর্যার মাধ্যমে যোগ্য নেতৃত্বের কাছে পৌঁছে দিতে হবে। সেই পথ নির্মাণের আবছায়া তরুণদের সামনে তাদের পূর্বপুরুষের শিল্পভাবনা ও নির্মাণকে প্রশ্নবিদ্ধ করে চলেছে। এই দূরত্বই মূলত শিল্পকলার ধারাবাহিক উৎকর্ষের পথকে দুর্লঙ্ঘ্য করে রেখেছে। সাম্প্রতিক সিনেমায় সংগীতের ব্যবহারগত অধোগতি সেই চিন্তাকেই উসকে দেয়।  

বাংলা ও ভারতবর্ষের যে কোনো স্থানের সিনেমায় গানের আধিক্য বরাবরই ছিল। ফলে এই ঐতিহ্যগত দিকের একটি আর্থ-সামাজিক তাৎপর্য রয়েছে। এই মতের সাদৃশ্য বিশ্বের অসংখ্য দেশে অনুসরণীয়। অর্থাৎ যে সকল দেশ তাদের স্থানিক শিল্প-নির্মাণস্রোতে সে দেশের দর্শককে সামনে রেখে নির্মিত হয়, তার সঙ্গে বিশ্বপরিসরের শিল্প সৃজনের তত্ত্বীয় ভাবনা সম্পূর্ণ ভিন্ন। একুশ শতকে বাংলায় চলচ্চিত্র আন্দোলনে বিশ্ব চলচ্চিত্রের ভাবনাকে উপজীব্য করতে গিয়ে স্থানিক শিল্প ভাবনাকে যে ছুড়ে ফেলে দেওয়ার প্রবণতা দেখা যায়, তার ফলে স্বদেশি শিল্পভঙ্গি মার খায় এবং নির্মাতাদের সামাজিক গুরুত্ব হারিয়ে যায়। আমাদের সামনে ইরানি, জাপানি, ফরাসি ভিন্নভাষী ছবির যেগুলো আন্তর্জাতিক বাজার পেয়েছে সেগুলো উদাহরণ হয়ে ওঠে। কিন্তু ওই সব দেশেও যে তাদের অসংখ্য লোকাল ফিল্ম রয়েছে ‘রূপবান’ কিংবা ‘বেদের মেয়ে জ্যোৎস্নার’ মতো, সেগুলো উদাহরণযোগ্য হয়ে ওঠেনি। এই দৃষ্টিভঙ্গি আমাদের সিনেমা জগতের অসংখ্য দিক নিয়ে কাজ করার মানসিকতাকে সংকীর্ণ করে রেখেছে। এর কারণ হিসেবে শুধু বাংলার সিনেমা শিল্পের নকল প্রবণতা, স্থূলতা ও অশ্লীলতাকে দায়ী করাটা ঠিক নয়, বরং এ ক্ষেত্রে অন্য কিছুর প্রভাব নিয়েও ভাবনার অবকাশ রয়েছে। যেমন জাপানিজদের কার্টুন, চায়নিজদের মার্শাল আর্টস, ফরাসিদের শারীরিক দক্ষতা অথবা রোমান-ইজিপশিয়ানদের মিথিক্যাল আবহ প্রত্যেক জাতির সিনেমার নিজস্ব বলয় তৈরি করেছে। জাপানিজদের কার্টুন সারাবিশ্বের শিশুদেরকে আবিষ্ট করে রেখেছে। 

এরকম বৈচিত্র্যময়তা বাংলার নির্মাতাদের কাছে আকর্ষণীয় হয়ে উঠতে পারেনি। সে কারণে তিরিশ দশকের সিনেমার সঙ্গে সাম্প্রতিক সিনেমার ভাষাগত সূত্রায়ণের বদল খুব একটা হয়নি। হয়তো বর্তমানে মেলোড্রামার প্রভাব কমেছে, অভিনয় কিংবা সিনেমাটোগ্রাফির সূক্ষ্মতা বেড়েছে, কিন্তু বাঙালির সিনেমা তার নিজরূপে দৃশ্যমান হতে শেখেনি, তবে পঞ্চাশের দশকে তা সামান্য পরিসরে হলেও চেনা গিয়েছিল।

১৯৩২ সালের ভারতবর্ষীয় হিন্দি সিনেমা ‘শিরি ফরহাদ’-এ দেখা যায় ৪২টি গান, ১৯৩২ সালে ‘ইন্দ্রসভা’ সিনেমায় ৭২টি গানের ব্যবহার হয়েছিল। তখনকার দিনে গানের প্রাচুর্যের আরেকটি কারণ হলো, যাত্রাশিল্পীদের মাধ্যমে সিনেমা নির্মাণ। এ ক্ষেত্রে সিনেমায় যুক্ত হওয়ার জন্য একজন শিল্পীকে যে ধরনের প্রাতিষ্ঠানিক প্রস্তুতি নিতে হয়, সে ধরনের অবকাঠামো সাধারণ মহলের প্রস্তুতি না থাকায় না পারায় যাত্রাশিল্পীদের অভিনয়নির্ভর সিনেমার ভাষা ও সংগীত যেন যাত্রারই সেলুলয়েড ভার্সন হয়ে উঠেছিল বলা চলে। আবার চলচ্চিত্রের অনুষঙ্গও ছিল রামায়ণ-মহাভারতের চরিত্র, মঙ্গলকাব্য, গীতিকা, কবিগান, ভাটিয়ালী, ধামাইল, গম্ভীরাজাতীয় আবহমান অনুষঙ্গ, যা গানের ভেতর দিয়েই মূলত উদযাপিত হওয়ার রীতি প্রতিষ্ঠিত হয়ে আছে। 

‘ঘুড্ডি’ সিনেমায় ‘আবার এল যে সন্ধ্যা, শুধু দুজনে’ গানের একটি দৃশ্যে রাইসুল ইসলাম আসাদ ও সুবর্ণা মুস্তাফা

ফলে সত্তর দশক পর্যন্ত একই ধারাবাহিকতায় গাননির্ভর চলচ্চিত্রই মূলত নির্মিত হয়েছে। তবে পঞ্চাশের দশকে বাংলা সিনেমা এমন কিছু গান উপহার দিয়ে গেছে যা এখন পর্যন্ত বাঙালির মনে গেঁথে আছে। যেমন ১৯৫৫ সালে ‘সবার উপরে’ ছবিতে ‘জানি না ফুরাবে কবে এই পথ চাওয়া’, ১৯৫৫ সালে ‘শাপমোচন’ ছবিতে ‘বসে আছি পথ চেয়ে’ বা ‘সুরের আকাশে তুমি যে গো শুকতারা’, ১৯৫৬ সালে ‘সাগরিকা’ ছবিতে ‘আমার স্বপ্নে দেখা রাজকন্যা থাকে’, ১৯৫৭ সালে ‘হারানো সুর’ ছবিতে ‘তুমি যে আমার ওগো তুমি যে আমার’, ১৯৫৬ সালে ‘মুখ ও মুখোশ’ ছবিতে ‘মনের বনে দোলা লাগে’, ১৯৫৯ সালে ‘আকাশ আর মাটি’ ছবিতে ‘এই পৃথিবীতে তবে কি আমার নেই কোনো ঠাঁই?’ উল্লেখযোগ্য। ষাটের দশকে ১৯৬০ সালে ‘আসিয়া’ ছবিতে ‘আমার গলার হার খুলে নে, ও গো ললিতে’। ১৯৬১ সালে ‘হারানো দিন’ ছবিতে ‘আমি রূপনগরের রাজকন্যা, রূপের যাদু এনেছি’, ১৯৬৩ সালে ‘কাচের দেয়াল’ ছবিতে ‘শ্যামলা বরন মেয়েটি’, ১৯৬৪ সালে ‘সুতরাং’ ছবিতে ‘এই যে আকাশ এই যে বাতাস’। 

১৯৬৫ সালে ‘রূপবান’ ছবিতে ২৫টি গান ব্যবহৃত হয়েছিল। ১৯৬৮ সালে ‘বাঁশরি’ সিনেমায় ১৭টি গান ব্যবহার করা হয়েছে। তবে ‘রূপবান’ ছবির গানগুলো বাংলার পালাগানের সুরে ‘ও ধাইমা, কিসের বাদ্য বাজে গো,’ বা ‘বিদায় দেন বিদায় দেন আব্বা গো’ জাতীয় গান বাংলার ঘরে ঘরে পৌঁছে গিয়েছিল। এরপর থেকে বাংলা সিনেমার গানে লোকসুরের এমন আধিক্য শুরু হলো যে মাঝখানে কিছু পরীক্ষা-নিরীক্ষাধর্মী নতুন গানের ইশারা পাওয়া যাচ্ছিল তা অনেকটা থমকে গেল। অবশ্য পাকিস্তান শাসনামলে আরও কিছু প্রতিবন্ধকতা ছিল, যেমন উভয় পাকিস্তানে ব্যবসা সফল করার উদ্দেশ্য মাথায় রেখে তখন (১৯৪৭-১৯৭০) উর্দু সিনেমা নির্মাণের প্রতি ঝোঁক তৈরি হয়েছিল। দর্শকদের মুখে উর্দু গান গাইবার প্রবণতা বেড়ে গিয়েছিল। তাছাড়া ভালো ভালো সংগীত পরিচালকরা পশ্চিম পাকিস্তানের ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রিতে কাজ করতে শুরু করে। সে কারণে উর্দুগানের দর্শক বিবেচনায় ক্ল্যাসিক্যাল ও এক্সপেরিমেন্টাল আধুনিক সুরের ব্যবহার লক্ষ করা গেলেও বাংলা সিনেমার দর্শক হিসেবে গ্রামীণ ও প্রান্তিক মানুষের কাছে পৌঁছে দিতে নির্মাতারা লোকসুরকেই মূলত অবলম্বন করেছিল। 

কিন্তু কলকাতার বাংলা সিনেমা জগতে যেহেতু উর্দু বা হিন্দি ভাষার আধিপত্যবাদী রাজনীতির প্রভাব ছিল না, ফলে তখন পরীক্ষা-নিরীক্ষাধর্মী গান পরবর্তীকালে ‘চিরায়ত বাংলা গান’ বা ‘সোনালি দিনের বাংলা গান’ বলে পরিচিতি পেয়েছে। অতএব এই গানগুলোর সঙ্গে কলকাতার টালিউডনির্ভর গানের নান্দনিক তুলনা করা অবান্তর হবে। তবে এর মধ্যে দিয়েই বেশ কয়েকজন ভালো সংগীত পরিচালক, প্লেব্যাক সিঙ্গার ও গীতিকারের আবির্ভাব ঘটেছিল পূর্ববঙ্গেও, যারা বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের পরবর্তীকালে অনন্য কিছু সংগীত নির্মাণের মাধ্যমে দ্যুতিময় স্বাক্ষর রেখেছেন। এর মধ্যে স্বাধীনতা সংগ্রামের চেতনাকে ধারণ করে অগণিত আত্মত্যাগ করা মুক্তি সেনানী, মা-বোনের সম্ভ্রম বিসর্জন, যুদ্ধস্মৃতির প্রতি গভীর মমতামাখা ও দেশমাতৃকার প্রতি অশেষ প্রেমসংক্রান্ত গান বেশ জনপ্রিয়তা পেয়েছে এবং উৎসব সংগীত হিসেবে বছরব্যাপী গীত হয়ে আসছে।

১৯৭২ সালে চারটি জনপ্রিয় ছবি নির্মিত হয়। ‘অবুঝ মন’ ছবিতে ‘শুধু গান গেয়ে পরিচয়’, ‘হারিয়ে গেলে’ ছবিতে ‘অমন করে যেও না গো তুমি’, ‘মানুষের মন’ ছবিতে ‘ছবি যেন শুধু ছবি নয়’, ‘সমাধান’ ছবিতে ‘লোকে বলে রাগ নাকি অনুরাগের আয়না’, ১৯৭৪ সালে ‘আলোর মিছিল’ ছবিতে ‘এই পৃথিবীর পরে কত ফুল ফোটে আর ঝরে’, ১৯৭৫ সালে ‘আলেয়া’ ছবিতে ‘আমি সাত সাগর পাড়ি দিয়ে’, ১৯৭৬ সালে ‘সূর্য কন্যা’ ছবিতে ‘চেনা চেনা লাগে তবু অচেনা’, ১৯৭৮ সালে ‘সারেং বৌ’ ছবিতে ‘ও রে নীল দরিয়া, আমায় দে রে দে ছাড়িয়া’ এরকম বেশ কিছু গান আধুনিক ও নিরীক্ষাপ্রবণ গান হিসেবে এদেশের সংগীতে উজ্জ্বল স্বাক্ষর রেখে গিয়েছে। তবে এ সময়েও লোকসুরের প্রভাবাশ্রিত গানই বেশি জনপ্রিয়তা পায়।

মনপুরা ছবিতে ‘যাও পাখি বল তারে’ গানের একটি দৃশ্যে চঞ্চল চৌধুরী ও ফারহানা মিলি

আশির দশকে বাংলা সিনেমায় ভারতীয় ও অন্যান্য দেশের জনপ্রিয় ছবির অনুকরণ শুরু হয়। সিনেমার কাহিনি তো বটেই, হুবহু অনুদিত গানে ঢালিউড ইন্ডাস্ট্রি ভরে ওঠে। প্রযোজকরা কম পয়সায় বেশি মুনাফা পাওয়ার আশায় শঙ্কাহীন চিত্তে ভারতের হিন্দি ও বাংলার জনপ্রিয় গানের সুরে বাংলা গান বানাতে থাকে। ‘ওয়াদা’, ‘কেয়ামত থেকে কেয়ামত’, ‘স্বজন’ ইত্যাদি সিনেমা ভারতীয় আধিপত্যের অন্যতম নজির হয়ে আছে। তবে আবার এই সময় থেকেই বিকল্পধারার চলচ্চিত্র আন্দোলন বেশ জোরদার হয়, প্রাতিষ্ঠানিকভাবে বহির্দেশ থেকে প্রশিক্ষণপ্রাপ্তসহ তারুণ্যদীপ্ত কিছু নির্মাতা উচ্চ রুচিশীল চলচ্চিত্র উপহার দেয়, সেই সঙ্গে কিছু অবিস্মরণীয় গানও আমরা শুনতে পাই। যেমন ১৯৮০ সালে ‘ঘুড্ডি’ সিনেমায় ‘আবার এল যে সন্ধ্যা, শুধু দুজনে’, ১৯৮১ সালে ‘জন্ম থেকে জ্বলছি’ ছবিতে ‘বাবা বলে গেল, আর কোনোদিন গান করো না’, ‘পুত্রবধূ’ ছবিতে ‘সন্ধ্যার ছায়া নামে এলোমেলো হাওয়া’ ইত্যাদি।

নব্বইয়ের দশকেও অ্যানালগ স্টুডিও থাকার কারণে পূর্বাবর্তের পরিবেশ অনেকটা ছিল, কিন্তু ডিজিটাল স্টুডিওর আবির্ভাবের সঙ্গে অর্থনৈতিক সূত্র বদলে যায়। প্রযুক্তি আসক্ত তরুণ সমাজ মূলত মিডিয়াতে ঢুকে পড়ে এবং তখন পুরনো রীতির দক্ষ কলাকুশলীদের একচ্ছত্র বিচরণের ভাটা পড়ে। এ সময় স্বতন্ত্ররূপে ক্যাসেট অ্যালবামের জনপ্রিয় গানগুলো নিয়ে সিনেমাওলারা তাদের সিনেমায় ব্যবহার করে বাজারে ব্যবসা সফলের পথে হাঁটতে দেখা গেছে। ফলে এতদিনে বাংলায় প্লেব্যাক সিঙ্গারের যে ধারণা একটি বিশেষ ধরনের শিল্পীর বাজার তৈরি হয়েছিল, তা অনেকটা স্থিমিত হয়ে পড়ে। ফলে এতদিনে সিনেমার গান নামে একটি বিশেষ ধরনের গানের সংযুক্তি বাংলা গানের ভুবনকে প্লাবিত করেছিল, তার প্রভাবও কমে আসে। 

একুশ শতকের সিনেমা এতদিনের সামগ্রিক জড়তা কাটিয়ে ওঠার চেষ্টা করেছে সহজলভ্য চিত্রধারণের সুবাদে। এতে করে নির্দেশকদের ইচ্ছার স্বাধীনতা, ভাষার নিরীক্ষা, উদ্ভট পাগলামি, অসমাপ্ত চিত্রকলার মতো আনফিনিশড প্লট, চিত্রনাট্যহীন স্বতঃস্ফূর্ততার প্রতি পক্ষপাত, কবিতার সিনেমা ইত্যাদি লক্ষ করা গেছে মূলত একঝাঁক তরুণ প্রতিশ্রুতিশীল নির্মাতার কল্যাণে। এদের অধিকাংশের সিনেমা বানানোর দক্ষতা না থাকলেও শিল্পতত্ত্বের গভীর পাঠ নিয়ে মাঠে নামতে দেখা গেছে। আবার কিছু নির্মাতা মঞ্চ ও টিভি নাটকে দক্ষতার প্রমাণ রেখে জনপ্রিয়তার তুঙ্গে থেকে সিনেমায় নেমেছে। ফলে দীর্ঘদিনের প্রথাসিদ্ধ নিয়ম ভেঙে নতুন নতুন রূপের প্রকাশ করতে পেরেছে। সেই সঙ্গে গান। যেমন ‘বাহির বলে দূরে থাকুক, ভিতর বলে আসুক না’, ‘কেনরে গাড়ি চলে অচেনা ইস্টিশনে’, ‘পুবালি বাতাসে বাদাম দেইখা চাইয়া থাকি’, ‘যাও পাখি বল তারে’, ‘তুমি বন্ধু কালা পাখি’ ইত্যাদি গানের মধ্যেও দেখা যাবে বাংলার লোকসুরের প্রভাব। তবে সংগীতায়োজনে রয়েছে নৈমিত্তিক জীবনের গায়কীর মতো স্বতঃস্ফূর্ত প্রকাশ, যা ফিটফাট আয়োজনের পুরনো ভঙ্গি থেকে সরে আসার অভিব্যক্তিই প্রকাশ করে। 

আবার পাশাপাশি ক্ল্যাসিক্যাল, গজল ও কাওয়ালির গায়কীও আসরকেন্দ্রিক আবহ নিয়ে তৈরি হওয়া গান দর্শকপ্রিয়তা পাচ্ছে। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ দিক হলো এ সময়ের সিনেমায় গান দৃশ্যের সঙ্গে প্রাসঙ্গিক হয়েই নির্মিত হয়ে চলেছে এবং তা ব্যবহারের আচরণে রোমান্টিসিজম পরিহার করে রিয়ালিজমের দিকেই ঝুঁকেছে, এখানেই বিচক্ষণ আধুনিকতার প্রকাশ। অর্থাৎ দর্শকের মুখোমুখি জবাবদিহিতার প্রস্তুতি নিতে কারও দ্বিধা নেই। দর্শকও শুধু বিনোদন কিংবা সময় কাটানোর জন্য মুখোমুখি বসেনি, বরং রসনন্দনের আবহে ডুবতেও চায় সময় ও অসময়ের রাজনীতি, সমাজ ও অর্থনৈতিক বোঝাপড়াকে আমলে রেখে। 

সারেং বৌ ছবির একটি পোস্টার

এই এক জটিল সময়, প্রযুক্তির অস্থির বিবর্তনে সভ্যতা টলটলায়মান, এমন এক পরিস্থিতিতে প্রত্যেকে সৃষ্টির উদযাপনে মত্ত, অনেকটা আত্মপ্রতিকৃতির মতো। আর এই আচরণ সকল শিল্পেই কমবেশি প্রবাহিত হতে দেখা যাচ্ছে, তাহলে সিনেমাই বা থেমে থাকবে কেন?  

লেখক: সহযোগী অধ্যাপক, সংগীত বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

Logo

সম্পাদক ও প্রকাশক: ইলিয়াস উদ্দিন পলাশ

বার্তা ও বাণিজ্যিক কার্যালয়: ফেয়ার দিয়া ১১/৮/ই, ফ্রি স্কুল স্ট্রিট (লেভেল-৮), বক্স কালভার্ট রোড, পান্থপথ, ঢাকা ১২০৫