
তপন চৌধুরী
তপন চৌধুরী। চল্লিশ বছর আগে সোলসের হাত ধরে গানের জগতে পথচলা শুরু। তার চিরসবুজ গানগুলো মানুষের মুখে মুখে ফিরলেও মাঝে এক যুগ ছিলেন পর্দার আড়ালে, তবে সুদিন ফিরেছে আবারও। নতুন করে গান গাইছেন তিনি। দিলু রোডের বাসভবনে তার ক্যারিয়ারের বিভিন্ন প্রসঙ্গে কথা বলেছেন মাহমুদ সালেহীন খানের সঙ্গে।
বাংলাদেশের সংগীতাঙ্গনকে বিশেষত আধুনিক গান এবং ব্যান্ড সংগীতকে যারা নিজেদের একক গায়কী দিয়ে সমৃদ্ধ করেছেন তাদের অন্যতম তপন চৌধুরী। ‘এ এমন পরিচয়’, ‘মন শুধু মন ছুঁয়েছে’, ‘তুমি ক্যামনে এতো নিঠুর হইলা’, ‘কতো কাঁদলাম কতো গো সাধলাম’, ‘যদি ভুল করে কাছে এসে থাকি’, ‘যদি দেখো ওই নীলিমায়’, ‘এতো ভালোবেসো না আমায়’, ‘দমে জীবন দমে মরণ’, ‘আজ ফিরে না গেলেই কী নয়’, ‘আমি সবকিছু ছাড়তে পারি তোমাকে ছাড়তে পারবো না... আমি দেবদাস হতে পারবো না’, ‘পৃথিবীর মতো হৃদয়টাকে’, ‘আকাশের সব তারা’, ‘পাথরের পৃথিবীতে কাচের হৃদয়’সহ আরও এমন অসংখ্য জনপ্রিয় গান রয়েছে, শিল্পী তপন চৌধুরীর। এসব গানের কথা বিশেষভাবে উল্লেখ করার কারণ হলো এই প্রজন্ম হয়তো গানগুলো শুনেছে, বা এখনো অনেক শিল্পীর কণ্ঠে মঞ্চে গানগুলো গাওয়া হয়; কিন্তু তারা মূল শিল্পীর কথা হয়তো জানেনই না। কারণ মাঝের বেশ কয়েক বছর দেশ ছেড়ে, গান ছেড়ে অনেকটা লোকচক্ষুর অন্তরালেই চলে গিয়েছিলেন তিনি।
যেন অভিমান করেই দেশ ছেড়ে চলে গেলেন বিদেশ। দীর্ঘদিন গান থেকেও দূরে ছিলেন। গত কয়েক বছর ধরে দেশে এসে নতুন গান গাইছেন। বিদেশের জীবন প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘আমার স্ত্রী, সন্তান সেখানেই থাকেন। যে কারণে বছরের নির্দিষ্ট একটি সময় আমি কানাডায় থাকি। গত কয়েক বছর ধরে আমি মাঝে মাঝে দেশে আসছি। তবে এবার দেশে আসার মূল কারণ হিসেবে জানালেন স্বাধীনতার ৫০ বছর পূর্তির কথা। বললেন, স্বাধীনতার ৫০ বছর পূর্তির মুহূর্তটি প্রিয় জন্মভূমিতে থাকতে চেয়েছি। ঈশ্বরের কাছে প্রার্থনা করেছিলাম, যেন সেই মুহূর্তটিতে আমি দেশে থাকতে পারি, ঈশ্বর আমার প্রার্থনা পূরণ করেছেন। কিন্তু স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীতে আমি হতাশ। এমন ৫০ বছর আমরা কেউ চাইনি। সবার মধ্যে কেমন যেন একটা আতঙ্ক। অধিকাংশ সড়ক অবরুদ্ধ ছিল বিদেশি মেহমানদের জন্য। দেশজুড়ে ইন্টারনেট ছিল না। দেশের নাগরিকরা সুবর্ণজয়ন্তী নিয়ে তার আবেগ অনুভূতির কথা বিশ্বকে জানাতেও পারেননি।
আরও আগে আসার ইচ্ছে থাকলেও করোনার কারণে এবার দেশে আসতে দেরি হয়ে গেছে তার। স্টেজ শো, টিভি শো, নতুন গান প্রসঙ্গে তপন চৌধুরী বলেন, ‘মাত্রতো দেশে আসলাম। তেমন কেউতো জানেই না আমি দেশে এসেছি। তবে অবশ্যই ইচ্ছে আছে স্টেজ শো করার, টিভিতে গান গাইবার। হয়তো পরিস্থিতি ঠিক থাকলে খুব শিগগিরই স্টেজে ফেরা হবে।
১৯৭৯ তে বিটিভিতে প্রচারিত হয় ব্যান্ড দল সোলসের ‘মন শুধু মন ছুঁয়েছে’ গানটি। নকীব খানের লেখা ও পিলু খানের সুরে গানটি প্রচার হবার পর রাতারাতি তারকা খ্যাতি পেয়ে যান সোলস ও গানের শিল্পী তপন চৌধুরী। এরপর ১৯৮৪ কিংবা ১৯৮৫ সালে তপন চৌধুরীর প্রথম একক গানের ক্যাসেট ‘তপন চৌধুরী’ সারগামের ব্যানারে বাজারে আসে। আইয়ুব বাচ্চুর সুর সংগীতে এই অ্যালবামটির সবগুলো গানই শ্রোতাদের মন কেড়ে নেয়। তবে তপন চৌধুরীর প্রথম অ্যালবামের পর যে অ্যালবামটি সবচেয়ে বেশি শ্রোতাপ্রিয়তা পেয়েছিল সেটি হচ্ছে ‘অনুশোচনা’। তার সর্বশেষ একক অ্যালবাম ‘ফিরে এলাম’।
চল্লিশ বছর আগে গানের ভুবনে যাত্রা প্রসঙ্গে তপন চৌধুরী বললেন, ৪০ বছর অনেকটা সময়। প্রথম যখন গান করতে আসি, অনেক সংগ্রাম করতে হয়েছে। আর চল্লিশ বছরের ক্যারিয়ার বলব, ভালো-খারাপ মিলিয়েই তো মানুষের সবকিছু। প্রথমদিকে নিজেদের গান ছিল না, মানুষের গান করতাম। আমাদের গান হলো, মানুষ গ্রহণ করল। চল্লিশ বছর ধরে গান শুনছে মানুষ, এর চেয়ে বড় পাওয়া আর নাই।
‘আসলে সংগীতে আমার পরিবার থেকেই মূল সহযোগিতা পাই। পরিবারের সবাই গান পছন্দ করে, সংস্কৃতির বিভিন্ন দিকের সঙ্গে যুক্ত। আমার যারা গার্জিয়ান ছিল, তাদের ইন্সপিরেশন অনেক পেয়েছি। আমার কাকা, আমার টিচার, আমার যারা গাইড- তাদের শুভেচ্ছা, সহযোগিতা, অনুপ্রেরণাতেই এই পর্যায়ে আসতে পেরেছি’।
তিনি আরও বললেন, এগুলো প্রথম দিকের কথা বলছি। পরবর্তী পর্যায়ে সোলসের সঙ্গে যুক্ত হলাম। সুব্রত বড়ুয়া রনি আমাকে সোলসে নিয়ে এসেছিল। তিনি তখন ‘সুরেলা’য় ছিলেন, ‘সুরেলা’য় পারকাশন বাজাতেন। পারকাশন বলতে কঙ্গো, বঙ্গো- এগুলোই প্রথম দিকে ছিল। পরবর্তীতে ড্রামস। এই করতে করতে উনিই আমাকে সোলসে নিয়ে এলেন। আমার মনে হয়, আমার গান-বাজনা এবং গায়ক হওয়ার পেছনে মূল প্রেরণা ছিল সোলস এবং রনিদা। অন্যান্য যারা সোলসে ছিল, তারাও নিশ্চয়ই; কিন্তু সবচেয়ে বেশি বলব যে, মানুষের ভালোবাসা পেয়েছি, সহযোগিতা পেয়েছি। এ পর্যন্ত আসার পেছনে পরিবার এবং সোলস ছাড়া যাদের মূল ভূমিকা ছিল তারা হলেন-আমার গীতিকার, সুরকার, সংগীত পরিচালক, ফিল্ম ডিরেক্টর (যাদের ছবিতে গান করেছি), আমার মিউজিশিয়ান ভাইয়েরা এবং শেষমেশ আমার পরিবার, আমার সন্তান। সবার সম্মিলিত প্রচেষ্টাতে এ পর্যন্ত আসতে পেরেছি।
তপন চৌধুরীর গান শেখার প্রথম হাতেখড়ি হয়েছিল ওস্তাদ প্রিয়দারঞ্জন সেনের কাছে। আরও একজনের কাছে তিনি গানের তালিম নিয়েছিলেন। তিনি হলেন শ্রদ্ধেয় মিহির লালা। ওস্তাদ মিথুন দের সুযোগ্য সন্তান, ওস্তাদ সঞ্জীব দের কাছেও গান শিখেছেন তিনি। এ প্রসঙ্গে তপন চৌধুরী বলেন, আমি গান শেখার জন্য অনেকের কাছেই ছুটে গিয়েছি। নিজেকে সমৃদ্ধ করেছি।
শিল্পীর জীবনের শ্রেষ্ঠ সময় ছিল সোলস, সবসময় এটি তিনি মনে করেন। এ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, আমি আমার টিনেজ, অর্থাৎ বারো-তেরো বছর বয়স থেকে এই দিকে এসেছি। একটা মানুষের টিনেজ সময় স্বাভাবিকভাবে যেভাবে কাটে, ওই সময়টা আমি সোলসের সঙ্গে গানে গানে কাটিয়েছি। আমার জীবনের সেরা সময়টা আসলে সোলসের সঙ্গে এবং পরবর্তী পর্যায়ে আমার সন্তানের সঙ্গে কাটিয়েছি। আমি ২২ বছর ধরে সোলসের সঙ্গে ছিলাম। অনেক কাজ করেছি, গান করেছি। সুখে-দুঃখে সমস্ত কিছুতেই ছিলাম।
সোলস ছাড়ার প্রসঙ্গে তিনি বললেন, মূলত যে কারণে সোলস ছাড়লাম, সেটা হলো, তখন সোলস চট্টগ্রাম বেইজড ছিল। চট্টগ্রামে অনুষ্ঠান করার জন্য প্রায়ই যেতাম। অনুশীলনের সময় হলে সেখানে যাওয়া হতো। আমি তখন নিজের ক্যারিয়ার নিয়ে ব্যস্ত হয়ে গেছি, সলো ক্যারিয়ার, ফিল্মে প্লে-ব্যাকের ক্যারিয়ার, বিভিন্ন মাধ্যমে স্টেজ শো- সব কিছু মিলেই। আরেকটি কারণ ছিল, বিদেশে অফার পেতাম বিভিন্ন জায়গায় গান গাওয়ার জন্য। আমার মনে হতো যে, আমি চলে যাচ্ছি; কিন্তু সোলস থেকে তো কেউ যাচ্ছে না। এখন যেমন অনেকেই যায় গিটার একটা হাতে নিয়ে, গ্রুপের জায়গায় সলোও শো করে আসে। ব্যান্ডের কারও যেতে আমি খুব কম দেখেছি। কারণ, এতগুলো ভিসা পাওয়া, সেসবের পেছনে এত এফোর্ট দেওয়া, এতগুলো মানুষের টিকিট দিয়ে ওখানে শো করা- এগুলোও খুব কঠিন ছিল। তার চেয়ে একা একটা গিটার হাতে নিয়ে চলে যাওয়া, ব্যান্ডের যে গায়ক নাম করেছে, তার একার ভিসা পেতেও সুবিধা, যাওয়াটাও সুবিধা। আমার মনে হলো যে, আমিতো ঠকাচ্ছি ওদের। আমি ভিসা পাচ্ছি, আমি যেতে পারছি, আমাকে নিয়েও যাচ্ছে। এমনো হয়েছে, আমি একা গান করছি, অথচ পেছনে ব্যানার লাগিয়ে দিয়েছে, ‘সোলস অ্যান্ড তপন চৌধুরী’; কিন্তু আমিতো আলাদা গান করছি, সোলস তো করছে না। আর তাছাড়া মানসিকতারও ব্যাপার আছে। আমরা যখন একসঙ্গে কাজ করতাম, যে মানুষগুলোর সঙ্গে কাজ করতাম, সেই মানুষগুলো একে একে চলে গেছে। দেখা গেল, মাত্র একজন দু’জন আছে। চিন্তা করলাম, কাজ করতে গেলে মানসিকতার মিলেরও তো একটা ব্যাপার থাকতে হবে। এসব চিন্তা করেই, আমি নিজ থেকে বললাম যে আমি সময় দিতে পারছি না, আমাকে ছেড়ে দিলে খুব খুশি হবো। এটাই। কোনো ঝগড়া না, অন্য কোনো কিছু না, নিজে থেকে বলে-কয়েই ব্যাস! তখন সলো ক্যারিয়ার গড়তে শুরু করলাম।
সলো ক্যারিয়ারের প্রসঙ্গে তিনি বললেন, আমার জীবনের সবচেয়ে সৌভাগ্যের ব্যাপার হলো, দেশের যত বিখ্যাত সুরকার, গীতিকার আছেন, তাদের সবার সঙ্গে আমি কাজ করতে পেরেছি। সত্য সাহা, সমর দাস, আনোয়ার পারভেজ, আলাউদ্দীন সাহেব, খন্দকার নূরুল আলম, সুবল দাস- প্রত্যেকের সঙ্গে কাজ করার সুযোগ পেয়েছি। এটা একটা বিরাট সৌভাগ্যের ব্যাপার। আর এক দিক দিয়ে আমি সৌভাগ্যবান যে দর্শকরা আমার গাওয়া গানকে লুফে নিয়েছিলেন। ব্যান্ড, সলো আর প্লে-ব্যাক এই তিন মাধ্যম প্রসঙ্গে তপন চৌধুরী বলেন, আসলে জীবনের প্রথম থেকেই আমার জ্ঞানে-ধ্যানে যেটা ছিল, সেটা হলো গানকে কাজ হিসেবে নেওয়া। সিনেমার গান করছি, টেলিভিশনে গান করছি, ব্যান্ডে গান করছি কিংবা সলো গান করছি- এগুলোকে আলাদা করে দেখিনি। গানকে গান হিসেবে দেখেছি। গানের মেলোডি, সংগীত, সুর-এগুলোকে আমার মতো করে একটু ভেবেছি, আর গানকে গান হিসেবেই চিন্তা করেছি।
তিনি আরও বলেন, আমরা সোলস-এ যারা গান করেছি, আমার মনে হয় আমরা এত সুন্দর সুরে ও কথায় গান করেছি... ব্যান্ডের গান এরকম খুব কম হতো। ‘নদীর শেষে পথ’, ‘চাঁদ এসে উঁকি’, ‘মনে কর এখন অনেক রাত’, ‘ভুলে গেছ তুমি’ কিংবা ‘কীর্তিনাশার তীরে বাঁইধাছিনু ঘর’, এই গানগুলোর সাবজেক্ট, লিরিক, সুর, কম্পোজিশন- একদম ব্যতিক্রমী ছিল, এটা আমি বলবো। এটা আমার বলার অহঙ্কার আছে, অধিকার আছে। এবং সেইসময়কার ফোক গানের মিশ্রণে, যেমন ‘কান্দো কেনে মন’, ‘আইচ্ছা পাগল মনরে বা’, ‘জ্বালায়া গেলা মনের আগুন’- অনেক গান আছে যেগুলোতে সোলস ফোক এবং মডার্নিটি একসঙ্গে মিলিয়ে গেয়েছি। এ জন্যই বলি যে কোনো গানকেই আমি আলাদা ভাবছি না। গান গাই, তা সে যে মাধ্যমেই হোক না কেন। আমি রবীন্দ্রসংগীতও গাই, নজরুলসংগীতও করি, পঞ্চকবির গানও করি। সেমিক্ল্যাসিকাল গানও... চেষ্টা করি। আরও একটি বিষয় হলো, আপনি যদি চর্চা করেন, যদি ভাবেন, গানকে আপনি কীভাবে উপস্থাপন করবেন, গান পুরোপুরি আপনার নিজের ওপরই নির্ভর করবে। চাইলে অনেক কিছুই হয়।
চর্চার বিষয়টা যখন আসলোই, জানতে চাই, আপনি কীভাবে প্রতিদিন গানের চর্চা করেন? এ প্রসঙ্গে তপন বলেন, আমি প্রতিদিন চর্চা করি না- এটা একদম সত্যি কথা। তবে গান প্রতিদিন শুনি, হারমোনিয়াম নিয়ে বসি। প্রতিদিন না হলেও গান তো করি। সেটাও তো এক ধরনের চর্চা। আর আমি খুব গান শুনি। ছোট-বড় সবার গানই শুনি।
তপন চৌধুরীর প্রিয় শিল্পীর তালিকাটা অনেক বড়। মান্না দে’র গান ভীষণ পছন্দ তার, কথা-সুর সমস্ত কিছু মিলে। অজয় চক্রবর্তীর গানও ভালো লাগে। লতার গান শুনলেই উদাস হয়ে যান তিনি। তারপর... হেমন্ত মুখোপাধ্যায়, হৈমন্তি শুক্লার গান ভাল লাগে। এ তো গেল ভারতের শিল্পী তালিকা। বাংলাদেশে নিলুফার ইয়াসমীন খুব প্রিয় শিল্পী তার। সাবিনা ইয়াসমীন, রুনা লায়লা, সুবীর নন্দী, কুমার বিশ্বজিৎ, শাকিলা জাফর, সামিনা চৌধুরীর গান ভালো লাগে তার।
দীর্ঘদিন বিদেশে ছিলেন। দেশে আসেননি। দীর্ঘ একটা বিরতি ছিল গানের ভুবনে। এ প্রসঙ্গে শিল্পী জানালেন, অনেকদিন আমার কোনো সিডি, অর্থাৎ অ্যালবাম বের হয়নি, যে মাধ্যমটা দিয়ে আসলে মানুষের সঙ্গে যোগাযোগটা হয়। আমি কিন্তু প্রতি বছরই দেশে আসি। এখানে অর্ধেকটা সময় থাকি, দেশের বাইরে অর্ধেকটা। তবে বারো বছরের একটা গ্যাপ হয়ে গেছে, সিডি-ক্যাসেটের। সেটাও গুটিয়ে গেছে অলরেডি। সংগীতের চল্লিশ বছরের অনুষ্ঠানে একটা অ্যালবাম প্রকাশ পেয়েছে; সেটা হলো ‘ফিরে এলাম’। অ্যালবামটির পাঁচটি গানে সুর করেছেন আমার অত্যন্ত প্রিয় মানুষ, সুবীরদা (সুবীর নন্দী), দুটি গানের সুর করেছেন পুলক অধিকারী এবং আরেকটি সেজান মাহমুদ। গীতিকারেরা হলেন, মিলন খান, সাইফুল হোসেন, কবীর বকুল, সেজান মাহমুদ। আর দুটি পুরনো গান আমি ওখানে যুক্ত করেছি।
এক যুগ বিরতি প্রসঙ্গে তিনি বলেন, আমি ভেবেছিলাম ছোট্ট একটা ব্রেক নেব। কারণ একইরকম গান হচ্ছিল, আর আমার বাইরে যাওয়া-আসা, সবমিলিয়ে খুবই দৌড়াদৌড়ির মধ্যে ছিলাম। মানসিক চাপ ছিল, টেনশন ছিল। সবকিছু মিলিয়ে, ভাবছিলাম যে ছোট্ট একটা ব্রেক নিই। এই বিরতিটা যে এতটা বড় হবে- আমি নিজেও ভাবিনি! বিরতিটা ইচ্ছাকৃত ছিল- এটা বলতে পারেন, তবে এটা অনেক অগোছালো হয়ে গেছে, লম্বা হয়ে গেছে। তাছাড়া এর মধ্যে অডিও বাজারটাও নষ্ট হয়ে গেছে, পাইরেসি-টাইরেসি সবকিছু মিলে। এখন তো আপনারা সিডি-ক্যাসেটও পাননা, অনলাইনে গান শুনতে হয়।
চল্লিশ বছরে দেশের গানের জগতে যে বিবর্তন ঘটেছে এটিকে স্বাভাবিকভাবেই দেখছেন তপন চৌধুরী। এ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, সময়ের সঙ্গে সমস্ত কিছু বদলে যায়। ফ্যাশন, গান , সাহিত্য, শিল্পকর্ম সবকিছুই তো পরিবর্তন হয় সময়ের সঙ্গে সঙ্গে। চল্লিশ বছর আগে যে কাপড়চোপড় পরে ছবি তুলেছি, সেটি দেখলে নিজের কাছেই এখন হাসি পায়। আবার মনে মনে চিন্তা করি, তখন তো এটাই ফ্যাশন ছিল। সময় গেলে যে মাধ্যমে আপনি গান করছেন, তখনকার রেকর্ডিং, এখনকার রেকর্ডিং, তখনকার সুর, এখনকার সুর, তখনকার কম্পোজিশন, এখনকার কম্পোজিশন এগুলো তো চেঞ্জ হবেই। কিন্তু যে গানটা চল্লিশ বছর পরও সবুজ, মানুষের মুখে মুখে ফিরছে... অনেকেই এগুলোকে বলেন পুরনো দিনের গান। আমি পুরনো দিনের গান বলি না, আমি বলি সোনালি দিনের গান। সোনালি দিনের গান বলেই এখনো সে গানগুলো করছেন আপনারা। স্টেজে যাবেন, দেখবেন পঞ্চাশ, চল্লিশ বছরের সোনালি দিনের গানগুলো মানুষ শুনতে চাইবে। এখন তো হাজার হাজার গান হচ্ছে। সব গান তো থাকে না। যেগুলো থাকে, সেগুলো হলো কালোত্তীর্ণ গান। বিবর্তন হবেই। মিউজিকালি গানের কম্পোজিশন, বাদ্যযন্ত্র পরিবর্তন হবেই; কিন্তু গানের গঠন কিন্তু সহজে পরির্বতন হয় না। সেই গঠনকে ভেঙে নতুন কিছু করতে গিয়ে যদি মানুষের গ্রহণযোগ্যতা পাওয়া যায়, সেটাই হলো সবচেয়ে বড় সফলতা।
সোনালি দিনের গানের কথা যখন বললেনই, আপনার গাওয়া ‘মন শুধু মন ছুঁয়েছে’ গানটি এখনও জনপ্রিয়। এ প্রসঙ্গে শুনতে চাই। তিনি বললেন, এই গানটির সুরকার ছিলেন খুব নিভৃতচারী মানুষ। তিনি হলেন পিলু খান। তার সহযোগী ছিলেন নকীব খান। দুই ভাই মিলে কাজটি একসঙ্গে করেছেন। এই গানটি বাংলাদেশের সংগীতের আকাশে এক উজ্জ্বল নক্ষত্র। আমি সৌভাগ্যবান গানটি গাওয়ার সুযোগ পেয়েছি। তারাই আমাকে নির্ধারণ করেছিলেন গানটা গাওয়ার জন্য। সেজন্য আমার মনে হয় একটা ইতিহাস তৈরির সাক্ষী হয়ে গেছি! যতদিন বাংলাদেশে বাংলা গান আছে, এই গানটিও থেকে যাবে। কিছু গান আসলে থেকেই যাবে। যেমন ‘নীল মণিহার’, ‘রেললাইন বহে সমান্তরাল’- এ ধরনের গানগুলো। এগুলো কিন্তু কালজয়ী গান। যেমন ধরুন, ‘আবার এলো যে সন্ধ্যা’, ‘আগে যদি জানিতাম’- এসব গান মানুষ এখনো শোনেন এবং যে কোনো অনুষ্ঠানে গেলে আমাদের এখনো গাইতে হয়।
গান নিয়ে আপনার ভবিষ্যত পরিকল্পনা কী? এটা কি অব্যাহত থাকবে নাকি আবারও বিরতি নেবেন? তপন চৌধুরী বললেন, এটা তো অব্যাহত থাকবেই। অনেকেই বলে, (অ্যালবামের নাম নিয়ে) ‘ফিরে এলাম’ আবার কী? যেমন শ্রদ্ধেয় রুনা লায়লা বলছিলেন কিছুদিন আগে, ‘অ্যাই, তুমি তো এখানেই ছিলা। গেলা কবে আর ফিরলাই বা কবে? আসল ব্যাপারটা হলো, অ্যালবামের নাম স্পেসিফিক কোনো কিছুকে মিন করে না। অনেকদিন পর সিডি করছি, গানে ফিরে এলাম- এটা একটা অর্থ হতে পারে। তবে অ্যালবামে গান আছে একটা এই নামে, সেখান থেকেই অ্যালবামের নামও এটাই হয়েছে। আর ভবিষ্যতের পরিকল্পনা হলো, যতদিন গলায় সুর আছে, গান করতে পারছি, ততদিন গান চালিয়ে যাব। তবে জোর করে গান করব না। গাইতে পারছি না কিন্তু স্টেজে গিয়ে কাশবো, কাঁদবো- এটা কখনো করব না।