
নাজিয়া হাসান
আশির দশক। কুরবানি নামের একটি সিনেমা প্রেক্ষাগৃহে মুক্তি পেতেই, হৈ চৈ পড়ে গেল ভারতবর্ষ জুড়ে। সিনেমায় অভিনয় করেছেন সে সময়ের জনপ্রিয় অভিনেত্রী জিনাত আমান। কিন্তু সে জন্য নয়। এই ছবির একটি বিশেষ গান দর্শক-শ্রোতাদের একেবারে মাতিয়ে তুললো। এমন গান এর আগে ভারতে প্রায় কেউই শোনে নি।
গানটি ছিলো, ‘আপ জেয়সা কোই মেরি জিন্দেগি মে আগে, তো বাত বান যায়ে...।’ গানটি গেয়েছিলেন ক্লাস সিক্সে পড়া, চুলে বেণী বাঁধা, লন্ডন নিবাসী, এক পাকিস্তানী কিশোরী। প্রথম গানেই যিনি জিতে নিয়েছিলেন কোটি মানুষের হৃদয়। দেশের সীমানা অবান্তর হয়ে গিয়েছিল তাঁর কাছে। হয়ে উঠেছিলেন ভারতীয় উপমহাদেশের পপ গানের রাজকন্যা। নাজিয়া হাসান। আজ তাঁর ২২ তম মৃত্যুদিন।
নাজিয়ার জন্ম ৩ এপ্রিল, ১৯৬৫। বড় হয়ে ওঠা লন্ডনে। বাবা বসির হাসান। পেশায় প্রতিষ্ঠিত ব্যবসায়ী। মা, মুনিজা বসির সমাজকর্মী। আর পাঁচটা মুসলিম পরিবারে মেয়েরা যেভাবে বেড়ে ওঠে তার চেয়ে কিছুটা অন্যরকম ছিলো তাঁর বড় হয়ে ওঠা। পড়াশোনা আর গান এই নিয়ে জগৎ। ভাই-বোন নাজিয়া হাসান ও জোহেব হাসান জুটির স্টেজ মাতানো পপ গানগুলো তখন মানুষের মুখে মুখে।
এসময় বলিউডের নায়ক-পরিচালক ফিরোজ খান তার নির্মিতব্য ছবি ‘কুরবানি’র’ আইটেম সং “আপ জ্যায়সা কোই মেরি’র’ জন্য খুঁজছিলেন এক ব্যতিক্রমী নারী কণ্ঠ, যার গায়কি ও ড্রিম-গার্ল জিনাত আমানের নাচের রসায়নে তৈরী হবে সুপার-ডুপার হিট প্রজেক্ট। ১৫ বছর বয়সী নাজিয়ার কণ্ঠ শুনেই মুগ্ধ ফিরোজ খান, তার কণ্ঠে তুলে দিলেন সেই গান। ১৯৮০ সালে মুক্তি পাওয়া কুরবানি মন কাড়লো লক্ষ-কোটি দর্শকের। বিড্ডুর সুরে গাওয়া গানটি ১৫ বছর বয়সী নাজিয়া হাসানকে এনে দেয় ভারতের বিখ্যাত চলচ্চিত্র পুরস্কার ফিল্মফেয়ার অ্যাওয়ার্ড। সেই রেকর্ড অম্লান আজো।

এরপর বিড্ডুর কম্পোজিশনে নাজিয়ার একটি অ্যালবাম প্রকাশিত হয়। ‘ডিস্কো দিওয়ানে’। অ্যালবামটি মুক্তির দিনই বিক্রি হয় প্রায় এক লাখের বেশি কপি। কেবল বলিউডে নয়, গোটা দক্ষিণ এশিয়া, ব্রাজিল, দক্ষিণ আফ্রিকা, রাশিয়া, আমেরিকা, ইন্দোনেশিয়ায় এমনকি ক্যারিবীয় দ্বীপপুঞ্জেও অ্যালবামটি পায় তুমুল জনপ্রিয়তা।
বলিউডের প্রয়োজকরা বাক্স ভরা টাকা নিয়ে হাজির হয়েছিলেন নাজিয়ার কাছে। চলচ্চিত্রে নায়িকা হওয়ার অনুরোধ তিনি কিছুতেই রাখেন নি। নাজিয়ার একই কথা, আমি গান ভালোবাসি, অভিনয় নয়।’ আশির দশকে মুম্বাই বিমানবন্দরে নাজিয়া-জোহেব ভাই-বোনকে স্বাগত জানাতে হাজির হন তাদের প্রায় ৪০ হাজার ভক্ত, পরিস্থিতি সামাল দিতে ডাকতে হয় অতিরিক্ত পুলিশ।
১৯৮২ সালে মুক্তিপ্রাপ্ত ‘স্টার’ নামের ছবিটিতে সব মিলিয়ে মোট আটটি গান গেয়েছিলেন নাজিয়া ও জোহেব। বক্স অফিসে ফ্লপ খাওয়া ছবিটির গানগুলো নিয়ে করা তাদের ‘বুম বুম’ অ্যালবামটি আবার দারুণ জনিপ্রিয়তা পায়। ১৯৮৪-এ আসে তার তৃতীয় অ্যালবাম ‘ইয়ং তারাং’। এটা ছিলো নাজিয়া-জোয়েবের পাকিস্তানে করা প্রথম অ্যালবাম। অ্যালবামটিতে সবচেয়ে জনপ্রিয় হয়েছিল ‘আঁখে মিলানে ওয়ালে’ গানটি ও পরবর্তীকালে করা এর মিউজিক ভিডিও।
জানা যায়, নাজিয়া হাসানের কথা মাথায় রেখেই কম্পোজ করেছিলেন বিড্ডু , কিন্তু রাজনৈতিক প্রতিক্রিয়ার কথা ভেবে নাজিয়া এই গান গাওয়া থেকে নিজেকে বিরত রেখেছিলেন।
১৯৮৭ সালে মুক্তি পায় সিংগার ড্যুয়ো-র গাওয়া চতুর্থ অ্যালবাম ‘হট লাইন’ এবং সবশেষে ‘ক্যামেরা ক্যামেরা’। দু”ভাইবোনের ইংরেজি গানের অ্যালবাম ‘দ্য হাসান্স,ডোন্ট থিংক টুআইস কিংবা দেন ইউ কিস মি’ রিলিজ হয় যুক্তরাজ্য থেকে। প্রথম পাকিস্তানি হিসাবে নাজিয়া হাসানের গাওয়া ‘ড্রিমার দিওয়ানে’ ঠাঁই পায় ব্রিটিশ টপ-চার্টে।
১৯৯৫ সালে মা-বাবা’র ইচ্ছায় তাদের পছন্দের পাত্র ব্যবসায়ী মীর্জা ইশতিয়াক বেগের সাথে পাতেন অসফল এক সংসার। আধুনিক শিক্ষায় শিক্ষিত নাজিয়া পারিবারিক চাওয়া ও সামাজিক অনুশাসনকে মেনে নিয়েছেন নিঃসঙ্কোচে।
২০০০ সালের ১৩ আগস্ট ফুসফুসের ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুবরণ করেন এ কিংবদন্তি। মৃত্যুর পর ভাই জোহেব প্রকাশ্যে স্বীকার করেছেন নাজিয়াকে নিজেদের পছন্দ চাপিয়ে দেয়া ছিলো বাবা-মায়ের বিশাল ভুল। পাঁচ বছরের দাম্পত্য জীবনে এক ছেলে আরেজ হাসানের মা হয়েছেন, সুখ পাননি সংসার জীবনে। লন্ডনে হাসপাতাল-বাড়ি করে জীবনের শেষ আড়াই বছর পার করেছেন নাজিয়া। মৃত্যুর দশদিন আগে দু’হাজার সালের ৩ আগস্ট নাজিয়া পান তার স্বামীর শেষ উপহার, বিবাহ বিচ্ছেদের নোটিশ। মৃত্যুর পরও শেষ শয্যায় ছিলো না আপনজনের সান্নিধ্য।
মৃত্যু’র ১২ বছর পরেও নাজিয়ার গানের আবেদন যে আকাশ ছোঁয়া তার প্রমাণ ২০১২ সালে বলিউডে মুক্তি পাওয়া করণ জোহারের হিট ছবি ‘স্টুডেন্ট অফ দ্য ইয়ার’র ডিস্কো সং’ শীর্ষক গানটি।
মহানায়িকা সুচিত্রা সেনের ভাগ্নি লগ্নার সাম্প্রতিক এক সাক্ষাতকারে জানা যায়, সুচিত্রা সেনও ভীষণ পছন্দ করতেন নাজিয়া হাসানের গান। লগ্না বলেন, “বুম বুম... দিল বোলে বুম বুম’ নাজিয়া হাসানের ওই গানটা যে মাসি কী ভালবাসত! আমাকে ছোটবেলায় খালি বলত, ‘বনি মা, ওই বুম বুম গানটা গা।’
‘ডিস্কো দিওয়ানে’ গানে ব্যবহার করা প্রয়াত নাজিয়ার ভয়েস ট্র্যাকের সাথে এ সময়ের ক্রেজ বেনি দয়াল ও সুনীতি চৌহানের কণ্ঠ মিলিয়ে নতুন মিউজিক অ্যারেঞ্জমেন্টে তৈরী হয় গানটি। এ প্রজন্মের শ্রোতারা আটের দশকের ‘পপ-আইকন’ নাজিয়া হাসানকে তার মৃত্যুর একযুগ পর মুগ্ধতা দিয়ে গ্রহণ করেছে দু’হাত বাড়িয়ে। ‘স্টুডেন্ট অফ দ্য ইয়ার’ ছবির বক্স অফিসে ঝড় তোলার গুরুত্বপূর্ণ উপাদান ‘ডিস্কো সং’ গানটি।

এই সংগীতশিল্পীকে নিয়ে সাম্প্রতিককালে বলিউডে একটি ছবি নির্মাণের ঘোষণা এসেছে। আর ছবিটিতে নাজিয়ার চরিত্রে অভিনয়ে আগ্রহ প্রকাশ করেছেন বলিউডের জনপ্রিয় অভিনেত্রী আলিয়া ভাট।